সপ্তর্ষির চকিতে রোমির কথা মনে পড়ে গেল। গত বছর অষ্টমীতে সে তাকে নিয়ে শ্রীরামপুরে ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছিল। রোমি এখন তার কেউ নয়। সে এখন দীপাংশুর গার্লফ্রেন্ড। সপ্তর্ষি ভালো করেই জানে, দীপাংশু ওকে বিয়ে করবে না। সাতঘাটের জল খাওয়া দীপাংশু মস্তি ফুরিয়ে গেলেই রোমিকে চায়ের ভাঁড়ের মতো ছুড়ে ফেলে দেবে। তখন বুঝবে সপ্তর্ষিকে বিট্রে করার কী মজা। আর রোমির চোখের সামনে ভেনাসকে নিয়ে সপ্তর্ষি যদি ঘুরে বেড়ায়, তা হলে তো সোনায় সোহাগা।

—আগে ছিল। এখন নেই, বলে সপ্তর্ষি অন্যমনস্ক ভাবে দেয়ালে ঝোলানো ‘ফায়ার’ লেখা আগুন নেভানো যন্ত্রের দিকে তাকাল। মেয়েটি অর্থাৎ ব্ল্যাক ভেনাস বলে উঠল, ‘তা হলে আজ আমরা কলকাতায় ঠাকুর দেখতে যাচ্ছি। আমি কিন্তু শ্রীরামপুর স্টেশনের বুকিং কাউন্টারের সামনে বিকেল পাঁচটায় অপেক্ষা করব। কথার খেলাপ হবে না তো?”

—তোমার মতো এরকম একজন ‘জোধাবাই’ থুড়ি সুন্দরী ব্ল্যাক ভেনাসের কথার খেলাপ করব, তেমন বুকের পাটা আমার নেই। এই রে, আপনাকে তুমি বলে ফেললাম। কিছু মনে করবেন না, বলেই সপ্তর্ষি একটু লজ্জিত হল।

মহিলাটি বলল, “আজ আমাকে আপনি প্রথম তুমি বললেন, কাল আপনাকে আমি তুমি বলব। কথা দিলাম।”

এরই মধ্যে জেনারেটর চালু হতেই শপিং মলের আলো জ্বলে উঠল। একটু আগে লোডশেডিং হওয়াতে শপিং মলের ক্রেতাদের দেখে মনে হয়েছিল, কেউ যেন তাদের মরণকাঠি ছুইয়ে দিয়েছিল। আলো জ্বলে উঠতেই জিয়নকাঠির স্পর্শে যেন তারা আবার সচল হয়ে উঠেছে। একটু আগে রোমির কথা মনে হয়েছিল, এখন আর তা নেই। রোমির বিকল্প সে পেয়ে গিয়েছে। হঠাৎ ওর হাতের মোবাইলটা বেজে উঠল।

সপ্তর্ষি মোবাইলটা কানে রাখতেই ফুলদির গলা ভেসে এল, ‘এত দেরি করছিস কেন?’ সপ্তর্ষি ভেনাসের মুখে মুক্তোর মতো ফুটে উঠা বিন্দু বিন্দু ঘামের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে মিথ্যা বলল, ‘জ্যামে আটকে আছি, ১৫ মিনিটের মধ্যেই যাচ্ছি।’

—সত্যি! আপনি পারেনও বটে, বলে ভেনাস হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল।

হাসলে যে ওকে আরও সুন্দর লাগে, তা সপ্তর্ষির জানা ছিল না। সঙ্গে কোনও ফোটোগ্রাফার থাকলে এখনই ভেনাসের হাস্যোজ্জ্বল মুখের ছবি তুলে ‘অষ্টমীর নন্দিনী’ ক্যাপশান দিত। তা যখন নেই, তখন সপ্তর্ষিই বা সুযোগ ছাড়ে কেন!

সে ভেনাসের মুখের হাসির রেশটুকু মোবাইলের ক্যামেরায় তুলে বলল, ‘পারমিশন না নিয়েই কিন্তু তোমার একটা ফোটো তুললাম। কিছু মনে করলে না তো?’

—না, আমি তোমার কোনও কিছুতেই কোনও আপত্তি করছি না। এই রে, তুমি বলে ফেললাম! তুমিটা কাল বলব ভেবেছিলাম, আজই বলে ফেললাম।”

—তুমি কিন্তু কথার খেলাপ করলে।

—বেশ করেছি, যাও। তোমাকে যে বললাম একটা পারফিউম চয়েস করতে, তার কী হল ?

তা শুনে সপ্তর্ষি একটা পারফিউম পছন্দ করে ভেনাসের হাতে তুলে দিল এবং ভেনাসকে গিফট দেওয়ার জন্য যখন পছন্দসই পারফিউম খুঁজে বেড়াচ্ছে ও, ঠিক তখনই সে শুনতে পেল ‘এক্সকিউজ মি, আমার একটু তাড়া আছে। আমি চলি। কেমন? বিকেলে দেখা হবে।’

সপ্তর্ষিকে কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ভেনাস আঁচল উড়িয়ে পরির মতো হুস করে চলে গেল। সপ্তর্ষির অনেক কথা বলার ছিল। কিন্তু ভেনাস যে এত তাড়াতাড়ি চলে যাবে সে ভাবতেই পারেনি। ভেনাসের সঙ্গে পরিচয় হয়ে সে রোমির দুঃখটা ভুলেছিল। অল্প কিছুক্ষণের আলাপে ভেনাস তার কাছে রোমির বিকল্প হয়ে উঠেছিল। কিন্তু সে হঠাৎ চলে যাওয়ায় সপ্তর্ষির বুকের ভিতর গুমরে গুমরে উঠল পুরোনো যন্ত্রণাটা। অবশ্য ভেনাসেরই বা দোষ কী! তার হয়তো বাড়ি যাওয়ার তাড়া আছে। সে তো মাথার দিব্যি দেয়নি যে, সব কাজ ফেলে সপ্তর্ষির পাশে থাকতে হবে।

তা ছাড়া সে তো কথা দিয়েছে আজ অষ্টমীর সন্ধেয় তার সঙ্গে সাউথ ক্যালকাটায় ঠাকুর দেখতে যাবে। সপ্তর্ষি বৃথা চিন্তা না করে ফুলদির কথামতো গোবিন্দভোগ চাল, কাজু কিশমিশ, জম্মু রাজমা আর ঘি ট্রলিতে ভরে কাউন্টারের সামনে এসে দাঁড়াল।

সপ্তর্ষি ব্যাকপকেট থেকে মানিব্যাগ বের করার জন্য হাত বাড়াতেই শূন্য হাতটা উঠে এল। সে অস্ফুটে বলে উঠল, ‘আমার মানিব্যাগ?” –কত ছিল আপনার মানিব্যাগে? কাউন্টারে বসা ছেলেটি জিজ্ঞেস করল।

—১০ হাজার টাকা।

—যে-মেয়েটি আপনার সঙ্গে গল্প করছিল এটা তারই কাজ। গত বছরও পুজোর সময় ওই মেয়েটি একজনের পকেট থেকে পাঁচ হাজার টাকা চুরি করেছিল। প্রমাণের অভাবে আমরা ওকে ধরতে পারিনি। এবার আপনাকে সাবধান করতে গিয়েও পিছিয়ে এসেছি। যেভাবে আপনি ওর সঙ্গে গল্প করছিলেন তাতে মনে হল উনি আপনার পরিচিত কেউ।

সপ্তর্ষি আর কথা না বাড়িয়ে মোবাইল ফোনটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “এটা জমা রাখুন। বিকেলে টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে যাব।”

—তার দরকার হবে না। আপনি বোনাফাইড কাস্টমার। টাকাটা বিকেলেই দেবেন। ছেলেটি মোবাইলটা ফেরত দিয়ে বলল। সপ্তর্ষি কমলা রঙের ব্যাগ হাতে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে বাইকে বসে শপিং মলের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাল। আর সেখানে ইংরেজি হরফে লেখা রয়েছে, “মোর কোয়ালিটি মোর ভ্যারাইটি, মোর কনভিনিয়েন্স, মোর ভ্যালু।”

(সমাপ্ত)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...