মালবাজার পশ্চিম ডুয়ার্সের একটি জমজমাট উল্লেখযোগ্য জনপদ। এখানকার বাস টার্মিনাস থেকে নানান রুটের বাস ছাড়ে। মাল নদী পেরিয়ে বাঁয়ে সুনগাচি টি-এস্টেট। যাত্রাপথে একটি বড়ো সেতুর নীচে এলিয়ে নেওড়া নদী। সেই চওড়া নদীবক্ষে কয়েকটি মাত্র শীর্ণ জলধারা বয়ে চলেছে অজস্র নুড়ি ভিজিয়ে। বর্ষা মরশুমে উত্তরবঙ্গের এইসব নদীগুলিই বন্যার জলে ফুঁসে ভাসিয়ে দিয়ে যায় দুই পাড়ের যাপিত জীবনকে। প্রকৃতির উগ্র রোষের কাছে তখন অসহায় ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন উত্তরবঙ্গের মানুষ ও প্রশাসন।
পথের ভাঁজে ভাঁজে ছায়া কখনও একফালি রোদের আরাম। পেরোতে থাকি অজস্র ছোটো নদী। সবুজের বর্ণমালায় ভেসে ছিল চালসা। স্থানীয়দের কাছে পরিচিত ‘চালসা মহাবারি’ নামে। চালসার পরিচিতি ‘কুইন অফ ডোর্স’ (Queen of Doors) নামেও। গরুমারা ও চাপড়ামারি অরণ্যের সীমান্ত-ঠিকানা। উত্তর-পূর্ব ডুয়ার্স ভ্রমণের প্রবেশতোরণ বলা যায় চালসাকে। এখান থেকে ডুয়ার্সের অন্যান্য বিভিন্ন গন্তব্যের যানবাহন ছাড়ছে। ট্রেকার, বেসরকারি বাস, জিপ, সওয়ারি গাড়িগুলির বিস্তর হাঁকাহাঁকি। কাছেপিঠে বেশ কিছু অফবিট ভ্রমণ ঠিকানা, লালিগুরাস, লালঝামেলা, সামসিং, সুনতালেখোলা, মণ্ডল গাঁও, রকি আইল্যান্ড, সাকামবস্তি, ঝান্ডি, টামটা ভ্যালি, বিন্দু, প্যারেন, ঝালং ইত্যাদি স্থানগুলি নিসর্গমোহে আধভেজা করবেই।
আবার ওদিকে রয়েছে গরুমারা জাতীয় উদ্যান অন্যদিকে চাপড়ামারি অভয়ারণ্য। ‘মারি’ অর্থ হল ‘প্রাচুর্য। চালসার সাপ্তাহিক ‘মঙ্গলবারি হাট’-টি খুব জনপ্রিয়। মালবাজার ডিভিশনে, মেটেলি সিডি ব্লকের অধীনে চালসা। চালসা মোড় থেকে কিছুটা এসেই চালসা থেকে মেটেলি, পাহাড়ের মৃদু ঢাল বেয়ে রেললাইন। আগের মিটারগেজ সরিয়ে এখন ব্রডগেজ হয়ে গেছে। তার ঠিক পরেই দু’তিনটে চূড়ান্ত সর্পিল বাঁক ঘুরে পাহাড়িপথের শুরু। এক লাফেই অনেকটা উঁচুতে চলে এলাম। নীচে একান্তে পড়ে রইল ডুয়ার্সের সমতল আর চালসা শহরতলি।
আঁকাবাঁকা পাহাড়িপথ বেয়ে কস্মিন লাবণ্য চিরে দু’পাশে আদিগন্ত চা-বাগানের মসৃণ সামগান। বাঁদিকে চড়াইয়ের কিনারা ঘেঁষে সিনক্লিয়ার্স রিট্রিট। অবকাশযাপনের এক নিপাট আবাস। আমরা এখানেই ঘাঁটি গেড়ে পূর্ব ডুয়ার্সের কয়েকটি ভ্রমণস্থল গাড়ি নিয়ে টো- টো করে ঘুরে ফিরে দেখে নেব, এমনই মনস্থ করেছি। অনন্ত শ্যামলিমা চিরে চিকণ পথ। প্রায় বুক সমান উঁচু চা-বাগিচার মাঝেমাঝে শিরিষ গাছের শেড-ট্রির ফাঁক গলে দিনের নরম রোদ্দুর বিছিয়ে রয়েছে অকাতর সবুজ জলসাঘরে। বাঁয়ে-ডাইনে কিলকট, আইভিল, ইনডং, থাবো, চুলসা, জুরান্তি, নাগাইসুরি, চালাউনি, সামসিং, মেটিয়ালি, সাতখোয়া, নেওড়া মাঝিয়ালি, সালবারি, উত্তর ধুপঝোরা, বরাদিঘি, বাতাবাড়ি এমনই রকমারি চা-বাগিচা নিয়েই মাটিয়ালি বা মেটেলি ব্যাস্ত জনপদ।
চালসা থেকে মেটেলি ১২.১ কিলোমিটার মাত্র। মাটিয়ালি গ্রামপঞ্চায়েতটি চা-বাগান ঘেরা এক জনপদ। এখানে সাদরি, গোর্খালি, কুরুক, ওঁরাও, রাজবংশী, বোরো ইত্যাদি জনজাতির বাস। স্থানীয় মানুষজন, যানবাহন, ব্যাস্ততা ঘিরে মেটেলি, সামসিং পাহাড়তলির এক ভালোলাগা স্থান। এখানকার বেশিরভাগ বাসিন্দার জীবিকা মূলত চা-বাগিচাকেন্দ্রিক। মাটিয়ালি কালিবাড়ি স্থানীয়দের কাছে খুব জাগ্রত। ঠিক উলটো দিকে মাটিয়ালি থানা। মেটেলিতে রবিবার বেশ জমজমাট হাট বসে। ওপরে ফারি বস্তি, সামসিং, মৌটুসি বিট থেকে স্থানীয় মানুষজন নীচে নেমে এসে এই হাটেই প্রয়োজনীয় রসদ কেনাবেচা করেন।
ভ্রমণের সবটুকু ধরা থাকে কুয়াশার আস্তরণ চিরে চা-বাগান, দূরের আকাশ, পাখির ডাক আর নিরিবিলির কাছে। নেওড়া নদীর কোল ঘেঁষে জুরন্তি চা-বাগিচার কাছে রয়েছে চমৎকার এক পিকনিক স্পট। অনাবিল স্নিগ্ধতা ছেয়ে আছে। নুড়িপাথর মাড়িয়ে ডিঙিয়ে নেওড়া নদীর এক্কেবারে কাছ বরাবর চলে এসেছি। নেওড়া নদীর অগভীর স্বচ্ছ জলে নামলাম, পা ভিজোলাম। আজীবন ঋণী থাকা যায়, পরমা প্রকৃতির কাছে। মূর্তি নদীর কোলে রকি আইল্যান্ড ও সুন্তালেখোলার কাছেই লালিগুরাসেও ঢুঁ মারি।
কখনও চলে যাই, ডায়না নদীর তীরে ভুটান সীমানা লাগোয়া এক রত্তি গাঁ, লালঝামেলা বস্তি। আদপে এটি হল দুটো পৃথক বস্তি, লাল বস্তি ও ঝামেলা বস্তির মিলিত রূপ। ভারত-ভুটানের সংযোগকারী সেতুটিতে ঠেস দিয়ে, অদ্ভুত অচেনা আনন্দ। সামসিং ছাড়িয়ে সুনতালে ঢোকার আগেই ওপরের বিজনপথ চলে গেছে মণ্ডলগাঁও, সেখানে দু’ধারে স্ট্রবেরি চাষের জমি, তার মধ্যে দিয়েই এক পা এক পা করে সেঁধিয়ে যাই।
দূরে টেম্পলা পাহাড়ের ফিকে রেখা। না-ফুরোনো অলীক ডিঙিয়ে চালসা-মাটিয়ালির অরক্ষিত গোপন আনকোরা ঠিকানা, অচেনা সবই আমার কাছে। নতুন গল্প নেই কোনও। পর্যাপ্ত ভ্রমণপথ সাঁতরে, হারাতে চেয়েছি পথ ডুয়ার্সের কুঠুরিতে।