নতুন অর্থ-বর্ষের শুরুতেই বদলিটা হয়ে গেল নন্দিতার। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের স্থায়ী সরকারি চাকরিতে তিন থেকে পাঁচ বছর অন্তর বদলি হওয়া নিতান্তই স্বাভাবিক ঘটনা; কিন্তু এরকম পছন্দসই জায়গায় একদম উপযুক্ত সময়ে ট্রান্সফার পাওয়াটা সত্যিই সৌভাগ্যের ব্যাপার! তবে সাধারণ মানুষের জীবনেও কখনও-সখনও ম্যাজিক ঘটে বই-কি— এই যেমন নন্দিতার জীবনেই ঘটল!
প্রায় বিশ বছরের চাকরি-জীবনে এই প্রথমবার ট্রান্সফার অর্ডারটা হাতে পেয়ে এত খুশি হল বছর পঁয়তাল্লিশের নন্দিতা। সঙ্গে সঙ্গেই স্বামী তপনকে ফোনে খবরটা জানাল সে। পেশায় ইঞ্জিনিয়র বছর পঞ্চাশের তপনবাবু চাকরি করেন রাজ্যের সেচ দফতরে, সল্টলেকে অফিস ওনার। আর নন্দিতার ট্রান্সফার হয়েছে আমহার্স্ট স্ট্রিট ব্রাঞ্চে। নন্দিতার মুখে খবরটা শুনে তপনবাবুও আনন্দিত নন্দিতার মতো একই কারণে।
নাহ্, আঠেরো বছরের বিবাহিত জীবনের পর একই শহরে এক ছাদের তলায় থেকে কাজ করতে পারার আনন্দ এটা নয়; ওদের একমাত্র সন্তান কলকাতার নামি স্কুলের ক্লাস টেনের ছাত্র। বছর পনেরোর তমালের সামনের বছরই মাধ্যমিক, তাই মা-বাবা দুজনের সাহচর্যই যে তাকে জীবনের প্রথম বড়ো পরীক্ষার ক্ষেত্রে মানসিক ভাবে সাহায্য করবে— এ’কথা ভেবেই আনন্দিত নন্দিতা, তপন দুজনেই।
নন্দিতাদের গ্যারেজ-সহ তিন কামরার নিজস্ব ফ্ল্যাটটা যাদবপুরে। নন্দিতা বা তপন কারওরই বাড়ি কলকাতায় নয়। কিন্তু চাকরির প্রায় কয়েক বছর পর থেকেই তপনবাবুর পোস্টিং কলকাতায় হয়ে যাওয়ায় এবং পরবর্তী বদলির সম্ভাবনা ক্ষীণ বুঝে আর একমাত্র ছেলের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে, অনেক বিচার-বিবেচনা করেই এই বাসস্থানটি কিনেছেন এবং নন্দিতার অবসর গ্রহণের পর এই মহানগরীরই পাকাপাকি বাসিন্দা হয়ে যাবেন বলে ঠিক করেছেন। দক্ষিণবঙ্গে নিজেদের পুরোনো মফস্সল শহরে আর ফেরার ইচ্ছে নেই তাদের।
অদ্ভুত ভাবে নন্দিতা এযাবৎ চাকরিসূত্রে কেবলমাত্র থেকেছে জেলা-শহরে, আবার কখনওবা গ্রামেও। কিন্তু ছুটিছাটায় কলকাতায় পরিবারের সাথে কিংবা অন্য শহরে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে সময় কাটালেও কখনও কোনও বড়ো শহরে কয়েক মাসের জন্যও থাকার দরকার পড়েনি তার।
এই প্রথমবার কল্লোলিনী তিলোত্তমায় কয়েক বছরের জন্য আসার পর ঠিক হল যে, নিজেদের চারচাকা ড্রাইভ করে অফিস যাওয়ার সময় তপনবাবু ছেলেকে স্কুলে ছেড়ে দিয়ে আর তারপর নন্দিতাকে ব্যাংকে নামিয়ে সল্টলেকের পথে বেরিয়ে যাবেন। তমালের স্কুল, বাড়ি থেকে হাঁটা দূরত্বে তাই ফিরতে ওর কোনও সমস্যা কোনও দিনই ছিল না। শিয়ালদার কাছাকাছি নন্দিতার ব্রাঞ্চও তপনের অফিস যাওয়ার রাস্তাতেই পড়ে। তাই তাতেও কোনও ঝামেলা নেই। শুধু সমস্যা হবে নন্দিতার বাড়ি ফেরার সময়। ব্যাংকের কাজের বরাবরই বিশাল চাপ। কর্মীদের ছুটিও হয় দেরিতেই, তাই দুজনের বাড়ি ফেরার সময় না মেলায় নন্দিতাকে ফিরতে হবে সেই বাস অথবা লোকাল ট্রেনে। ওদের ফ্ল্যাটটা যাদবপুর স্টেশনের একদম গায়ে লাগা। ট্রেনে সময় তুলনামূলক কম লাগায় বা জ্যামে আটকে দেরি হওয়ার ঝক্কি না থাকায় রেলের পথটিই বেশি সুবিধাজনক ঠেকল নন্দিতার কাছে।
নন্দিতার রোজ লোকাল ট্রেনে বাড়ি ফেরা তাও আজ নেই নেই করে মাস তিনেক হয়েই গেল। আর-পাঁচটা নিত্যযাত্রীর মতোই “মান্থলি’ করা আছে তার। এতে শিয়ালদার কাউন্টারের ভিড়ে দাঁড়িয়ে রোজ টিকিট কাটার পরিশ্রম আর সময় দুই’ই বাঁচে। নন্দিতা যে-সব সময় ট্রেনের লেডিস কামরাতেই চড়ে তা নয়। অনেক সময় সেখানে সুবিধে না হলে জেনারেল কম্পার্টমেন্টেও উঠে পড়ে কোনও কোনও দিন। এভাবে অনেক পুরুষ ও মহিলা ডেইলি প্যাসেঞ্জারের সাথেই আলাপ জমে গেছে মাত্র এই ক’দিনেই।
নন্দিতার কলকাতার বাসে, ট্রেনে বা মেট্রোয়— মহিলাদের জন্য সিট-সংরক্ষণ ব্যাপারটা খুব আশ্চর্য ঠেকে মাঝেমধ্যে! সে বড়ো শহরে আগে নিজেদের গাড়ি ছাড়া কোথাও আসা-যাওয়া করেনি ঠিকই কিন্তু জেলার ছোটোখাটো শহর, মফস্সল, শহরতলি বা গ্রামেগঞ্জে তো ট্রেনে বাসেই ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করেছে কাজের সূত্রে বিভিন্ন সময়ে। কই, সেসব জায়গায় তো এমন পাবলিক যানবাহনের সিটের ক্ষেত্রে মহিলাদের জন্য আলাদা কোনও রিজার্ভেশন নেই। আর সত্যি বলতে কী, তাতে কোনও সমস্যাও হচ্ছে না কারওর। দিব্যি পুরুষ, নারী পাশাপাশি সিট শেয়ার করে বা ভিড়ে একসাথে দাঁড়িয়ে স্কুল-কলেজ-অফিস করছে। সেসব জায়গায় ছেলেদের জন্য যে এক্ষেত্রে অন্তত মেয়েদের সত্যিই কোনও অসুবিধা হয় না, তার প্রকৃষ্ট সাক্ষী সে নিজে। আর এই মহানগরে দ্যাখো… ‘ইকুয়্যালিটি’র দাবি তুলেও মেয়েরা নিজেরাই আবার ‘মহিলাদের বিভিন্ন অসুবিধা’র ধুয়ো তুলে এই ‘গাছেরও খাব আবার তলারও কুড়াব’ গোছের সুবিধাগুলো নিয়েই চলেছে! সাধে কি আর লোকে এখন ‘নারীবাদ’কে গালিগালাজ করে!
এই তো নন্দিতাদের কলকাতার ফ্ল্যাটের রান্নার লোক শ্যামলী— ওকে যদি একদিন একটা বেশি কাজের কথা বলা হয় তো সঙ্গে সঙ্গে ফোঁস করে উঠবে— ‘এই বেরোবার মুখে এক্সট্রা কিছু বোলোনি গো বউদি। এখান থেকে বেরোতে দেরি হয় বলে একেই তো লেডিস-স্পেশালটা পাই না আজকাল। তার মধ্যে বারো বগির ক্যানিং লোকালটা না পেলে সেই তার পরের দশ বগির নামখানায় লেডিসে ভিড়ে ওঠা যায় না আর।’
এ কথা শুনে নন্দিতা যদি বলে ফেলে— “কেন? লেডিসে না উঠতে পারলে জেনারেলে গেলেই তো পারো।” তার প্রত্যুত্তরে শ্যামলী মুখের ভাবখানা এমন করবে যেন নন্দিতা কি একটা ভয়ংকর ধরনের অসম্ভব কাজ করতে বলেছে ওকে! অথচ, ওই লেডিসেই বসার জায়গা নিয়ে ঝগড়ায় এই শ্যামলীদের খিস্তি-খেউড় থেকে শুরু করে চুলোচুলি অবধি কিছুই প্রায় বাদ যায় না!
(ক্রমশ……)