ক’দিন আগে, সেদিন একটু তাড়াতাড়িই এই সন্ধে সাতটা নাগাদ বাড়ি ফিরছিল নন্দিতা। সোনারপুর লোকালের লেডিসেই ফেরবার সময় দেখে যে, এক কলেজপড়ুয়া তরুণী এক পুরুষ হকারের উদ্দেশ্যে হঠাৎ ধমকে উঠল— “এই যে দাদা, নিজের হাতটা ঠিকমতো নিজের কাছেই রাখুন।’

হকারটিও হকচকিয়ে জবাব দেয়— “ইয়ে, না মানে আমি তো কিছু করিনি।’ সাথে সাথেই তরুণীর বাউন্সার ছোটে— ‘না, না, আপনারা তো কিছুই করেন না। আমরা মেয়েরা এমনি এমনিই বানিয়ে বানিয়েই এসব বলি!’ এরপর এই হকারকে সমর্থন করতে এগিয়ে এল এক নিম্নবিত্ত দেহাতি মহিলা আর তার পালটা দিতে মেয়েটির সমর্থনে তার সাথের বান্ধবী ও এক যুবতি অফিসযাত্রী।

—তোমার তো তাও এই অল্প বয়সেই সাহস রয়েছে প্রতিবাদ করার। অনেকে তো প্রথমে বুঝেই উঠতে পারে না যে আসলে কী ঘটল বা ঘটছে আর বুঝে উঠলেও লজ্জার খাতিরে কিছু বলে উঠতে পারে না এই ভয়ে, পাছে তাকেই উলটে কেউ কিছু বলে, দোষারোপ করে! বলে ওঠে বছর ছাব্বিশ-সাতাশের চাকুরিজীবী মেয়েটি।

দেহাতি মহিলাটির যুক্তি আবার আলাদা। তার মতে ভিড়ের মধ্যে হয়তো ভুলবশত ‘ছোঁয়াছুঁয়ি’ হয়ে গেছে কোনও ভাবে, তাতে এতো চ্যাঁচামেচির কী আছে? নন্দিতার মতো বাকিরা বেশিরভাগই কিছু নিজের চোখে না দেখে থাকায় চুপচাপ থেকে নিজেদের নিরপেক্ষতা বজায় রাখে। তবে প্রায়শই এই ট্রেনযাত্রার সুবাদে ওই হকারটির সাথে দেহাতি মহিলাটির রঙ্গরসিকতার ঢলাঢলি নন্দিতার চোখে লাগলেও, এক্ষেত্রে নন্দিতার ওই মহিলাটির কথাই ঠিকঠাক যুক্তিসঙ্গত মনে হল।

ক’দিন আগেই নন্দিতা ইউটিউবে দেখল, একটা মিউজিক ভিডিওতে গানের সাথে অভিনয় করে দেখাচ্ছে— বাসে আচমকা ব্রেক কষায় ছেলেটা অনিচ্ছাকৃত ভাবে একটা মেয়ের গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ায় থাপ্পড় হজম করতে হল ছেলেটিকে। অথচ এর উলটো ঘটনাটা ঘটলে কী ঘটত সেই প্রশ্নোত্তরে তোলপাড় ভাইরাল ভিডিওটার কমেন্ট সেকশন!

আজ সকাল থেকে বোঝাই যায়নি যে এত বৃষ্টি হতে পারে নাহলে তানিয়ার হাফ-ডে’র ছুটিটা কিছুতেই মঞ্জুর করত না অ্যাসিস্টান্ট ম্যানেজার নন্দিতা। আবহাওয়ার খবর না রাখার ফলাফল! সদ্য পিও পোস্টে জয়েন করেছে তানিয়া। বয়স বছর ত্রিশ-বত্রিশ। আজ বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ এসে আবদার জুড়ল— আগামীকাল থেকে ওর যে-দিন তিনেকের ছুটি নেওয়া আছে তার সাথে আজকের অর্ধেক দিনের ছুটিও চায়!

—বুঝতেই তো পারছেন ম্যাম, মাসতুতো দিদির বিয়ে। এখান থেকেই ডিরেক্ট চলে যেতাম তবে…..

—হ্যাঁ, তো ব্যাংক বন্ধের পরই যেও। অসুবিধে কী?

—আরে ওই অফিস ছুটির সময়ে বাসে এত ভিড় থাকে যে পা রাখার জায়গা তো দূর, ওই লাইনের বাসে ওঠা পর্যন্ত যায় না। ওই রুটের বাস তো আবার কলেজ স্ট্রিটের ওখানে ছাড়া পাওয়াও যাবে না। মাসিদের বাড়িটা এমন জায়গায় যে অতটা ভেতরে ক্যাব যেতেও চায় না, তাই আরকী। আপনি যদি ম্যানেজার স্যারকে একবার প্লিজ বলে দেন আর্লি লিভের ব্যাপারে….

শোনো তানিয়া, আমহার্স্ট স্ট্রিট থেকে একটা রানিং অটোয় কলেজ স্ট্রিট দু মিনিটও লাগবে না। ছুটিটা না নিয়ে বরং একটু তাড়াতাড়িই বেরিয়ো না হয়।

—ওরে বাবা, ওই চলতি অটোয় সামনে নয়তো পিছনের সিটের মাঝে বা শেষ কোণায় বসতে আমি এক মিনিটের জন্যও চাই না। কেমন যেন সাফোকেটিং, ইনসিকিয়োরড লাগে। আর তাছাড়া…

—এই আমাদের মেয়েদের এক দোষ জানো তো। এটা চাই না, ওটা পারব না ইত্যাদি ইত্যাদি! এই তো ক’দিন আগেই আমাদের গাড়িটা সার্ভিসিং-এ গেছে বলে হাজব্যান্ড আর ছেলের সাথে বাসে একসাথে অফিস আসার সময় দেখলাম, একটা মেয়ে তার ছেলে বন্ধুটির সাথে গল্প করতে করতে যাবে বলে বাসের জেনারেল সিটে বসেছে অথচ আমার পনেরো বছরের ছেলেটা জায়গা না পেয়ে লেডিস সিটে বসেছিল বলে এক ভদ্রমহিলা ওই সিটে বসবে বলে ওকে তুলে দিল! বলো কী বলবে?

—সে তো একদিনের একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ম্যাডাম। কিন্তু হামেশাই যে-সব হ্যারাসমেন্টগুলো যাওয়া-আসার পথে ফেস করতে হয় সেসবের জাস্টিফিকেশন কী? আর এক-আধটা এই ধরনের ঘটনা দিয়ে কী প্রমাণ হয়? ভিড় বাসে দাঁড়িয়ে থাকার কথা তো ছেড়েই দিন, অনেক সময় বাসের সিটে ধারের দিকে বসলেও… এই সময় কেবিনে ঢোকেন গোল্ড-লোন সেকশনের সিনিয়র-মোস্ট ক্লার্ক, টালিগঞ্জ থেকে সেন্ট্রাল মেট্রোর নিত্যদিনের যাত্রী, অবিবাহিত, মাঝবয়সি মীনাক্ষীদি। তানিয়ার কথাগুলো ওনার কানেও গেছে আর তার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ প্রচ্ছন্ন সমর্থন যেন খেলা করছে তাঁর দৈহিক অভিব্যক্তিতে। তাই আর এই নিয়ে বেশি দূর কথা না। এগিয়ে চুপ করে যাওয়াই শ্রেয় মনে হল নন্দিতার।

কিন্তু তানিয়ার ছুটির জন্য অতিরিক্ত কাজ সারতে গিয়ে এমনিতেই দেরি হয়ে গিয়েছিল। তার মধ্যে এরকম প্রবল বৃষ্টিতে কলকাতা শহরের যানজট যে কী ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে— তা এই প্রথম বুঝল নন্দিতা যখন বাড়ি ফেরার জন্য চেষ্টা করেও কোনও অ্যাপ-ক্যাব বুক করতে পারল না সে। এদিকে গাড়ি সারাই করতে দেওয়ায় স্বামী তপন আজ বাসে অনেক আগেই বাড়ি ঢুকে গেছে। বৃষ্টিতে শিয়ালদা অবধি না গিয়ে ব্যাংকের নীচেই অপেক্ষা করল বাসের জন্য কিন্তু বিধি বাম, এতে সময় নষ্ট হলেও বাড়ি ফেরার মতো একটা বাস বা হলুদ ট্যাক্সিও কপালে জুটল না নন্দিতার।

(ক্রমশ……)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...