ওই আবার ফোনটা বাজতে আরম্ভ করল। গতকাল থেকে ওই একই নাম্বার থেকে বারবার ফোন আসছিল। ফোনটা তুললেই একটা অস্পষ্ট গোঙানির মতো আওয়াজ আসে। অবোধ্য ভাষায় কেউ যেন কিছু বোঝাবার চেষ্টা করছে। প্রথমবার রং নম্বর, প্লিজ বলে লাইন কেটে দিয়েছিলাম। কিন্তু সেই অবোধ্য স্বর থামেনি। সেই একই সুরে একই যেন কথা বলে যাচ্ছিল। আমি আবার বলার চেষ্টা করি কিন্তু সেই কণ্ঠ থামেনি। হয়তো আমার কথা শুনতে পাচ্ছে না বা বুঝতে পারছে না!
এরপর ওই নাম্বার থেকে ফোন এলে আমি লাইন কেটে দিচ্ছিলাম। বিরক্তিতে মন ভরে যাচ্ছিল। কিন্তু কোনও উপায়ও খুঁজে পাচ্ছিলাম না। এবার রাগ না করে যুক্তি দিয়ে বোঝবার চেষ্টা করলাম— আমার নাম্বার পেল কী করে? আমি এ শহরে নতুন এসেছি, নাম্বারটাও খুব পুরোনো নয়। আমারই কোনও পরিচিত মজা করে এমন করছে না তো? কোনও নিকট আত্মীয়, যেমন আমার ছোড়দি যাকে সপ্তাহে একবার ফোন না করলে রাগ করে কথা বন্ধ করার হুমকি দিয়ে, সে নয়তো? ছোড়দি, সুব্রতদা, রথীন, বুদ্ধদেব, ওমপ্রকাশ, রাণা কাপুর— এদের সবাইকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করলাম, কেউ ফোন করেনি গত দু’দিন। তাহলে কে?
ওই আবার ফোনটা তিনবার বেজে বন্ধ হয়ে গেল। আমি হাঁফ ছেড়ে, থ্যাংক গড বলে লেখায় মন দিলাম। কিন্তু কয়েক মিনিট পরেই আবার বাজতে শুরু করল। আমি ফোনটা তুলে চিৎকার করে উঠলাম, “ইউ ফুল, কী চাই? আমি বারবার বলছি রং নাম্বার, তবুও…। কিন্তু সেই অবোধ্য ভাষায় একই সুরে আওয়াজ ভেসে এল।
আমি রাগ করে ফোনটা সুইচঅফ করে দিলাম; কিন্তু লেখায় মন বসাতে পারলাম না। কয়েকটা প্রয়োজনীয় আর জরুরি ফোন আসার কথা ছিল। প্রকাশকদের কাছ থেকেও ফোন আসার কথা, ফোন না পেয়ে ওরা ভাববে আমি ইচ্ছে করে ফোন বন্ধ করে রেখেছি। এ তো মহা বিপদে পড়া গেল দেখছি!
বোতাম টিপে ফোন বন্ধ করলেও ভাবনা থেকে মনকে সরাতে পারলাম না। কেবলই মনে হচ্ছিল, এর মধ্যে কোন রহস্য থাকতে পারে! বার বার একই ফোনে, একই গলার স্বরে রং নাম্বার আসতে যাবে কেন? আর একবারও ‘সরি’ না বলে বিড়বিড় করে অস্পষ্ট কিছু বলার চেষ্টা করছে। শেষ পর্যন্ত ঠিক করলাম এর একটা শেষ দেখতে হবে। একটা যেন অজানা ‘চাপ’ অনুভব করলাম মনে।
হঠাৎ মনে পড়ল প্রায় ভুলে যাওয়া স্কুলের বন্ধু ভবতোষ দত্তকে। শুনেছি ও আজকাল পুলিশের একজন ‘হোমড়া-চোমড়া’ কর্তাব্যক্তি। লালবাজারে কয়েকটা ফোন করতেই ওর নাম্বার পেয়ে গেলাম।
সামান্য দ্বিধাভরে ওর নাম্বারে ফোন করতেই বাজখাঁই গলার জবাব পেলাম। নিজের নাম উচ্চারণ করতেই একটা ছোটোখাটো ভদ্র-গোছের গালাগাল দিয়ে বলল, “শালা, কোনও বিপদে পড়েছিস নিশ্চয়ই তা নাহলে এত দিন পরে পুলিশ বন্ধুকে ফোন করবি কেন?”
আমি হেসে হালকা স্বরে বললাম, “ফ্রেন্ড ইন নিড ইজ এ ফ্রেন্ড ইনডিড।’ আবার একটা গালাগাল দিয়ে বলল, ‘বুঝলাম, এবার শালা ঝেড়ে কাশো তো।’ ব্যাপারটা ওকে খুলে বললাম। আরও বললাম ফোন ট্রেস করতে ওর সাহায্য চাই। প্রথমে ও ব্যাপারটা হেসে উড়িয়ে দিতে চাইল, বলল— এটা তোর পাড়ার কোনও চ্যাংড়ার কাজ। কোনও চ্যাংড়ার সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়েছিল? বা পুজোর চাঁদা দিসনি, বা কম দিয়েছিলি।
আমি বললাম, ‘এসব কিছু নয় ভাই, আমি এ পাড়ায় নতুন, আর ফোন নাম্বারটাও নতুন।”
এবার উঁচু-মানের সরকারি অফিসার কী যেন একটু ভাবল। জাতে পুলিশ তো, রহস্যের গন্ধ নিশ্চয়ই নাকে লেগেছে এতক্ষণে। বলল, ‘ফোন নাম্বারটা আমাকে হোয়াটস অ্যাপ করে দে, কাল সকালে আসব তোর বাড়ি। ঠিকানাটাও পাঠিয়ে দিস।’ বলেই লাইন কেটে দিল ভবতোষ।
পরের দিন সকাল সকাল এসে পৌঁছোল ভবতোষ৷ একেবারে সাধারণ পোশাকে, এমনকী পুলিশের গাড়িও নয়, নিজের ছোটো মারুতি গাড়িটা নিয়ে এসেছে। চা খেতে খেতে পুরো ঘটনাটা আর একবার ওকে খুলে বললাম, আরও বললাম এর মধ্যে যেন কোনও “ক্রিমিনালিটি’র গন্ধ পাচ্ছি। ভবতোষ আবার একটা ‘নিরামিষ’ গালাগাল দিয়ে বলল, ‘চল বেরিয়ে পড়ি।’
ওর পকেটে রাখা একটা চিরকুটে লেখা টেলিফোনের ঠিকানাটা আমার হাতে দিয়ে বলল, ‘জানিস জায়গাটা?’
আমি একনজরে ঠিকানাটা পড়ে নিলাম। কলেজজীবনে হাওয়াই চপ্পল পরে সারা শহর ‘চষে’ বেড়িয়েছি কিন্তু এমন রাস্তার নাম মনে করতে পারলাম না। ডাইনে-বাঁয়ে ঘাড় নাড়লাম, ‘এ কোন দেশে? কলকাতায়?”
অবশ্য গত দুই দশকে এই শহরের ইতিহাস-ভূগোল অনেক বদলে গেছে। সামান্য হেসে ভবতোষ আশ্বাস দিল, ও মোটামুটি আঁচ করতে পারছে কোথায় জায়গাটা। পুলিশের লোক তো, জানবে না-ই বা কেন? ভবতোষ নিজেই গাড়ি চালাচ্ছিল, সঙ্গত কারণেই ড্রাইভার আনেনি।
উত্তর কলকাতার এক পরিচিত মোড়ে এসে গাড়ি ঢুকল ছোটো রাস্তায়, তারপর আর গাড়ি চালানোর মতো রাস্তা নেই। গাড়ি দাঁড় করিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম দু’জনে। ডাইনে, বাঁয়ে, গলি, উপ-গলি, তস্য উপ-গলি পেরিয়ে এমন একটা গলিতে ঢুকলাম যেখান দিয়ে দু’জন একসঙ্গে সোজা হয়ে চলা সম্ভব হয় না। একজনকে কাত হয়ে দাঁড়াতে হয়, তবেই অন্য দিক থেকে আসা মানুষ পার হতে পারেন।
(ক্রমশ…)