বুঝতে পারলাম কয়েক মিনিটের ব্যবধানে আমরা তিন শতাব্দী পিছিয়ে আধুনিক শহর কলকাতা ছেড়ে জব চার্নকের সুতনুটি গ্রামে পৌঁছে গেছি। আমি হলফ করে বলতে পারি এখানে আমাকে একলা ছেড়ে দিলে আমি এ গলি থেকে বেরুতে পারব না। শেষ পর্যন্ত কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করে আমাদের ঈপ্সিত ঠিকানায় পৌঁছোলাম।
একটা টিনের চালের একতলা বাড়ি। কোনও সদর দরজা বলে কিছু নেই। একেবারে সোজা শোয়ার ঘরে। চিরকুটে লেখা ঠিকানার সঙ্গে মিলিয়ে দেখলাম কাঠের দরজায় চক দিয়ে লেখা, সেও প্রায় মুছে যাবার মতো মলিন। ভবতোষ কাগজের লেখা মিলিয়ে আস্তে দরজায় কড়া নাড়ল। কোনও সাড়া না পেয়ে এবার ভবতোষ জোরে কড়া নাড়ল। তাতেও কোনও ফল হল না দেখে দরজায় ধাক্কা দিতেই পুরোনো দরজাটা ক্যাঁচ শব্দ করে খুলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে একটা তীব্র স্যাঁতসেঁতে গন্ধ নাকে এল। ভবতোষ আমার দিকে তাকিয়ে পকেট হাতড়ে রুমাল বের করে নাকের আগায় ধরল। আমি আধো অন্ধকারে চোখকে অভ্যস্ত করে নিচ্ছিলাম।
এই ঘরটা পেরিয়ে আর একটা ঘরে ঢুকতেই গন্ধটা ভীষণ তীব্র ভাবে নাকে ঝাপটা মারল। ঘরে কোনও আলো নেই, ছাদের কোণে একটা ঘুলঘুলি দিয়ে বাইরের আলো চুইয়ে ঢুকছিল, তাতে আলোকিত না হলেও অন্ধকার কমে এসেছিল বা আমাদের চোখ ততক্ষণে অন্ধকারে ধাতস্থ হয়ে গিয়েছিল। ঘরের মধ্যে আসবাব বলতে কেবল একটি কাঠের তক্তাপোষ আর ঘরের কোণে রাখা মলিন ‘জলচৌকি’ যার উপরে রাখা আছে একটি জলের কুঁজো।
প্রাগৈতিহাসিক তক্তাপোষের উপরে ততোধিক মলিন বিছানায় শুয়ে ছিলেন অস্থি-চর্ম সর্বস্ব এক অশীতিপর কঙ্কালসার বৃদ্ধ। আমাদের দিকে চেয়ে বিছানার একপাশে রাখা ছোটো লাঠিটা তুলে কয়েকবার তক্তাপোষে আঘাত করলেন।
কোথা থেকে একটি অল্পবয়সি মেয়ে এগিয়ে এল! সম্ভবত আমাদের দেখেই ঘরে ঢুকেছিল আমাদেরই পিছু পিছু। বৃদ্ধ এক অবোধ্য অস্পষ্ট গোঙানির স্বরে কিছু বললেন মেয়েটিকে। আমার মনে পড়ে গেল টেলিফোনের কথাগুলি আর আমার অকারণ অসন্তোষ প্রকাশের কথা। মনে মনে লজ্জিত বোধ করলাম।