ঘুম থেকে উঠে সবেমাত্র দিনের প্রথম চায়ের কাপটি হাতে নিয়েছি কী, মোবাইল বেজে উঠল। এত সকালে কে ফোন করতে পারে?

—হ্যালো, কে বলছেন?

—দাদা, ঢাকা থেইক্যা রতন সরকার কইতাছি।

—হ্যাঁ, বলো রতন কী সংবাদ? সব কুশল মঙ্গল তো? —হ, সব ঠিক আছে দাদা। বাড়ির কাছের নৈসর্গ ছেড়ে ইয়োরোপ-আমেরিকা দৌড়াই ক্যান?

—কোন জায়গার কথা বলছ রতন? কাশ্মীরের কথা?

—হ, দাদা, খুব ইচ্ছে হইতাছে জম্মু-কাশ্মীর দেখার।

আমিও অনেক দিন ধরেই ভাবছিলাম একই কথা। সঙ্গী হিসাবে রতন সরকার খুবই ভালো। রাজি হয়ে গেলাম।

রতন ঢাকা থেকে কলকাতায় আসবে, সেখান থেকে দিল্লি এয়ারপোর্টে ওর সঙ্গে দেখা হবে, তারপর দিল্লি থেকে একই প্লেনে জম্মু যাব। এরপর জম্মু থেকে ভ্রমণ শুরু। দু’ঘণ্টার কিছু কম সময়ে আমাদের প্লেন জম্মু এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করল। হালকা বৃষ্টি হচ্ছিল। এপ্রিলের প্রথম দিক, আশাতীত ভাবে ঠান্ডাটাও বেশ রয়েছে।

এয়ারপোর্টের বাইরে ট্যাক্সি স্ট্যান্ড থেকে একটা ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলে পৌঁছোতে আধঘণ্টার বেশি সময় লেগে গেল। হোটেলের ঘরে ঢুকে শীত বেশি করতে লাগল, বুঝিয়ে দিল কাশ্মীরে এসে গেছি। হোটেল মালিক বললেন— এখানে কিন্তু ‘প্রি-পেইড’ সিমের মোবাইল চলবে না, পোস্ট-পেইড সিম অথবা লোকাল সিম নিতে হবে। সে ব্যবস্থা অবশ্য ওরাই করে দেবেন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই নতুন সিম লাগিয়ে আমাদের ফোন ‘চালু’ হয়ে গেল।

চা-বিস্কুট খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। হোটেল থেকে বেরিয়েই শেয়ার ‘টোটো’তে চড়ে বসলাম, রঘুনাথ মন্দিরের উদ্দেশ্যে। টোটো পাহাড়ি রাস্তা ঘুরে ঘুরে উঠে এল রঘুনাথ মন্দিরের সামনে। বেশ বড়ো মন্দির, সুরক্ষারও কড়া বন্দোবস্ত। বড়ো এলাকাজুড়ে বিভিন্ন দেব-দেবীর মন্দির। অবশ্য রঘুনাথ অর্থাৎ রামের মন্দিরই প্রধান। এখানে রাম, সীতা, লক্ষ্মণের বিরাট সুদৃশ্য মূর্তি রয়েছে। দেখলাম রামের মূর্তি কালো পাথরের। একের পর এক মন্দির পেরিয়ে শেষে এলাম একটি ছোটো মন্দিরে। এটি মা বৈষ্ণোদেবীর মন্দির। সুসজ্জিত আর নির্মল পরিবেশ।

সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। চারদিকে বাজারের ভিড় আর রকমারি দোকানের সাজসজ্জা, কাশ্মীরি ফল আর শীতের পোশাকের সমারোহ। রতন এখান থেকে শীতের কিছু গরম কাপড় কিনল।

পরের দিন সকালবেলায় আমাদের গন্তব্য সোজা পহেল গাঁও। শুনলাম রাস্তা ভালো থাকলে বাসে আট ঘণ্টার মতো লাগবে। প্রথম দিকে বেশ ভালোই চলছিল বাস, সবাই খুব খুশি, বিকেল বিকেল পৌঁছে যাব। নয় কিলোমিটারের উপর লম্বা ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী টানেলও পেরিয়ে এলাম নির্বিঘ্নে। কিন্তু তার একটু পরেই শুরু হল বাসের থামা আর ধিকি ধিকি চলা। তারপর একেবারেই থেমে গেল।

শোনা গেল সামনে কোথায়ও ধস নেমে রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে। ধস পরিষ্কার করা শুরু হয়েছে কিন্তু কতক্ষণ লাগবে কেউ জানে না। সবাই নেমে কাছের ধাবা, রেস্টুরেন্টে জলযোগ, চা খাবার কাজে লেগে গেল। প্রায় দু’ঘণ্টা পরে গাড়ি, বাস, লরি ধিকি ধিকি করে চলতে শুরু করল। বাস থেকেই দেখা গেল বরফ ঢাকা পাহাড়ের গায়ে সূর্যাস্ত।

রাস্তা একটাই তাই সব গাড়ি এক লাইনে চলতে চলতে শেষ পর্যন্ত রাত ন’টায় পৌঁছোলাম পহেল গাঁওতে। আগে থেকেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছিল, এবার বেশ জোরেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। ভিজতে ভিজতেই হোটেলে পৌঁছোলাম।

হিমালয়ের প্রাচীরে ঘেরা উত্তর ভারতভূমির সমতলের এই প্রথম গ্রাম তাই বুঝি এই জনপদের নাম পহেলগাঁও। রাতেই মেঘ কেটে গিয়ে আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেল। শীত অবশ্য আরও বেড়ে গেল। হোটেলে ইলেকট্রিক হিটের কম্বলের ব্যবস্থা ছিল তাই বিশেষ অসুবিধা হল না।

পহেল গাঁও

ভোরবেলা ঘুম ভেঙে শরীর বেশ ভালো লাগল। রতনও উঠে বসে সারাদিনের রুটিন ঠিক করতে লেগে গেল। টিফিন খেয়ে ছোটো ট্যাক্সি নিয়ে স্থানীয় দ্রষ্টব্য স্থান যেমন— আরু ভ্যালি, বেতাব ভ্যালি আর চন্দনবাড়ি দেখতে হবে। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিলাম। নীচের রেস্টুরেন্টে কিছু জলযোগ সেরে জামা-কাপড়ে আপাদমস্তক মুড়ে রাস্তায় নেমে এলাম। সারে সারে ট্যাক্সি দাঁড়িয়েই ছিল, সকলেরই একই রেট। তিনটি ভ্যালি ঘুরিয়ে দেখিয়ে নিয়ে আসবে লাঞ্চের আগে। লাঞ্চের পরেই আমাদের বাস ৮ ঘণ্টার রাস্তা শ্রীনগরের পথে যাত্রা শুরু করবে।

আরু ভ্যালি

প্রথমেই এলাম ‘আরু’ভ্যালি বা উপত্যকায়। অপূর্ব নৈসর্গিক দৃশ্যে ভরা বরফঢাকা পাহাড় আর নীচে সবুজ ঘাসে ভরা স্বর্গীয় উদ্যান। নীচে প্রবাহিত ‘লিডার’ বা ‘লাইডার’ নদী। চারিদিকে এমন নিস্তব্ধ যে, আমরা শহুরে মানুষেরা কিছুদিন এখানে থেকে নৈঃশব্দ্য উপভোগ করার শিক্ষা নেওয়া ভালো। পাহাড়ে চড়া আর ‘ট্রেকার’দেরও এটি একটি ‘বেস-ক্যাম্প’। আরু ভ্যালিতে প্রায় ৪০ মিনিট কাটিয়ে আমাদের গাড়ি চলল বেতাব ভ্যালির দিকে। আসলে এটি একটি অতি সুন্দর পাহাড়ি গ্রাম। গরু, ছাগল, ভেড়া আর মুরগি পালনই স্থানীয়দের জীবিকা। মনে হল বেশ আধুনিক গ্রাম। সব রকমের দোকানপাট, ডিসপেনসারি, হাসপাতাল সবই দেখা গেল। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে সরু আর শান্ত লাইডার বা লিডার নদী। এই নদীই আবার বয়ে গেছে বেতাব ভ্যালিতেও।

পনেরো মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম আর এক স্বর্গীয় উপত্যকায়। এখন একে ‘বেতাব’ উপত্যকা বলে। কিন্তু এর আসল নাম ছিল ‘হাজন’ বা ‘হাগন’ উপত্যকা। এখানে বিখ্যাত হিন্দি চলচ্চিত্র, বেতাব-এর শুটিং হয়েছিল; তারপর থেকেই এর নাম হয়ে গেছে বেতাব উপত্যকা। যে কুটিরগুলিতে চলচ্চিত্রের নায়ক নায়িকারা থাকতেন সেইসব ‘কুটির’গুলি এখনও আছে। পরে অবশ্য, আরও অনেক চলচ্চিত্রর এখানে শুটিং হয়েছে। উপরের রাস্তা থেকে নীচের উপত্যকার রাস্তা, মাঠ, ঘরবাড়ি, লিডার নদী ছবির মতো লাগছিল। সিনেমার ছবি তোলার উপযুক্ত স্থানই বটে! আমাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ল প্রায় আধ ঘণ্টার জন্য, শুনলাম কোনও সরকারি তথ্যচিত্রের শুটিং চলছে। আধঘণ্টা পরে রাস্তা খুলে গেল।

চন্দনবাড়ি

বেতাব উপত্যকা থেকে চড়াই রাস্তা পার করে চল্লিশ মিনিট পরে এসে পৌঁছোলাম আর এক স্বর্গরাজ্যে। চারদিকে শুধু সাদা সাদা বরফ, কোথায়ও কোনও মাটির চিহ্ন নেই। বড়ো বড়ো পাইন গাছ বরফের উপর মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এ স্থানের নাম আমরা সবাই শুনেছি, অমরনাথ তীর্থের পথে— চন্দনবাড়ি। এখান থেকেই শুরু হয় ৩২ কিলোমিটারব্যাপী পায়েচলা রাস্তা অমরনাথ গুহা পর্যন্ত। কী অপরূপ নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরা এই চন্দনবাড়ি উপত্যকা। প্রায় একঘণ্টা কাটালাম চন্দনবাড়িতে। ফিরতে ইচ্ছে না থাকলেও সময়ের কারণে ফিরতেই হয়।

দুপুরের খাওয়া শেষ করে আবার বাসে উঠে পড়লাম। চারদিকে আমাদের ঘিরে ধরল শুকনো ফল আর বিভিন্ন বাদাম বিক্রেতার দল। এখানকার আমন্ড, এলাচ, আখরোট ইত্যাদি ভারত বিখ্যাত এবং অপেক্ষাকৃত সস্তা। রতন অনেক বাদাম, আখরোট, এলাচ কিনল। আমিও সামান্য কিনলাম। ডাল লেকের শিকারার বাজার থেকে কিনব বলে আপাতত বেশি কিছু কিনলাম না।

(ক্রমশ……)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...