শ্রেয়া তার কণ্ঠস্বরে যারপরনাই সহানুভূতি মিশিয়ে বলল, ‘নিজেকে অত অসহায় ভাববেন না।’ ‘আমি তো আছি৷’ না। কথাটা বলতে গিয়েও বলে ফেলেনি শ্রেয়া।

শ্রেয়া সেদিন হ্যাংলার মতোই বলেছিল, ‘যদি কালই যাই?’ উনি খানিক ভেবে বললেন, “ঠিক আছে সেকেন্ড হাফে এসো। হাতে একটু সময় নিয়ে আসবে। ফিরতে সন্ধে হলে আমি ড্রপ করে দেব। ওকে?’

এসব ভাবতে ভাবতেই শ্রেয়া কখন মন্ত্রচালিতের মতো ইউনিভার্সিটিতে সম্রাট মিত্রর চেম্বারের সামনে এসে দাঁড়াল। সে ভাবে, প্রেমে পড়লেই বা, একটু বেশি তাড়াহুড়ো হয়ে যাচ্ছে নাকি? ওদের ক্লাসের অয়ন খুব মজার কথা বলে। ও প্রায়ই বলে, ‘প্রেমকে একটু পাকতে দিতে হয়। বুঝলি কাঁচা আম পেড়ে এনে যেমন কার্বাইডে জাঁক দিয়ে পাকিয়ে নেয়, প্রেমকেও তেমনই পাকিয়ে নিতে হয়।’

শ্রেয়া ভাবল, কালই আলাপ, আজই ছুটে আসাটা হ্যাংলামিই হবে। অয়নের কথাটা মনে ধরেছে। শ্রেয়া মনে মনে বলে, ঠিক হ্যায় বাচ্চু প্রেমটা একটু পাকুক। দেখাই যাক না ব্যাপারটা রেসিপ্রোকাল কিনা। তাই সে গন্তব্যে পৌঁছেও অ্যাবাউট টার্ন করে ফিরে এসেছে।

সম্রাট ফোনে বলেছেন, ‘কী হল এলে না কেন?’ শ্রেয়া বুঝল ব্যাপারটা তাহলে পাকছে। বলল, ‘কাল একটা এক্সট্রা ক্লাস ছিল। তাই যেতে পারিনি।’ তখনই সম্রাট বলেছেন, ‘তুমি বরং আমার বাড়িতে এসো।”

আজ সেই সম্রাটের বাড়িতে এসে পৌঁছোল। ঠিকানা ছবির মতো বুঝিয়ে দিয়েছিলেন সম্রাট। একটুও বেগ পেতে হয়নি শ্রেয়াকে। ডোরবেলে আঙুল ছোঁয়ানোর আগে খানিক থমকে যায় শ্রেয়া। সে ভাবে, মানুষটা বাড়িতে একা থাকেন। অফিস কামাই করে শ্রেয়াকে আসতে বলেছেন। ওঁর সম্পর্কে শ্রেয়ার সব ধারণা পালটে যাবে না তো? ওই ভালোমানুষি চেহারার আড়ালে কোনও শ্বাপদ লুকিয়ে নেই তো? যে-শ্বাপদের শুধুই মাংসের লোভ? শ্রেয়া আবার ভাবে, সে না এসেও তো থাকতে পারেনি। ওনার সম্পর্কে অসীম কৌতূহল আর দুর্বার আকর্ষণ তাকে সেই কুদঘাট থেকে সল্টলেক পর্যন্ত তো ছুটিয়ে এনেছে। সে আজ ফিরেও যাবে না। ভদ্রলোকের পিওরিটি তো যাচাই করা যাবে। ভাবতে ভাবতে শ্রেয়ার আঙুল চলে যায় ডোরবেলের ওপর। চেপেও দেয়৷

খানিকবাদে খুলে যায় দরজা। এই বাড়ির খোলা দরজার একক অধীশ্বরী কি শ্রেয়া? নাকি এই দরজা টপকে আজ তাকে নিজের সম্মান, সম্ভ্রম বাঁচিয়ে ছিটকে বেরিয়ে আসতে হবে?

একজন মাঝবয়সি মহিলা দরজা খুলে দিয়ে বলেন, ‘আপনি কি শ্রেয়া দিদিমণি।’

শ্রেয়া বলল, “হুঁ, স্যার আছেন তো?’ শ্রেয়া জানত, উনি থাকবেনই। তবু এটুকু নেহাতই সৌজন্য।

ওই মহিলা বললেন, ‘আসুন, ভেতরে আসুন।’

শ্রেয়া ভাবল, যাক তাহলে খতরা নেই। মানে বিপদ অনেকটাই নেই। এত বড়ো বাড়িতে উনি একা থাকলে ঝুঁকি তো ছিলই।

শ্রেয়া ওর সৌন্দর্য সম্পর্কে পুরোমাত্রায় সচেতন। তার ফিগার যে খুবই অ্যাপিলিং, সেই টনটনে জ্ঞান নিয়েই চলে শ্রেয়া। সেই শরীরী আগুনে কি পতঙ্গের মতো ঝাঁপ দিতে চায় লোকটা? দেখাই যাক না, ওঁর ওই শান্ত সৌম্যকান্তি মুখ না মুখোশ!

শ্রেয়া পায়ে পায়ে এগোচ্ছিল। তখনই শ্রেয়ার বুক কেঁপে ওঠে। সম্রাট খানিক গলা চড়িয়েই বলেন, ‘মোস্ট ওয়েলকাম শ্রেয়া। এসো সোজা ভেতরে চলে এসো।’

একটা দামি সোফায় শ্রেয়ার প্রায় কোমর পর্যন্ত ডুবে গেল। এত নরম ও আরামদায়ক সোফা। নিশ্চয়ই খুব দামি হবে। সম্রাট একটা বই এগিয়ে দেন শ্রেয়ার দিকে। বলেন, ‘এই নাও তোমার ব্যোমকেশ সমগ্র।’

শ্রেয়া হাত বাড়িয়ে নেয় বইটা। কোনও গিফট প্যাক নয়। বইটা হাতে নিয়ে প্রথম পাতাটা উলটেই বোবা হয়ে যায় শ্রেয়া। সল্টলেকে এই মুহূর্তে একটা ভূমিকম্প হল। নেহাতই একটা নিরীহ ভূমিকম্প। শ্রেয়া ছাড়া সেই কম্পন কেউ অনুভব করতে পারে না।

বইটার পুস্তানিতে লেখা, ‘আমাদের আদরের শ্রেয়াকে মা ও বাবা।’ ঠিক তখনই শরবতের ট্রে নিয়ে ঘরে ঢোকেন কাকলি। শ্রেয়া চমকে ওঠে মাকে দেখে

কাকলি বলেন, “কীরে? খুব তো আমার বিয়ে দিবি বলছিলি। এখন এই বাবাকে পছন্দ হয়েছে তো?’ শ্রেয়া মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।

কাকলির বুক থেকে শ্রেয়াকে ছিনিয়ে নেন সম্রাট। সম্রাটের দামি গাউনের বুক খামচে ধরে কাঁদতে থাকে শ্রেয়া। কাঁদতে কাঁদতেই শ্রেয়া একসময় উপলব্ধি করে প্রেমিক নয়, এতদিন এমনই একটা বড়োমাপের নির্ভরতার বুক আর আস্তানারই কাঙাল ছিল সে।

(সমাপ্ত)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...