কপালে বাটালি ছুঁইয়ে একটা ভারী হাতুড়ি দিয়ে বাটালির উপর আঘাত করতেই ঠন করে উঠল পাথর। লোকটা তার ঝোলা থেকে এবার একটা ছোটোমতো বাটি আর শান দেবার পাথর বের করে। তারপর ঘটির তলায় পড়ে থাকা শেষ জলটুকু বাটির মধ্যে ঢেলে নেয়। একটু ঢালে শিলের উপরে। মুখে বলে, ‘কত্তা, শিলডা এট্টুস নরম কত্তি হবেনে। ম্যালা দিন ব্যাভার নেই দেখতিছি।”
সে শিল ভেজাতে দিয়ে তার বাটালি নিয়ে পড়ে। বাটালির মাথায় অল্প করে জল নিয়ে শান দেবার পাথরের উপর ফেলে ঘসতে থাকে। বাটালির মাথা চকচক করে ওঠে। ঋষভের চোখও চকচক করে। আজ তাহলে একটা কাজের কাজ করে ফেলতে পারছে। বউ দুপুরের ভাতঘুম থেকে উঠে যখন দেখবে, নিশ্চই তার মরদগিরিতে নম্বর যোগ হবে। মানে, সে যে করিতকর্মা লোক, সামান্য হলেও তার একটা নমুনা পেশ করা যাবে।
শিলকাটাইওয়ালা টাইম নেয়। সে যে শুধু শিল খোদাইতে দক্ষ তা তো নয়। সে মানুষের মন খোদাই করতেও পারে। সে জানে নিজের কর্মপদ্ধতি যথা সম্ভব বিস্তৃত করে বুঝিয়ে দিতে হবে। তা না হলে এই কাজের পারিপাট্য ও মূল্য জানবে কী করে!
—কইসি কি, সে যা দিতি হবেনে দেবেন ক্ষণ৷ বেগোনে যাবোনানে। আর আকশ্রুতি হবে এমন কর্মও করবোনানে।
মুখে দাম বললে যদি কম বেশি কিছু একটাতে খদ্দের হাতছাড়া হয়ে যায়! ভাবে শিলকাটাইওয়ালা। সে নিজের মনে কাজ করতে থাকে। ব্যাগের ভেতর থেকে নরম গামছার কাপড় বের করে ভেজা শিল ভালো করে মুছে নেয়। তারপর আবার একটা বেঁটে ও মোটা হাতুড়ি দিয়ে বাটালির উপর আঘাত করতে থাকে। শিলটার গোটা শরীরের চারপাশ ছোটো ছোটো খোদাই দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়।
ঋষভের কৌতূহলী একজোড়া চোখের উপর দৃষ্টি বুলিয়ে সে শুধোল, ‘তা কত্তা, ডিজাইনখানা, হ্যাঁ, এইবারে কন।”
ঋষভ ঘাড় চুলকোতে চুলকোতে বলে, ‘ডিজাইন মানে?’
—কত্তা, এই শিলডায় রাম-সীতার বিয়ের ডিজাইন ছেল। তার মানে এই শিলের সাথে আপনার মা-বাবা-রা জড়ায়ে আচেন।
—অ্যাঁ, আপনি কী করে জানলেন? ঋষভের মনে হচ্ছে লোকটা গায়ে পড়া
শিলকাটাইওয়ালা শিলের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে বিড়বিড় করে, ‘আপনে যদি হুকুম দেন কত্তা, আমি একেনে রাম- সীতেরে ফেরাই দিতি পারি। মানে রাম-সীতের বিয়ের ছবি তুলে দিতি পারি। আর যদি অতখানি না লাগে, পদ্ম আর কলকা আঁকে দেবানে পাথরের খোলে।”
সে একটু থেমে আবার বলে, ‘শিলির বুকি মৎস অবতার আনতি পারি। এক্কেবারে সাদামাটা চালি, আপনেরে কুলো আঁকি দেবানে।’
ঋষভ ভয় পায়, কত না চার্জ করে দেবে একটা শিল খোদাই করে দিতে! সে তাড়াতাড়ি বলে, ‘না, তেমন কি আর দরকার আছে! এই সাদা-মাটা কেটে দিলেই হল, যাতে কাজে লাগে। মানে, একটু জিরে-হলুদ বাটা যায়, এই আর কি!”
—কত্তা, সব জিনিসেই কটুকু কাজের, ভাবলি চলে না।
কথাটা বলে ফেলার পর হয়তো তার মনে হয়েছে বলাটা ঠিক হয়নি, তাই একটুকু থেমে থাকে। তারপর স্বীকারোক্তির ঢঙে আবারও সে বলে, “কিছু মনে নেবেন না, আপনেরা আমাদের ভগমান, আমাদের ভাত দেন। ভচ্ছনা করলি করবেন আনে। কিন্তু ছোটো মুকি এটুকুন বলি…।’
লোকটা হাতুড়ির ঠুকঠুক থামিয়ে চোখ তুলে চায়। চোখে কী যেন আকুল নদী কুলকুল করছে! চোখের ভেতর কী যেন করুণতা ঝরছে! মুখের উপর মুখ চালানোয় যে স্বাভাবিক রাগ হবার কথা, তা ঋষভের মন থেকে উধাও। কী যে মায়া ওই চোখে ছড়ানো! ঋষভ তো তো করে। ‘মানে কত খরচ পড়বে… কিছুই তো জানি না।’
একগাল হেসে শিলকাটাইওয়ালা বলে, ‘বিশ্বেস করেন, আপনের থে অল্যায্য কিচ্ছুটি নেবো নানে। আপনের যা মনে লয়, তা-ই দেবেন আনে। কিন্তু আমার ইচ্ছেড়া শোনাই কত্তা। এহানে আপনের পুরাণ কথা যদি ফেরায় আনা যায়! এই শিলডার বুকি যতখানি মায়া ধরা ছেল, যতখানি ভালোবাসা আঁকা ছেল, তা যদি ফেরান যায়…।’
গলা কাঁপছিল শিলকাটাইওয়ালার। একটু কি কান্না জড়ানো ছিল! ঋষভের বুকের ভেতর কেমন যেন ফাঁকা হয়ে গেল। এই শিল যার তাকে তো প্রায় বনের ভেতর একা থাকতে বাধ্য হতে হচ্ছে। তার গলার ভেতর থেকে একটা গোঙানি বেরিয়ে এল, ‘মা মা৷’ ঋষভ শিলকাটাইওয়ালাকে থামায় হাত উঁচিয়ে। তার হাত ও মুখ একই সাথে থেমে যায়। ঋষভ বলে, “আচ্ছা আমি মায়ের কাছ থেকে শুনে নিই, এটা তাঁরই তো শিল। জেনে নিই এর বুকে কী ছবি আঁকা ছিল।”
তড়িঘড়ি সিঁড়ি বেয়ে দোতলার লম্বা বারান্দায় উঠে যায়। সেখানেই রয়েছে শ্বশুরমশাই প্রাণনাথ চক্রবর্তীর খুব শখের টেলেফোনটি। ঋষভ ফোন করে, ‘মা, আচ্ছা শোনো, ঋষভ বলছি। কেমন আছো মা?’
ঠোক্কর খেতে খেতে, মানে একমাত্র ছেলের বউ-এর কাছে ঠান্ডা ব্যবহার পেতে পেতে নিজের ভেতরে কান্না সামলে মমতাদেবী অনেকগুলো বছর আগেই স্থির করে নিয়েছিলেন, একাই থাকবেন এই ভিটেয়। যাক। ছেলে, ছেলে-বউ, নাতনি কলকাতায় চলে যাক।
(ক্রমশ……)