হ্যাঁ, ভেবে তো দেখেনি ঋষভ! এক একটা দুর্গা ঠাকুর দেখতে কত কত লোক আসে। কিছু একটা জাদু তো আছেই, নাহলে অত মানুষ কীসের টানে ঘর ছেড়ে পথে নামে!

—কত্তা, আমার মনে হয় এ একটা সম্পর্ক। এ যে কতকাল ধরি বুকির মদ্যি বসি থাকে বলা যায় না। কিন্তুক যেমনি পালমশাই মূর্তি বানাতি যায়, অমনি সে আপনা আপনি উঠি আসে। সেই সম্পর্ক ধরা দেয়। না দিলি পারবে কেন! সে তো আর ফটোক দেকি দেকি ঠাকুর বানাতিছে না। সেই কবে থেকি, শিশুবেলা থেকি বাপ-দাদাদের দেখাদেখি পালেরা ঠাকুর বানাতি যায়। তাদের কোনও দিকি তাকাতি হয় না। চক্ষুদানের পর পালমশাই যখন দুগ্‌গোর দিকি তাকায় তখন সে নিজিই দেকতি দেকতি মাতাল হইয়ে যায়। এই দেবী কী তার নিজির বানানো! তাহলি সে তো এক ম্যাজিকশিয়ান!

লোকটা কী বলে রে বাবা! ঋষভ চমকায়! এত কথা লোকটা জানল কী করে! ওই সাধারণ মানুষ, ওই প্রায় না-খেতে পাওয়া মানুষটার ভেতর ঘর এত ঝলমল করে কীভাবে!

শিলকাটাইওয়ালা বলে, ‘এই যে রাম-সীতার মূর্তি এখানে ফুটি উঠতিছে, তাকি আমি কোনও ফটোক দেখে করতিছি কত্তা! আমার বুকির ভেতর কবেই যেন বাপ-পিতেমোরা তা পেতে দেছে। আমি তো শুধু ছেনি আর হাতুড়ির ঠুকঠুক করা সাধারণ মানুষ। আমি তাদের উজোনে ভাইসছি গো কত্তা।

তিন

মেঘের ভেতর চাঁদ ভেসে বেড়াচ্ছে না চাঁদের ভেতর মেঘ। রবিবারের ছুটির দিন। বিকেলে আজ আর কোথাও বেরনোই হল না। শিল কাটার কাজ শেষ হতে সন্ধ্যা গড়িয়ে গেছে। অন্যদিন সন্ধ্যাবেলায় দু-তিন জন বন্ধু মিলে কাশী মিত্র ঘাটে বসে গল্প গুজব করে। আজ যায়নি। আজ আর ভালো লাগছিল না। একটু নিজের কাছে নিজেকে একা করে রাখতে ইচ্ছে করছিল। আজ ঋষভ বাড়ির তিন তলার ছাদে উঠে এসেছে। গঙ্গার জল পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। জেলে ডিঙি দেখা যাচ্ছে। রাতে বুঝি মাছ ধরবে। হারিকেন জ্বালিয়েছে। হারিকেনের মিটমিট আলো গঙ্গার বুকে প্রদীপের মতো লাগছে।

আজ কী মনে হয়েছে, দেয়ালে ঝোলানো ব্যাগ থেকে বাঁশি-টা বের করে নিয়ে এসেছে ছাদে। ফুঁ দিতে ইচ্ছে করছে না। হাওয়া হচ্ছে খুব। এলোমেলো হাওয়া। ধুতি আলুথালু হয়ে যাচ্ছে। আজ ঠিক পূর্ণিমা নয়। আগে-পরে হবে। চাঁদের গোলপানা রকম চোখে পড়ছে। অনেকদিন পর ছাদে এসেছে। ছাদে আসায় খারাপ যে লাগছে তা নয়। গঙ্গার দিক থেকে হু হু করে হাওয়া আসছে। উড়িয়ে নিয়ে যাবে নাকি!

অন্যমনা হয়ে আছে মন। নাড়াচাড়া খেয়েছে। শিলকাটাইওয়ালা ঋষভের মনটাকে নরম করেছে ঢের। বারবার মা-র কথা মনে পড়ছে। পশ্চিম দিকের কোণে গেল৷ নতুন বানানো ব্রিজটা চোখে পড়ে ওখান থেকে। মানুষের হাতে বানানো, মহাভারতের ময়দানবের হাতের নয়। নিম গাছটা বড়ো হতে হতে এত উঁচুতেও তার হাত ছড়িয়ে দিয়েছে। তার পাতাগুলি ঋষভের গায়ে লাগতেই মনে হল, কেউ যেন গায়ে নরম হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ঋষভ ভাবল গাছও যে ঘুরে বেড়াতে চায়, তা যেন এই মাটি তাকে ছাড়তে চায় না বলে সে ক্রমাগত উঁচুর দিকে নিজেকে নিয়ে যায়। ঋষভের মনের ভিতর থেকে অস্থিরতা উধাও। আর কখন যেন আনমনে বাঁশি তুলে নিয়েছে ঠোঁটে।

হ্যাঁ হ্যাঁ হচ্ছে তো! কিচ্ছুটি ভোলেনি। রাখালিয়া সুর দিব্যি খেলছে! কত যুগ পরে বাঁশি মুখে তুলল ঋষভ। সে ঠোঁট থেকে নামিয়ে বাঁশির সারা গায়ে আদর করে দিল। আজ মনে হল, অভিমান এসে তাদের কত কত দিন কেড়ে নিয়ে গেছে।

একটা সুর ভুল বাজিয়েছিল বলে ঋষভের বাবা তার হাত থেকে বাঁশি কেড়ে নিয়ে সেই বাঁশি দিয়েই দুই ঘা বসিয়েছিলেন ঋষভের পিঠে। তারপর বাবাও বাজাননি, ঋষভও না। তখন ক্লাস টেন। ঋষভের মনে পড়ছে কতবার ইচ্ছে করেছে, কিন্তু বাঁশি ঠোঁটে তুলতে পারেনি। সে শুধু ভেবেছে, বাবাও তো নিজেকে শাস্তি দিয়েছে, তারপর থেকে বাবা বাঁশি বাজানোর সুখ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করেছেন। তাহলে কোন স্বার্থপরতায় সে আবার বাঁশি বাজাবে!

এ সময় ঋষভ অবাক হয়ে দেখল চাঁদের উপর থেকে সমস্ত দাগ যেন সরে গেছে। কালো কালো দাগের চাঁদের মা বুড়ি উধাও। ঝকমক করছে চাঁদ মাথার উপরে। মেঘেরা নেই। তার নিজের মনের ভেতর থেকে সব কালো উধাও। কী এক নতুন আলোয় সে স্নান করছে।

এই ঠিকঠাক সুর তুলতে পারাটা ঋষভের সামনে পথ মেলে ধরল। শিলকাটাইওয়ালার কথা মনে এল। সে শুধুমাত্র তার শিল্পীসত্তা বজায় রাখার জন্য একটা গোটা জীবন বাজি রেখে বসে আছে। অন্য কোনও কাজ করলে সে তার পরিবার পরিজন নিয়ে আরও একটু ভালো ভাবে কাটাতে পারত। কিন্তু বুকের ভেতরে থাকা পুর্ব-পুরুষের শিল্পবোধ তাকে বারণ করেছে।

ঋষভ চাঁদের দিকে হাত মুঠো করে বলল, ‘পেয়েছি। আমি পেয়েছি। এই বাঁশির সারা গায়ে আমার বাবার গায়ের গন্ধ। এই বাঁশিতে বাবার ঠোঁটের স্বাদ লেগে আছে। বাঁশির মনের সাথে বাবার মন জুড়েছিল একদিন।’

ঋষভ বাঁশিকে বুকে চেপে ধরে বলল, ‘না না, আমি বাজাব, আর ছাড়ব না একে। ও শিলকাটাইওয়ালা, শোনো শোনো আমিও সম্পর্ক পেয়ে গেছি গো।’

(সমাপ্ত)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...