আমার জেদের কাছে আমি অটল ছিলাম। মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম বাড়ি থেকে বিয়ের অনুমতি না দিলে আমরা মন্দিরে গিয়ে বিয়ে করব। সেইমতো আমরা সবকিছু পরিকল্পনাও করে ফেলেছিলাম। কিন্তু ঠিক তার কয়েকদিন পরেই খবর পেলাম ঠাকুরদার শরীরে ক্যান্সার ধরা পড়েছে। তার শারীরিক অবস্থারও চরম অবণতি ঘটেছে। বাবা তখন আদেশ দিল আমায় এখানে আসার জন্য। সত্যি বলতে কী, ঠাকুরদার জন্য আমার মনটা বড়োই বিষণ্ন হয়ে পড়েছিল। কিন্তু প্রিয়াঙ্কাকে ছেড়ে আমি কিছুতেই আসতে চাইছিলাম না।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তারপর? ওনার সঙ্গে তোমার আর দেখা হয়েছিল? তাঁর সঙ্গে তো তোমার বিয়েই হয়নি। কারণ তুমি সারাজীবন…’
পুরো কথাটা শেষ হওয়ার আগেই ঠাকুরদা বলল, ‘না। প্রিয়াঙ্কার সঙ্গে সেদিন আমার শেষ দেখা হয়েছিল। এখানে আসার দিন কয়েকের মধ্যে বাবা-মাও এখানে চলে আসে। ভেবেছিলাম কয়েকদিন দাদা এবং তাদের ভরসায় ঠাকুরদাকে রেখে প্রিয়াঙ্কাকে বিয়ে করে তবেই ফিব।’ যাওয়ার সময় বাবা একটি কথাই আমায় বলেছিল, ‘মেয়েটির কাছে যাওয়ার জন্য আমি তোকে কোনওপ্রকার বাধা দেব না। তবে মেয়েটি কি সত্যিই তোকে ভালোবাসে? একটু বিচার করে দেখিস।’
প্রত্যুত্তরে বলেছিলাম, ‘প্রিয়াঙ্কাকে আমি চিনি বাবা। সে কোনদিনও আমায় ঠকাবে না।’
—কলকাতায় ফিরে সোজা চলে যাই ওর বাড়ি। কিন্তু সেখানে গিয়ে আশ্চর্যজনক ভাবে কারওর দেখা পেলাম না। ফটকের বাইরে দেখি তালা ঝুলছে। তখন ভাবলাম ওদের কোনও প্রতিবেশীর কাছে জিজ্ঞেস করি- ওরা কোথায় গিয়েছে। সেইমতো ওদের ঘনিষ্ঠ একজন ভদ্রলোকের কাছ থেকে জানতে পারি ওরা নাকি বাড়ি বিক্রি করে অন্যত্র কোথাও চলে গিয়েছে। কোথায় গিয়েছে, তা শুধু তিনি কেন, পাড়ার কেউই জানেন না। সেদিনের ওকে হারানোর যন্ত্রণা আমি আজও বুকে বয়ে বেড়াচ্ছি। আজও ওকে অত্যন্ত ভালোবাসি। আমি জানি, প্রিয়াঙ্কা আমায় না বলে কোনদিনও কোথাও যেতে পারে না। নিজের ভালোবাসাকে হারানোর যন্ত্রণা প্রবল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খবর পাই ঠাকুরদা আমাদের ছেড়ে চিরদিনের মতো চলে গিয়েছে। যাদের আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছি, মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে তাদের হারানোর যন্ত্রণা আমার উপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছিল। ফলে আমি মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছিলাম।
বাবা-মা অনেক চেষ্টা করেছিল একাকীত্ব কাটানোর জন্য আমার বিয়ে দেওয়ার। প্রায় নিয়মিত অনেক বড়োলোক ঘরের মেয়ের ছবি তারা আমায় দেখাতো। বারেবারে একটা কথাই পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছি যে, আমি বিয়ে করব না। সারাজীবন একাই থাকব। ব্যস, তারপর থেকে এই বই আর ছবিটিই ছিল আমার নিত্যদিনের সঙ্গী। বইটা প্রিয়াঙ্কা আমায় পড়ার জন্য দিয়েছিল। প্রেমের গল্প পড়তে ও বড়ো ভালোবাসত। যখন আমি বড়ো একাকীত্ব বোধ করতাম, তখন এই বইটি পড়ে আর ওর ছবি দেখে তা দূর করার চেষ্টা করতাম। তারপর ধীরে ধীরে এই একাকীত্বকেই আপন করে ফেললাম। এরপর প্রায় সুদীর্ঘ বছর পার হয়ে যাওয়ার পর একদিন এই দুটো জিনিসকে কলেজের বইপত্তরের সঙ্গে ট্রাঙ্কবন্দি করে রেখে দিলাম।
পুরো ঘটনাটা শুনতে শুনতে আমার দুচোখ বেয়ে অঝোরে অশ্রু ঝরে পড়ছিল। ভালোবাসা এমনও হতে পারে! একজন মানুষ আর একজন মানুষকে ভালোবেসে এভাবে কষ্ট পেতে পারে! না, এমনটা হতে পারে না। ঠাকুরদাকে বলে ছবিটা আমি নিজের কাছে রেখে দিলাম। জানি না তার সেই প্রেয়সী এখন কোথায় থাকেন। নিশ্চয়ই বিয়ে করেছেন। নাতি, নাতনি আছে। দেখি যদি কারও কাছ থেকে তাঁর সম্বন্ধে কিছু জানা যায়। তিনি কোথায় থাকতেন, তা তো আমার জানাই। তবে তা দিয়ে বিশেষ কিছু জানা না গেলে তখন বিকল্প পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। তাছাড়া এমনও হতে পারে তিনি আর এই পৃথিবীতে…. না থাক, এখন ওসব অমঙ্গলের কথা না ভাবাই উচিত।
সোনালিকে আমি ঠাকুরদার জীবনের গল্পটা বললাম। তারপর ও ছবিটা দেখতে চাইলে ওকে দেখালাম। ছবিটা দেখার পর ও কিছুক্ষণ কী যেন চিন্তা করে বলল, “এই রকমের কোনও একটা ছবি আমি বোধহয় এর আগেও কোথাও দেখেছি। কিন্তু এই মুহূর্তে ঠিক মনে পড়ছে না। আচ্ছা, ওঁর সম্পূর্ণ নাম যেন কী?”
আজ আমাদের পরিবারে আনন্দের জোয়ার। পরিবারের সকলে মিলিত হয়েছি। ছোটো ঠাকুরদার জন্মদিন বলে কথা। সকাল থেকে নিজ দায়িত্বে গোটা বাড়িটা সুন্দর করে সাজিয়েছি। ঠাকুরদা যদিও প্রতিবছরের মতোই আজ বেজায় খুশি, তবুও মনে মনে বুঝতে পারছি ভিতরের কষ্টটা সে কিছুতেই বাইরে প্রকাশ করতে চায় না। সত্যি, মানুষটা এমনই যে কখনও ঘুণাক্ষরেও বুঝতে দেয়নি তার একটা কষ্টকর, জীবন নিংড়ে নেওয়া অতীত আছে।
সন্ধেবেলা যথাসময়ে সুন্দর কারুকার্য করা পাঞ্জাবি পায়জামা পরে ঠাকুরদা আমাদের মাঝে উপস্থিত হল। বড়ো হলঘরের মাঝখানে গোল টেবিলের উপর রাখা আছে একটি বড়ো কেক এবং তার উপর উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছে কতগুলো মোমবাতি। আমি ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম ঠাকুরদার কাছে। তারপর বললাম, “কেক কাটার আগে তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।’ ডান হাতটা তুলে সদর দরজার দিকে নির্দেশ করলাম। সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর তার চোখদুটো ছলছল করে উঠল।
সোনালি যে-বৃদ্ধা মহিলাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে, তিনি যে প্রিয়াঙ্কা দিদা, তাতে বিন্দুমাত্রও সন্দেহ নেই। ঠাকুরদার দু’চোখ তা বলে দিচ্ছে। প্রিয়াঙ্কা দিদার দিকে তার এগিয়ে যাওয়া তা বলে দিচ্ছে। অকস্মাৎ ঠাকুরদা তাঁর কাছে গিয়েই জিজ্ঞেস করল, “তুমি এখানে কীভাবে? তোমায় আমি এত বছর পর আবার দেখতে পাব, তা কখনওই ভাবতে পারিনি। কেমন আছো?”
বৃদ্ধা আবেগরুদ্ধ গলায় উত্তর দিল, ‘ভালো আছি। তুমি কেমন আছো? এখনও ঠিক আগের মতোই চনমনে আছো।’
—আমি বেশ ভালোই আছি। দাদুভাই থাকতে আমি কখনও একাকীত্ব বোধ করি না। বিয়ে করিনি। তোমার পরিবারের কেউ আসেনি?
—তোমায় ছাড়া আর কাউকেই যে কোনওদিন ভালোবাসিনি। অভাবের তাড়নায় আমাদের গ্রামের বাড়িতে চলে যেতে হয়েছিল। তাই তোমার সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছিল। আমার এখন দিন কাটে বৃদ্ধাশ্রমে। মা-বাবার মৃত্যুর পর এ শহরে ফিরে আসি। একসময় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের দেখাশোনার কাজ করতাম। এখন সেখানেই পড়ে থাকি। সোনালি মা সেখানে মাঝে মাঝেই যায়। আমার সঙ্গে অনেক কথাও হয়। একদিন ওকে আমার ছেলেবেলার ছবি দেখাই। তারপর আজ হঠাৎ ও আমায় তোমায় দেওয়া সেই ছবিটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে সেই মেয়েটি আমি কিনা। সেজন্যই এত বছর পরে হলেও আমি তোমার খোঁজ পেলাম।’
ঠাকুরদা আমার মনের কথাটাই যেন বলল, ‘এখন তো আমাদের বাধা দেওয়ার কেউ নেই। বাকি জীবনটুকু কি আমরা একসঙ্গে কাটাতে পারি না?’
প্রিয়াঙ্কা দিদা ঠাকুরদার হাতদুটো ধরল। সঙ্গে সঙ্গে গোটা ঘর হাততালিতে ফেটে পড়ল। এতো বড়ো পৃথিবীতে দুটি হারিয়ে যাওয়া মানুষের পুনর্মিলন চট করে হয় না। এটা নিছকই সৌভাগ্য। আজ প্রকৃত ভালোবাসার জয় হয়েছে। দুজন নিঃসঙ্গ মানুষের একাকীত্ব আজ সম্পূর্ণ ভাবে কাটল। এখন থেকে বাকিটা জীবন ওরা একসঙ্গেই অতিবাহিত করতে পারবে। শুধু একটাই আপশোশ, এতগুলো বছর ওরা একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার যন্ত্রণা ভোগ করেছে। তবে সত্যি বলতে কী, ওদের প্রেম কাহিনি আমায় অনেক কিছু শিখিয়েছে। সোনালিকে আমি নতুন করে ভালোবাসতে শিখেছি। আজীবন ওর হাত এমনই শক্ত করে ধরে থাকব।
(সমাপ্ত)