একক মায়েদের কাছে মাতৃত্ব যেমন এক অনন্য অনুভূতির বিষয়, ঠিক তেমনই অভিভাবকত্বও এক ইউনিক চ্যালেঞ্জ বলা যেতে পারে। কারণ, মা যেমন এখানে একাই একশো, ঠিক তেমনই এক্ষেত্রে তাকে সন্তানের পিতার অভাবও পুরণ করতে হচ্ছে। আর এই দায়িত্ব পালনে মা যদি বিফল হন কিংবা দায়িত্ব পালনে ঘাটতি থেকে যায়, তাহলে সন্তান অসহায় বোধ করতে পারে— যা মা এবং সন্তান দু’জনের জন্যই ক্ষতিকারক।
এই আধুনিক যুগে একক মা হওয়া কোনও বিরল ঘটনা হয়তো নয় কিন্তু একক মায়ের যদি কোনও বিষণ্ণ অতীত থাকে, তাহলে সেই বিষণ্ণতা প্রথমে দূর করতে হবে। কারণ, একক মা বিষণ্ণ থাকলে তার কুপ্রভাব পড়বে সন্তানের মস্তিষ্কে। অতএব, সব দুঃখ- যন্ত্রণা ভুলে গিয়ে বাচ্চার সামনে অন্তত হাসিখুশি থাকতে হবে মাকে। শুধু তাই নয়, একক মাকে অনেক বেশি লড়াকু হতে হবে এবং ঝড়-ঝাপটা সামলাতে হবে শক্ত মনে। একক মা কিংবা তার সন্তানকে কেউ যদি ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে, তাহলে তার যোগ্য জবাব দিতে হবে হাসিমুখে এবং এই নিয়ে খুব বেশি বিচলিত কিংবা দুশ্চিন্তায় থাকা চলবে না। সন্তানও যাতে হাসিমুখে ‘ডোন্ট-কেয়ার’ করে চলতে পারে, সেই শিক্ষা দিতে হবে তাকেও।
অবশ্য সমাজ বদলাচ্ছে। মানুষের চিন্তাধারাটাও চিরাচরিত নিয়মের শিকলে আজ আর আবদ্ধ নেই। কিছুটা নিজেদের ইচ্ছেতে এবং আংশিক সময়ের প্রেশারে নিজেদের মানসিকতাকে বদলে নেওয়াই বুদ্ধিমানের রাস্তা বলেই বুঝে গিয়েছেন অনেকে। তাই একক মায়েদেরও বেশি সম্মান দেওয়া শুরু হয়েছে।
একলা চলার নীতি
সন্তানের দায়িত্বে একক মায়ের অবদানের তুলনা চলে না। অতীত বর্তমান উভয়কালেই মা-ই সন্তানের সবথেকে প্রিয় মানুষ। তাই বহু যুগ থেকেই এই ধারণা মানুষের মনে বদ্ধমূল হয়ে গেছে যে, মা-কেই শিশুর পুরো দায়িত্ব নিতে হবে। সমাজের নিয়মটাই এমন রয়েছে যে, সন্তানের দেখভালের দায়িত্ব পুরোপুরি মা-কেই একা সামলাতে হবে— তা সংসার অথবা বাইরে তার যতই কাজ থাকুক না কেন। পরিবারে চার-পাঁচজন সদস্য থাকলেও, এই দায়িত্ব ভাগ করে নিতে প্রায় সকলেই নারাজ। তবে পরিস্থিতি যাই হোক-না কেন, খুশি মনে মায়েরা একাই এই দায়িত্ব নিজেদের উপর তুলে নেন আজও, কারণ তারা মাতৃত্বের সুখ উপভোগ করেন তারিয়ে তারিয়ে।
অতএব, এই বিষয়টি মাথায় রাখলেই একক মায়েদের আর একা পথ চলতে কষ্ট হবে না। তবে এর জন্য মানসিক ভাবে আরও স্ট্রং করতে হবে নিজেকে। যদি পুরোনো কোনও দুঃখ-ব্যথা থাকে, তাহলে তা মন থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করতে হবে সন্তানের মঙ্গলের কথা ভেবে।
উপার্জন বৃদ্ধি করতে হবে
সময়ের সঙ্গে প্রয়োজন হয়েছে অর্থ উপার্জনের। বিশেষ করে একক মায়েদের আরও বেশি আর্থিক নিরাপত্তার প্রয়োজন। তাই সঞ্চয় করতেই হবে। আর সঞ্চয় করতে গেলে আয় বাড়াতে হবে। হয় ভালো বেতনের চাকরি করতে হবে অথবা ভালো ব্যাবসা। সেইসঙ্গে, ব্যাংক-এ ফিক্সড ডিপোজিটে টাকা রেখেও সুদের টাকায় আয় বাড়াতে হবে। শুধু এখানে থেমে থাকলেই চলবে না। যদি নিজের বাড়ি থাকে এবং সেই বাড়ির একটা অংশ ভাড়া দিয়ে আয় বাড়ানো যায়, সেই চেষ্টাও করতে হবে। এছাড়া এখন নানারকম লাভজনক স্কিম চালু হয়েছে ব্যাংক ও পোস্ট অফিসে। তাই আয় বাড়ানোর জন্য ওইসব স্কিম-এর সুযোগ-সুবিধা নিতে হবে। সম্ভব হলে অবসর সময়ে বাড়িতে বসেও যদি কোনও কাজ করে আয় বাড়ানো যায়, সেই চেষ্টা করতে হবে।
টাইম ম্যানেজমেন্ট জরুরি
একা দায়িত্ব পালন মানেই চরম ব্যস্ততা। সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত পরিশ্রম করতে হবে। কিন্তু বেশি পরিশ্রম করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লেই বিপদ। তাই টাইম ম্যানেজমেন্ট জরুরি। কখন কোন কাজ কীভাবে করবেন, কোন কাজটা জরুরি আর কোনটা না করলেও চলে— তা ভেবে নিয়ে এগোতে হবে। প্রতিদিন ঘুমোতে যাওয়ার আগে ভেবে ঠিক করে রাখুন পরের দিন সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত কী কী করতে হবে এবং সেই হিসাবে একটা লিস্ট করে রাখুন। সারা সপ্তাহের পেন্ডিং কাজ ছুটির দিনের একটা সময় করে নিয়ে চিন্তামুক্ত থাকার চেষ্টা করুন।
বন্ধুর মতো ব্যবহার করুন
একক মায়েদের সন্তানরা একটু বেশি অভিমানী হয়ে থাকে। হয়তো সে তার অভিমান কিংবা দুঃখগুলো সবসময় প্রকাশ করে না মা কষ্ট পাবে বলে, কিন্তু মনে মনে কষ্ট পায়। তাই সন্তান যাতে তার বেশিরভাগ অভাব অভিযোগ আপনার কাছে শেয়ার করে, সেই পরিবেশ তৈরি করে রাখুন। সন্তানের সঙ্গে বন্ধুর মতো আচরণ করুন। নিজের কাজের ব্যস্ততার মধ্যেও যতটা সম্ভব কোয়ালিটি টাইম দিন সন্তানকে। ছুটি পেলে কাছেপিঠে কোথাও বেড়াতে নিয়ে যান ওকে। শুধু তাই নয়, ওর প্রিয় বন্ধুদের মাঝেমধ্যে আপনার বাড়িতে ডেকে এনে হইহুল্লোড় করার সুযোগ করে দিন।
মনের জোর বাড়ান
আপনি যখনই একক মা হওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তখন থেকেই আপনাকে মনের জোর বাড়াতে হবে। ভাবতে হবে আপনি একা নন, আপনার মতো আরও অনেকেই ‘সিংগল মাদার’। অতএব সবকিছু হাসিমুখে সামলে ওঠার সংকল্প করুন। এক্ষেত্রে মনে রাখবেন, সাধারণ মহিলা থেকে সেলিব্রিটি, অনেকেই এখন একক মা হিসাবে রীতিমতো সফল। শ্বেতা তিওয়ারি, দলজিৎ কউর থেকে শুরু করে অনেকেই উপভোগ করছেন একক মাতৃত্ব। অতএব আপনিও নাম লেখান এই সাফল্যের তালিকায়।
দায়িত্ব পালনের কিছু বিকল্প রাস্তা
এখন একক মায়েদের জন্য অনেক সুযোগ সুবিধাও হয়েছে। চাইলে আপনিও নিতে পারেন এই সুবিধাগুলো। এই যেমন— দেশ, ডে-বোর্ডিং স্কুল তৈরি হয়েছে, যেখানে বাচ্চাদের সারাদিন দেখাশোনা করা হয়। এ এক অনন্য বিকল্প।
ক্রেশ: বেশ কিছু বছর হল এ দেশেও ক্রেশ-এর কনসেপ্ট শুরু হয়েছে। সুতরাং মায়েরা ক্রেশে নিজের বাচ্চাকে নির্দ্বিধায় রেখে যেতে পারেন। কারণ ক্রেশ-এ বাচ্চাদের সারাদিনের দেখাশোনা করার সুব্যবস্থা থাকে। অর্থের বিনিময়ে এই পরিষেবা দেওয়া হয়। সংখ্যায় কম হলেও বর্তমানে এদেশে সরকারি ও বেসরকারি কিছু অফিসে নিজস্ব ক্রেশ আছে। এখানকার কর্মরতা মহিলারা নিজেদের সন্তানকে সারাদিন সেখানে রেখে কাজ করার সুবিধা পান। আবার আসার সময় সন্তানকে সঙ্গে করে বাড়ি নিয়ে চলে আসেন।
সাধারণত ক্রেশগুলিতে ২ মাস বয়স থেকেই বাচ্চাদের দেখাশোনা করার ব্যবস্থা থাকে। সদ্য মায়েরা অফিসে ৩-৪ মাসের বেশি ছুটি পান না। সুতরাং তারপর থেকেই তাদের ক্রেশের খোঁজ করা শুরু করে দিতে হয়। ক্রেশ খোলাটাও একটা কেরিয়ার অপশনে দাঁড়িয়ে গেছে। প্রতিটি বড়ো শহরে, এমনকী মফসসলেও ক্রেশের রমরমা এখন লক্ষণীয়।
ডে-বোর্ডিং স্কুল: ক্রেশের অনেক পরে ডে-বোর্ডিং স্কুলের কনসেপ্ট এসেছে। ডে-বোর্ডিং-এ ৩ বছরের বেশি বয়সের বাচ্চাদের নেওয়া হয়ে থাকে। বোর্ডিং স্কুলের সুবিধা হল, ক্রেশে যেখানে বাচ্চাদের খালি দেখাশোনাই করা হয়, বোর্ডিং স্কুলে দেখাশোনার সঙ্গে সঙ্গে পড়াশোনাও করানো হয় এবং সেইসঙ্গে ডিসিপ্লিন-ও শেখানো হয়। খেলাধুলো, গঠনমূলক কাজও তাদের শেখানো হয়। অনেক সময় বোর্ডিং স্কুলে যা-যা শেখানো হয়, স্কুলে ভর্তি হতে গেলে সেগুলি থেকে প্রচুর সাহায্যও পাওয়া যায়। অনেক জায়গায় বড়ো স্কুলগুলোর সঙ্গেই ডে-বোর্ডিং ফেসিলিটি দেওয়া হয়।
স্কুলে পড়াশোনার পর ছুটি হয়ে গেলে বোর্ডিং-এ ব্যবস্থা থাকে খাওয়াদাওয়া, বিশ্রামের। তারপর স্কুলের সমস্ত হোমওয়ার্ক, পড়াশোনা ওখানেই করিয়ে দেওয়া হয়, যাতে বাচ্চাদের বাড়ি এসে আর কিছু পড়াশোনা করতে না হয়। অফিস ছুটি হলে মায়ের সঙ্গেই বাচ্চা বাড়ি চলে আসতে পারে অথবা বোর্ডিং স্কুল থেকেই তাদের নিজস্ব গাড়িতে বাচ্চাদের বাড়ি পাঠাবার ব্যবস্থা থাকে। এক্ষেত্রে বাড়িতে বাচ্চাকে পড়াশোনা করাবার দায়িত্ব থেকেও মা মুক্ত হতে পারেন। তবে ডে-বোর্ডিং-এ রাখতে হলে আর্থিক সঙ্গতি থাকা প্রয়োজন। কারণ অর্থের পরিমাণ ডে-বোর্ডিং-এর ক্ষেত্রে একটু বেশি।
আপনজনের দায়িত্বে বাচ্চাকে রাখা: সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে, পরিবার পরিজনও এগিয়ে আসছেন একক মায়েদের সমস্যা হ্রাস করার জন্যে। মেয়েদের বাপেরবাড়ির লোকেরা এখন অনেক বেশি সচেতন, যাতে বাড়ির মেয়ে নিশ্চিন্তে কর্মস্থানের কর্তব্য পালন করতে পারে। সন্তান নিয়ে অযথা তাকে দুশ্চিন্তা না করতে হয়। তারা তৎপর থাকেন নাতি-নাতনিকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য। স্কুলের সময় হলে স্কুলবাস না এলে স্কুল পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসা, নিয়ে আসা, জলখাবার খাইয়ে অল্প বিশ্রামের পর পড়তে বসানো— এসব দায়িত্ব এখন অনেক দাদু-দিদা পালন করছেন। বাপের বাড়ি কাছাকাছি হলে মেয়ের মায়েরা এসে বাচ্চার সারাদিনের দেখাশোনা করছেন। চাকুরিরতা মায়েরাও সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত থেকে বাইরের কাজে মন দিতে পারছেন, কারণ বাপের বাড়ির আপনজনের কাছেই বাচ্চারা সুরক্ষিত রয়েছে।
সুতরাং ক্রেশ, ডে-বোর্ডিং স্কুল এবং নিজের মায়ের বাড়ির সদস্যরা এখন একক মায়েদের সাহায্যে এগিয়ে আসছেন। কিন্তু প্রথম দুটো জায়গায় বাচ্চাকে রাখতে হলে নিজেকে মানসিক ভাবে প্রস্তুত করতে হবে এবং বাচ্চাকেও বোঝাতে হবে যে, নিজেদের থেকে দূরে রাখা মানে তাকে একলা ছেড়ে দেওয়া— এমন নয়। বাচ্চা যদি একবার ভেবে নেয় মা তাকে ভালোবাসে না বলেই ক্রেশ বা বোর্ডিং-এ দিয়েছে, তাহলে সমস্যা কমার বদলে বাচ্চার পক্ষে এই ভাবনা ক্ষতিকারক হয়ে দাঁড়াবে।
সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে:
বাচ্চাকে দেওয়ার আগে ক্রেশের খোঁজখবর নিন। সেখানে গিয়ে বাচ্চা সুস্থ ও সুরক্ষিত থাকবে নিশ্চিত হলে তবেই ক্রেশে দিন। ক্রেশের মালিকের মোবাইল নম্বর নিয়ে রাখুন এবং নিজের নম্বর তাকে দিন। ক্রেশে যে-মহিলা কাজ করেন তিনি কেমন খোঁজখবর নিন।
বাচ্চার কোনও অসুস্থতা থাকলে ক্রেশের সঞ্চালক-কে আগে থেকেই জানিয়ে রাখুন।
ঠিক সময় বাচ্চাকে ক্রেশে ছাড়ুন। চেষ্টা করুন যতটা কম সময় বাচ্চাকে ক্রেশে রাখা যেতে পারে। বাচ্চার পছন্দের খাবার তার সঙ্গে দিয়ে দিন।
সারাদিনে ফোনে অন্তত কয়েকবার বাচ্চার খবরাখবর নিন। বোর্ডিং স্কুলও দেখেশুনে বাছুন।
ক্রেশ-এ বাচ্চাকে রাখতে বাধ্য হলেও, নিজের কাছে বাচ্চাকে যতক্ষণ রাখবে মাতৃস্নেহে ভরিয়ে তুলুন যাতে আপনাকে না-পাওয়ার কষ্ট তার মনে না থাকে।
অসুস্থ অবস্থায় বাচ্চাকে ক্রেশে পাঠাবেন না।
ক্রেশে আপনার বাচ্চার ঠিকমতো দেখাশোনা হচ্ছে কিনা চেক করতে মাঝেমধ্যে ক্রেশে যান।