সকাল থেকে বৃষ্টি বন্ধ হওয়ার নাম নেই। একতা কী করবে বুঝতে পারছিল না। স্বামী প্রতীক-কে ঘরে ঢুকতে দেখে বলল, ‘আমাকে প্লিজ একটু শোভাবাজারে সৎসঙ্গ ভবনে ছেড়ে দেবে? এত বৃষ্টি পড়ছে যে গাড়ি ছাড়া বেরোবার উপায় নেই!’
প্রতীক একতার কথায় একটু অবাক হল। জিজ্ঞেস করল, ‘সৎসঙ্গ? তুমি কবে থেকে আবার সৎসঙ্গ, প্রবচন — এসবে যাওয়া আরম্ভ করেছ? আমি দু’বছর ধরে যে একতাকে জানি সে তো জিম, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে কিটি পার্টি— এসব করতেই ভালোবাসে। স্বামীর প্রিয়া হয়ে তার সারাদিনের ক্লান্তি দূর করে! সৎসঙ্গে কবে থেকে তোমার আগ্রহ জন্মাল? বাড়িতে বসে থাকতে যদি ভালো না লাগে, আমার সঙ্গে অফিস গিয়ে পুরোনো কাজ আবার নতুন করে সামলানো আরম্ভ করতে পারো। আমার তাতে আনন্দ হবে। এই সব সৎসঙ্গ সাধু-সন্ন্যাসীর চক্কর ছাড়ো।’
একতার গালে একটা চুম্বন এঁকে অফিসের ব্যাগটা হাতে নিয়ে দরজার দিকে এগোতে এগোতে প্রতীক বলল, ‘সন্ধেবেলায় ফিরে এসে তোমার হাতের মশলা চা আর গরম পকোড়া খাবো।’
প্রতীক বেরিয়ে যেতেই, একতা মেসেজ করে বান্ধবী রিক্তাকে জানিয়ে দিল যে, ও আজ সৎসঙ্গ যেতে পারবে না। আশাহত হয়ে বাইরের জামাকাপড় বদলে একতা খবরের কাগজটা হাতে করে বিছানায় এসে বসল। খবরের কাগজের পাতা ওলটাতে ওলটাতে নিজের পুরোনো দিনের কথাও মনে পড়তে আরম্ভ করল। দু’বছর আগে প্রতীকের সঙ্গে ওর বিয়ে হয় এবং প্রতীককে পেয়ে যেন ওর স্বপ্ন সত্যি হয়েছে। প্রতীক সেক্টর ফাইভে একটি মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে অফিসার র্যাংকে কাজ করত আর একতা সেখানে এইচআর-এর কর্মী ছিল। প্রতীককে দেখতে সাধারণ হলেও ওর মধ্যে অনেক গুণ ছিল।
একতার চেহারা এবং সৌন্দর্য অপরকে খুব সহজেই আকর্ষণ করত। ফরসা রং, নীল চোখের মায়াবী দৃষ্টির মোহ সহজে কেউ এড়াতে পারত না। প্রতীকের সঙ্গে আলাপ হতেই দু’জনের মধ্যে একটা রসায়ন কাজ শুরু করে। আলাপ, তার পরেই প্রেম এবং কিছুদিনের মধ্যে উভয়ের পারিবারিক সম্মতিতে বিয়ের পিঁড়িতে বসা।
প্রতীকের মতো স্মার্ট, বুদ্ধিমান ছেলেকে স্বামী হিসেবে পেয়ে একতার জীবন সার্থক হয়ে গিয়েছিল। একতা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। বাবা খুবই সাধারণ চাকরি করতেন একটি মারোয়াড়ি ফার্মে। বাড়িতে মা-বাবা ছাড়াও দাদা বউদি ছিলেন। স্নাতক হওয়ার পর একতা অফিস ম্যানেজমেন্টে ডিপ্লোমা করে এইচআর-এর চাকরিটা পেয়েছিল।
প্রতীকও মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। ওরা তিন ভাই। বড়ো দাদা শেয়ার কেনা-বেচা করে সেরকম একটি ছোটো কোম্পানিতে চাকরি করতেন আর ছোটো ভাই ব্যাংকের অফিসার ছিল। ওর যখন বিয়ে হয় মা-বাবা কেউই বেঁচে নেই। বিয়ের আগে ভাইদের সঙ্গে প্রতীক সন্তোষপুরে নিজেদের বাড়িতেই থাকত। একতার সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর লেকটাউনে একটি দু-কামরার ফ্ল্যাট ভাড়া করে চলে আসে।
বিয়ের পর একতা যথেষ্ট সুখী ছিল। প্রতীক ভালো রোজগার করত উপরন্তু প্রতীকের একটা বড়ো গুণ ছিল সে কখনও সম্পর্কের মধ্যে নিজের পদ বা টাকা পয়সার অহংকারকে আসতে দিত না। ধনী, গরিব সব ধরনের ব্যক্তিকেই ও সমান সম্মান দিত।
একতা ভেবেছিল, বিয়ের পর প্রতীক ওকে আর চাকরি করতে দেবে না। কারণ অফিসারের বউ হলে ওর অধীনস্থ কর্মচারীদের সঙ্গে একতার কাজ করাটা হয়তো প্রতীকের পছন্দ না-ও হতে পারে। কিন্তু প্রতীক একতাকে চাকরি ছাড়তেও বলেনি এবং অফিসে একতার প্রতি ব্যবহার ওর আগের মতোই ছিল।
এক বছরের মধ্যেই একতা সন্তানসম্ভবা হলে ওর শরীর খারাপ থাকতে আরম্ভ করল। হাই ব্লাড প্রেশার থাকার দরুন একতা চাকরি ছাড়তে বাধ্য হল। বাড়িতে সবসময়ের কাজের লোক আগে থেকেই ছিল, ফলে একতার সময় বেশিরভাগই ফেসবুক আর হোয়াট্স অ্যাপ করেই কেটে যাচ্ছিল। তবুও ওর শরীর ঠিক হচ্ছে না দেখে প্রতীক ওকে ডাক্তার দেখাবার জন্য জোর দিতে লাগল। কিন্তু একতা হোয়াট্স অ্যাপ গ্রুপে দেওয়া ঘরোয়া টোটকাই মানতে শুরু করল।
এর ফলে একতার শরীর আরও খারাপ হতে লাগল। একদিন জোর করেই প্রতীক ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। ডাক্তারের কথামতো চলাতে শরীর কিছুটা ঠিক হলেও, সময়ের আগেই ওর ডেলিভারি করাতে হল এবং বাচ্চাটিকেও বাঁচানো সম্ভবপর হল না। একাকিত্ব পেয়ে বসল একতাকে। একতার অবস্থা দেখে প্রতীক ওকে আবার কাজে জয়েন করতে বললেও, একতা কিছুতেই রাজি হল না।
প্রতিবেশী রুপালি, একতার সোসাইটির মহিলাদের গ্রুপে একরকম জোর করেই জয়েন করাল যাতে ওর একাকিত্ব কিছুটা হলেও কাটে। গ্রুপে সকলেই শিক্ষিত, ফলে একতারও ওদের সঙ্গে ভালোই সময় কাটত। গ্রুপ ডিসকাশন, পার্টি, পিকনিকে যাওয়া, একসঙ্গে মিলে কোথাও বেড়াতে যাওয়া। এসবের সঙ্গে শম্ভুনাথ নামে এক বাবাজির সৎসঙ্গেও গ্রুপের সদস্যরা একত্রিত হতো। পুরাণের নানা গল্প শোনাতেন বাবাজি যার থেকে মানসিক শান্তির খোঁজ পাওয়া যেতে পারে। এছাড়াও বাবাজির কথা, ‘শান্তির খোঁজ পেতে হলে দানধ্যান করাটা সবথেকে ভালো উপায়’ –এমনটাই সকলের মনে গেঁথে গিয়েছিল। অন্যান্যদের মতো একতাও ভাবতে শুরু করেছিল যে সামর্থ্য অনুযায়ী কিছু অর্থ শম্ভুনাথজিকে দান করলে জীবন সফল হয়ে যাবে, হারিয়ে যাওয়া খুশি আবার ফিরে আসবে।