কলকাতা থেকে দিদি-জামাইবাবু এসেছেন আমাদের বাড়িতে। কথা চলছে আশেপাশে কোথাও ঘুরতে যাবার। পুণের আশেপাশে ঘোরার জায়গা অনেক। তার উপর বর্ষাকালে এই অঞ্চলে প্রকৃতি ময়ূরের মতো পেখম তুলে আহ্বান করে তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মদিরায় অবগাহন করতে। দু’চোখ ভরে কুড়িয়ে নাও ঘন সবুজে ভরা বনানীর স্নিগ্ধ রূপ কিংবা কলকল করে পাথর বেয়ে দুরন্ত গতিতে নেমে আসা জলের নিরুপায় অধোগতি। এই সময়টাতে ঘুরতে যাওয়ার কথা উঠলে, খুব অসুবিধা ‘না’ থাকলে না করি না।
জামাইবাবু বললেন, ‘কোনও ভিড়ভাট্টার জায়গা নয়, শান্ত নিরিবিলি জায়গা চাই, তা সেটা পাহাড় হোক বা সমুদ্র।” আমি বললাম, “ঠিক আছে, সব পেয়েছির দেশে নিয়ে যাচ্ছি আপনাকে।’ কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা মুখ করে জিজ্ঞেস করলেন, “তার মানে!” আমি উত্তর দিলাম, ‘যেখানে নিয়ে যাব, সেখানে সব পাবেন — নিরিবিলি পরিবেশ, পাহাড়, সমুদ্র ও থাকা খাওয়ার ভালো জায়গা।”
পরিকল্পনা মতো সকাল সকাল ওয়াগনারে চেপে আমরা চারজন দু’দিনের জন্য আমাদের এনআইবিএমের বাড়ি থেকে যাত্রা শুরু করলাম, গন্তব্যস্থল পুণে থেকে ১৭৯ কিমি দূরে আলিবাগের কাছে কাশিদ বিচ। প্রথমে পুণে শহরের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত কাটরাজ থেকে মুম্বই-বেঙ্গালুরু হাইওয়ে ধরে ওখান থেকে ২২ কিমি দূরে কিওয়ালেতে বাঁদিকে গাড়ি ঘুরিয়ে পুণে-মুম্বই এক্সপ্রেসওয়ে-র উপর দিয়ে চলল আমাদের গাড়ি।
হাইওয়েতে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টি শুরু। পুণেতে নিঃশব্দ বৃষ্টি, অর্থাৎ সাহিত্যের পরিভাষায় যাকে আমরা ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি বলি, খুব হয়। তাড়াহুড়ো করে বাড়ির বাইরে এসে উপলব্ধি হয় বৃষ্টি হচ্ছে, বা বাইক চালাতে চালাতে হঠাৎ হাত ভিজিয়ে দিয়ে জানান দেয় আমি এসেছি। গাড়ির উইন্ডস্ক্রিন ভেদ করে বাইরের দৃশ্যটা আবছা হতেই বুঝলাম বৃষ্টি শুরু।
আমরা চলেছি পুরো পুণে শহরটাকে ডানপাশে রেখে। কিওয়ালে বা রাভেত অবধি হাইওয়ের দুপাশে একরূপ, আর কিওয়ালের পরে হঠাৎ করে দৃশ্যপটের আমূল পরিবর্তন হয়। তখন আশপাশের পাথুরে সমতলভূমি, তার সঙ্গে কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্ত ভাবে দাঁড়িয়ে আছে অনুচ্চ পাহাড়। কিওয়ালে পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশের দৃশ্য আধুনিক স্থাপত্যের সৌজন্যে চোখ ঝলসানো। দু’পাশে সারি সারি হাই রাইজ বিল্ডিং। সুসজ্জিত শহুরে অঞ্চল। যেখান দিয়ে যাচ্ছি সেটা পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরি হয়েছে। সেই রাস্তা ধরে কখনও এঁকেবেঁকে আবার কখনও বা উঁচু-নিচু পথে চলেছি আমরা।
পুণে-মুম্বই এক্সপ্রেসওয়েতে আমরাও ঢুকলাম আর বৃষ্টির প্রকোপ বাড়ল। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছে। দিগন্তব্যাপি মাঠের উপর বৃষ্টির জল সশব্দে আছড়ে পড়ছে। দিদির কাছে এই দৃশ্য অচেনা হওয়ায় সে বলল, ‘দারুণ অভিজ্ঞতা।” বললাম, ‘সবুর কর, এখনও সেরকম কিছু আসেনি।’
গাড়ির গতি কমে গেছে, কারণ জলের তোড়ে সামনের প্রেক্ষাপট ঝাপসা হয়ে গেছে। বেশ কিছুটা এগোনোর পর পাহাড়ি ঘাঁটি এল। বর্ষার জলের পরশে রাস্তার ধারে ঘাঁটির পাথুরে দেয়ালে সবুজ শ্যাওলা জমেছে, জন্ম নিয়েছে অজস্র ফার্ণ ও রকমারি গুল্ম। তার মধ্যে কোথাও কোথাও নীল সবুজ ছোটো ছোটো ফুলও ফুটেছে।
খোপলি আসার আগে বাঁদিকে আলিবাগের জন্য নির্দিষ্ট রাস্তা ধরলাম। ততক্ষণে বৃষ্টি একটু কমেছে। ছোটো একটা চড়াই পাহাড়ের রাস্তা পার করে যেতে হবে পাহাড়ের অন্যদিকে। যেখানে এসে নামলাম জায়গাটির প্রাকৃতিক পরিবেশ ঝুলনে সাজানো গ্রামের মতো। রাস্তার দু-পাশে ঘাস বিছানো উঁচু-নিচু সবুজ উপত্যকা। বাঁদিকে ছোটো পাহাড়ের ধাপ বেয়ে নেমে আসছে জলপ্রপাত। এই অঞ্চলে এইরকম অনেক জলপ্রপাত এইসময় সৃষ্টি হয়। ডানদিকে রাস্তা থেকে ৫০ মিটার দূরে দেখা গেল একটা চায়ের দোকান। এখানে সবাই মিলে চা পান করলাম। চারিদিকে তাকিয়ে দেখলাম আর কোনও দোকান আশেপাশে নেই।
বাঁশের মাচার উপর টিনের চালের আশ্রয়ে ত্রিপল ও পলিথিনের শিটে ঘেরা একটি পরিবারের উপার্জন স্থল। সকালবেলা বেরোনোর ফলে জলখাবার ঠিকমতো খাওয়া হয়নি। সবার পেটেই খিদে চাগাড় দিচ্ছে। দোকানটিতে খাবার বলতে আছে আলুর চপ ও পাউরুটি। এখানকার ভাষায় বড়া পাও, মহারাষ্ট্রের সবচেয়ে জনপ্রিয় জলখাবার। এই খাবারটির চারিত্রিক বিশ্লেষণ করলে এরকম দাঁড়ায়, ‘তাড়াতাড়ি বানাও তাড়াহুড়োয় খাও’। গরম গরম বড়া পাও ও চা, বৃষ্টির মধ্যে প্রায় নির্জন পাহাড়ি ভূমিতে মন্দ নয়। সকালবেলায় বৃষ্টি-বাদলের দিনে আমরাই ছিলাম দোকানের একমাত্র খন্দের।
দোকানির বাচ্চা মেয়েটা আমাদের মুখে নতুন ভাষা শুনে হাঁ করে আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে গেল। আমার স্ত্রী-র ব্যাগে চকোলেট মজুদ থাকে। মেয়েটির হাতে চকোলেট তুলে দিতেই ফোকলা দাঁতে একগাল হাসি দিল। এরই সঙ্গে কিছু ছবি তোলা হল। সবুজে মোড়া ব্যাকগ্রাউন্ডে মেয়েটির ফটো ভালোই উঠল। ওখান থেকে বেরিয়ে আমরা যে রাস্তায় উঠলাম, তার দু’ধারে দাঁড়িয়ে আছে লম্বা লম্বা পলাশ, কৃষ্ণচূড়া, পাইন ও নারকেল গাছ। রয়েছে নাম না জানা আরও অনেক জংলি গাছ।
বৃষ্টিপাত বেশি হওয়ার দরুন পার্বত্য অঞ্চলগুলি গাছে গাছে ভরে জঙ্গলের রূপ নেয়। জঙ্গলের ভিতর থেকে বিভিন্ন প্রকারের পাখির ডাকের মিশ্রণে এক বিচিত্র আওয়াজ ভেসে আসছিল। একেবারে ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলেছি আমরা। কিছুটা গা ছমছম করা পরিবেশ। ততক্ষণে বৃষ্টি থেমে সূর্যিমামা উঁকি দিয়েছেন। উঁচু গাছের আড়ালে সেই আলো ফাঁক ফোকর গলে রাস্তায় অল্প-স্বল্প এসে পড়ছে। ওইখান থেকে বেরিয়ে কিছু দূর যাওয়ার পর এল ছোট্ট শহর পেন। পেন আলিবাগ ও কাশিদের মাঝখানে মিলন সেতু। এখান থেকে বাঁদিকে গাড়ি ঘোরালে শুরু মুরদ-আলিবাগ রোড। মুরদ যাওয়ার পথেই পড়ে কাশিদ বিচ।