কাশিদ বিচের দিকে এগিয়ে চললাম আমরা। মসৃণ রাস্তা, গাড়ি যেন গালিচা বিছানো পথে গড়িয়ে চলেছে। সমুদ্র ও পাহাড়ের মাঝখানে আঁকাবাঁকা এক মনোরম যাত্রাপথ। ১৬-১৭ কিমি যাওয়ার পরে এল কাশিদ বিচ। বিচ দেখে কপালে হাত। গিজগিজ করছে মানুষ। আমাদের মতোই অনেকে চলে এসেছে। বলা হয়নি আগে, কাশিদ জায়গাটা মুম্বই থেকে কাছে। সড়ক পথে আসা যায়, জলপথেও আসা যায়।

‘গেট ওয়ে অফ ইন্ডিয়া’ থেকে আলিবাগ ফেরি সার্ভিস আছে। ১ ঘণ্টা ৩০ মিনিট লাগে আলিবাগ পৌঁছোতে। আর সড়ক পথে মুম্বই থেকে আলিবাগ আসতে লাগে তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা। সেখান থেকে কাশিদ সড়ক পথে ৩০ কিমি। কাশিদ বিচ বেশ বড়ো, প্রায় ৩ কিমি ব্যাপি। আমরা যে রাস্তা ধরে পুণে থেকে কাশিদ এসেছি তাতে লাগে সাধারণত পাঁচ-সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা। আরেকটা রাস্তা আছে, মুলসী, তামানী ঘাট ও পাউদ হয়ে। তাতে পাহাড় ও পাহাড় সংলগ্ন জলাশয়ের নৈসর্গিক সৌন্দর্য খুব ভালো দেখা যায়। কিন্তু রাস্তা সব জায়গায় এতটা মসৃণ নয় এবং বেশ নির্জন। অ্যাডভেঞ্চার এনজয় করতে হলে এই রাস্তার নির্বাচন সমর্থন করা যেতে পারে। তবে সঙ্গে যথেষ্ট জল ও খাবারদাবার নিতে হবে।

কাশিদ বিচ থেকে একটু এগোলেই সমুদ্র রাস্তার থেকে দূরে সরে গেছে। রাস্তার দু’ধারে হোটেল। পূর্বদিকে পাহাড়ি এলাকা আর পশ্চিমদিকে সমুদ্র। ফলে পশ্চিমদিকের হোটেলগুলি সি-ফেসিং বলে চার্জ বেশি। মনমতো হোটেলে জায়গা নেই আর যেগুলোতে জায়গা আছে সেগুলো মনমতো নয়। রাস্তার মোড়ে কিছু অল্প বয়সি ছেলে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছিল। জানতে চাইলাম আশেপাশে ভালো হোটেল আছে কিনা ? বলল, ‘দেখুন আপনাদের কাছে যখন গাড়ি আছে, আরেকটু এগিয়ে যান নতুন নতুন কিছু ভালো হোটেল খুলেছে, খাওয়া দাওয়ারও কোনও অসুবিধা নেই। সমুদ্রকে খুব ভালো ভাবে দেখতে পাবেন। বাতাবরণ অপেক্ষাকৃত শান্ত।’

ওদের কথামতো সমুদ্রের তীর ধরে গাড়ি চালিয়ে এগোলাম। কিছু দূর পৌঁছে দেখি সত্যি সত্যি জায়গাটা শান্ত বাতাবরণে এক ছিমছাম পরিবেশ। যে হোটেল পছন্দ হল তাতে পরিবেশ একদম ঘরোয়া। ঢুকতেই রিসেপশন, রিসেপশনের পরে চৌকো বাগান আর বাগানের মাঝখান দিয়ে এক ফালি রাস্তা, রাস্তা শেষ হয়েছে লজিং বিল্ডিং-এ গিয়ে। ঘরে ঢুকে মন ভরে গেল। যতটুকু চেয়েছিলাম, যেরকম চেয়েছিলাম পরিবেশ, পাওয়া গেছে বারো আনা। বাকি রইল দু-আনা রসনা তৃপ্তির জন্য আর বাকি দু-আনা হোটেলে সেবা কীরকম জোটে তার জন্য। হোটেলে দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে এক ঘুমে বিকেল। হোটেলটার খাবারে স্বাদ আছে। রান্নায় একটু কোঙ্কনি স্বাদের ছোঁয়া।

বিকেলে গাড়িতে করে মেইন বিচে পৌঁছোলাম। বিকেলের দিকে জল বেড়ে যায়। স্নানের প্রশ্ন আসে না। নোনা জলে স্নান করার আনন্দ নিতে হলে সকালের দিকে বিচে নেমে পড়তে হবে, জল কম থাকে। জামাকাপড় বদলাবার উপযুক্ত ঘর বানানো আছে। এছাড়া কম খরচে ওয়াটার স্পোর্টসের আনন্দ নেওয়া যায়। বিচের ধারে অজস্র ছোটো ছোটো টুকিটাকি খাবারের দোকান। ভেল, বড়া পাও, ফুচকা, আলু টিকি চাট, আখের রস, কোল্ড ড্রিংকস, এমনকী আগুনে সেঁকা ভুট্টাও পাওয়া যাচ্ছে। ফিরে এসে সন্ধ্যাবেলায় ব্যালকনিতে বসে জমিয়ে আড্ডা হল। ফুরফুরে বাতাস বইছে।

মাঝ রাত থেকে আবার বৃষ্টি নামল। পরের দিন সকালেও থামার লক্ষণ নেই। দিনটা হোটেলে বসে নষ্ট করা আমাদের একদম মনঃপুত নয়। গাড়িতে দুটি ছাতা রাখাই থাকে, আমরা চারজনে হোটেল থেকে বেরিয়ে রাস্তা পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম সমুদ্র কিনারে। ঢোকার পথে শাখাপ্রশাখা মেলে দাঁড়িয়ে আছে এক কৃষ্ণচূড়া গাছ, তার ফুলের রং গোলাপি। খুব কম দেখা যায় এই রঙের কৃষ্ণচূড়া। ঝোড়ো হাওয়ার দাপটে পুরো রাস্তা গোলাপি রঙে রাঙিয়ে গেছে। এদিকটাতে লোকজন খুব একটা আসে না।

সমুদ্র কিনারে কিছু পরিত্যক্ত টিনের চালার ঘর। খালি চালটুকু টিকে থেকে স্মৃতি বহন করছে। ওর নীচে চারজন গিয়ে বসলাম। কলকাতায় আমাদের পাড়ার খেলার মাঠের পাশে এরকমই একটা পরিত্যক্ত ঘর ছিল। বৃষ্টি নামলে ওর চালের নীচে এসে আমরা আশ্রয় নিতাম। ছোটোবেলার স্মৃতি রোমন্থন হয়ে গেল। সমুদ্রর উত্তাল রূপ, তার সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া, এরও একটা আমেজ আছে। ওখানে জমিয়ে আড্ডা বসল৷

আড়াআড়ি ভাবে চোখে পড়ল অনতিদূরে একটু বাঁক খেয়ে সমুদ্র ৪৫ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে ঘুরে গেছে। আর তার পাড়ে সাজানো গোছানো বসতি। সারি সারি নারকেল গাছ। তার মধ্যে দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারছে সুদৃশ্য এক কাঠের দোতলা বাড়ি। চারজনে হাঁটা দিলাম সেই বসতির উদ্দেশ্যে। কিছুটা এগোতেই গতিরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম এক পাঁচিলে ঘেরা ভাঙাচোরা গেটের সামনে। ভিতরে ঢুকতেই দারোয়ান এগিয়ে এল। এটা কোনও এক শিল্পপতির অবকাশযাপনের ঠিকানা। ভিতরে প্রবেশ নিষেধ। জায়গাটার সৌন্দর্য দেখে আমরা মোহিত। অনেক অনুরোধ করার পর কিছুটা সময় থাকতে দিল।

বৃষ্টি ততক্ষণে থেমে গেছে। ওখান থেকে ফিরতে ফিরতে বেলা দুটো বেজে গেল। হোটেলে ফিরে খেয়েদেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে এবার ফেরার পালা।

জামাইবাবুকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কীরকম লাগল?” জবাব পেলাম, ‘সব পেয়েছি!”

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...