সেই প্রাচীনকাল থেকে আজও, যখন কোনও বিশেষ নারীগোষ্ঠীর সৌন্দর্য চেতনাবোধ, নিজেকে তার প্রিয় পুরুষের কাছে সর্বদা সুন্দর রাখার প্রচেষ্টা কোনও ঐতিহ্যগত শিল্প-সংস্কৃতি কিংবা একান্ত আবেগের সঙ্গে জুড়ে যায়, তখন একটু আকর্ষণ করতে হয় বৈকি। এমনই এক সম্প্রদায়, কায়ান জাতিগোষ্ঠী অর্থাৎ পাদাউং জনগোষ্ঠীর নারীদের খোঁজে নিজেকে সমৃদ্ধ করতে হাজির হয়েছিলাম উত্তর থাইল্যান্ডের গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল সীমান্ত এলাকার চিয়াং রাই প্রদেশের একটা দুর্গম পার্বত্য গ্রামে।
থাই এয়ারওয়েজের বিমান যখন উত্তর থাইল্যান্ডের চিয়াং মাই জাতীয় বিমানবন্দরে ল্যান্ড করল, ঘড়িতে তখন স্থানীয় সময় দুপুর ১টা বেজে দশ মিনিট। জীবনের বহু প্রতীক্ষিত সোলো ট্রাভেল অর্থাৎ একক বিদেশ ভ্রমণ শুরু হওয়ার আনন্দ অনুভব করে এক অনাবিল প্রশান্তিতে ভরে উঠল আমার মন।
ক্যারোসেল থেকে লাগেজ নিয়েই ওখানকার বহুল প্রচলিত গ্র্যাব অ্যাপ চেক করে দেখলাম, এয়ারপোর্ট থেকে মাত্র পাঁচ কিমির দূরত্বের হোটেলে পৌঁছোনোর জন্য ক্যাব চাইছে ২০০ ভাট অর্থাৎ ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৫০০ টাকা। বুকিং করতে যাব হঠাৎ কানে এল সুরেলা কণ্ঠে কেউ যেন বলে উঠল— ‘সওয়াদিকাপ’ শব্দটি। নিমেষে মোবাইল অ্যাপ থেকে চোখ সরাতেই দেখলাম এক সুন্দরী থাইকন্যা মিষ্টি হেসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ঝকঝকে ফর্মাল পোশাক, বেশ কয়েকটা ব্যাচ লাগানো, সঙ্গে গলায় এয়ারপোর্ট স্টাফের পরিচয়পত্র ঝোলানো।
আগেই জানতাম থাই সংস্কৃতিতে, কাউকে সম্মানের সঙ্গে অভিবাদন জানাতে মহিলাদের জন্য ‘সওয়াদিকা’ (Sawadika) এবং পুরুষদের জন্য ‘সওয়াদিকাপ’ (Sawadikap) শব্দটির ব্যবহার হয়। যাইহোক, ওই কন্যা হোটেলের নাম শুনেই মাত্র ১৫০ ভাটে পালকির মতো একটি বিদেশি আরামদায়ক গাড়ির ব্যবস্থা করে দিল। বুকিং স্লিপ হাতে নিয়ে এয়ারপোর্টের বাইরে বেরোতেই তীব্র গরমের আঁচ পেলাম। আমার সারথি মিঃ টনি একগাল হেসে এগিয়ে এসে সযত্নে আমার লাগেজ রেখে, গাড়ির দরজা খুলে আমাকে অভ্যর্থনা জানাল।
বিলাসবহুল গাড়িতে চেপে, আরামদায়ক সোফায় বসে বাতানুকূল আবহাওয়ায় শরীরে মনে স্বস্তি ফিরে এল। সুদৃশ্যমান রাস্তা ধরে গাড়ি এগিয়ে চলেছে। সারথি, এই ছোট্ট শহরকে কেন্দ্র করে, নানা অজানা ইতিহাস সমৃদ্ধ কাহিনি অনর্গল শুনিয়ে যাচ্ছে আর আমিও মুগ্ধ হয়ে শুনছি। কথায় কথায় রাস্তা শেষে আমার ক্যাব একটা হেরিটেজ বিল্ডিংয়ের সামনে এসে দাঁড়াল।
গাড়ির ভিতর থেকে দেখলাম, এই বুটিক হোটেলটি ইউরোপীয় এবং উত্তর থাই লানা বা লান্নাশৈলীর কারুকার্যে নির্মিত। হোটেলে চেক ইন করে নির্ধারিত রুমে প্রবেশ করলাম। অন্দরমহলের সাজসজ্জা, অত্যাধুনিক বাথরুম, একটা ছোট্ট ব্যালকনি— সবমিলিয়ে মন কেড়ে নিল। ওয়েলকাম ড্রিংক হিসাবে এক গেলাস টাটকা আনারসের জুস পান করে, নিজেকে আরামকেদারায় এলিয়ে দিলাম।
পরের দিন সকালেই প্রাতঃরাশ ও স্নান সেরে আমি প্রস্তুত। গতকালের কথামতো কিছুক্ষণ পরেই টনি গাড়ি নিয়ে হাজির। আজকের গন্তব্যস্থল চিয়াং রাই অঞ্চলের বিখ্যাত লং নেক ওম্যান ভিলেজ। আমরা লম্বা গলার জিরাফ দেখেছি কিন্তু অন্য কোনও প্রাণীর মধ্যে এত লম্বা গলা আর কোনওদিন দেখিনি। এবার জিরাফের মতো লম্বা গলার মানুষ দেখার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ড অনুযায়ী জানা যায়, বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা গলা হিসাবে (প্রায় ১৬ ইঞ্চি) এই পার্বত্য গ্রামের এক কায়ান মহিলা বিশ্বজুড়ে চর্চিত হয়েছেন। আমি চিয়াং মাই শহরের সিকুম (Si Phum) অঞ্চলে ছিলাম। গাড়িতে যাওয়ার সময় ড্রাইভার কাম গাইড টনির কাছে কায়ান মহিলাদের সম্পর্কিত বেশ কিছু অজানা বিস্ময়কর তথ্য শোনার সুযোগ হল। ১৩০ কিমির এই আনন্দযাত্রা মাত্র ৩ ঘণ্টায় শেষ হয়ে, অবশেষে পৌঁছোলাম কায়ান সম্প্রদায়ের অস্থায়ী গ্রামে।
থাইল্যান্ড সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী কায়ান গ্রামে প্রবেশ পথে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় ৩০০ ভাট প্রবেশমূল্য দিয়ে টিকিট সংগ্রহ করলাম। চারপাশে কয়েকটি এসি ভ্যান ইতিউতি দাঁড়িয়ে, বোধহয় পর্যটক নিয়ে এসেছে। অন্যদিকে স্থানীয় কয়েকটা বাচ্চা মেয়ে হস্তশিল্পের পসরা সাজিয়ে বসে ওদের ভাষায় সকলকে আহ্বান জানাচ্ছে। একটা চলমান ভ্যান গাড়িতে চা-কফি সহ বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যও বিক্রি হচ্ছে।
আমি আর টনি কাঁকড়-মাটি বিছানো এবড়ো-খেবড়ো পথ ধরে, দুর্গম পার্বত্য গ্রামের বাঁকে বাঁকে নতুন দৃশ্যের শোভা অবলোকন করতে করতে গ্রামের অন্দরমহলে প্রবেশ করলাম। গ্রামের ভিতরে দু-পাশের বাসস্থানের আড়ালে মাঝখান জুড়ে বেশ কয়েকটা অস্থায়ী দোকান দেখতে পেলাম। সেখানে জিরাফের মতো লম্বা গলার অসামান্য সুন্দরী মহিলারা নিজস্ব সংস্কৃতির স্বতন্ত্র রঙিন পোশাকে, ধাতব পিতল আর সোনার খাদমিশ্রিত বলয় গলায় পেঁচিয়ে একমনে তাঁত বুনে চলেছে। কেউ আবার নিজেদের বানানো হস্তশিল্পের পসরা সাজিয়ে প্রদর্শন এবং বিক্রিও করছে। অনেকের কোলে ফুটফুটে মেয়ে ঘুমোচ্ছে, কেউ আবার তাদের শিশু কন্যাকে হাতে কলমে তাঁত বোনা শেখাচ্ছে।
(ক্রমশ…)