মা মা মা… কোথায় গেলে? বাড়িতে ঢুকেই চিল চিৎকারে সারা বাড়িকে একেবারে মাতিয়ে দিল। গম গম করে উঠল বাড়ি। দুপুরবেলা মায়ের চোখে সবে একটু ঝিমধরানো ঘুম এসেছে। ছেলের ডাকে তড়িঘড়ি বাইরের ঘরে এলেন।

—কী হয়েছে রে বাবি? এইভাবে হন্তদন্ত হয়ে বাড়ি এলি? শরীর-টরীর ঠিক আছে তো। দেখি, বলে ছেলের কপালে হাত দিয়ে দেখলেন। ঠিক আছে তো সব, তাহলে। কিন্তু এইভাবে এলি কেন হন্তদন্ত হয়ে? মায়ের মন তো। ভয় লাগে আজকাল। যা দিনকাল পড়েছে। বুঝিস না?

—মা এসো। আমার কাছে আগে এসে বসো, তারপর শুনো কী হয়েছে!

—রোজই তো ‘রিমা রিমা’ করে ঢুকিস,তাই একটু অবাক হয়েছিলাম রে। তুই তো জানিস, রিমা এই সময়ে বাড়িতেই থাকে। অভিমান যেন চুঁইয়ে চুইয়ে পড়ে গেল!

—জানো মা? আজ একটা কথা তোমাকে না বলতে পারলে যেন শান্তি পাচ্ছি না। অফিসে আজ একটা কনফিডেন্সিয়াল মিটিং ছিল, তাই কোনওরকমে সেটা শেষ করেই ছুটে এলাম। কো-অপরেটিভ থেকে নোটিস এসেছে যে, সব পুরোনো বাড়ি ভেঙে ওরা মডার্ন মাল্টিস্টোরিড ফ্ল্যাট করবে। যাদের জমি তাদের চারখানা ফ্ল্যাট দেবে আর সেই ফ্ল্যাটগুলো তাদের সুবিধা মতো করে দেবে। জানো তো আমি তোমাকে সারপ্রাইজ দেব, ভেবেছিলাম। তুমি কিন্তু না কোরো না মা, প্লিজ মা আমার। সব শুনলে তুমি না করবে না তাও আমি জানি।

—কিন্তু বাবি, তোর বাবার শেষ স্মৃতিটাও আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে চাইছিস? চারিদিকে যে ওনার স্মৃতি আর তোদের হাঁটি হাঁটি পা-এর সব ছাপ। আমি তো এই স্মৃতিটুকু আঁকড়েই বেঁচে আছি রে। আমি চলে গেলে না হয় এসব করিস। সোনা ছেলে আমার ভুল বুঝিস না মা-কে!

—এই দ্যাখো তুমি আবার সেন্টিমেন্টাল কথা শুরু করলে! বাড়িটার তো কিছু কিছু জায়গা ভেঙেও গেছে। আর অনেক পুরোনোও হয়ে গেছে। এত বড়ো বাড়ি নিয়েই বা কী করব আমরা বলো? ক’দিন পরে বুবাই, টুম্পি-ও যে যার মতো বাইরে চলে যাবে। তারপর সবার ওপরে বড়ো কথা হল, সব ঠিক করাতেও বেশ কয়েক লাখ টাকা লাগবে। শুধু টাকা পয়সা না, দেখাশোনাও তো করতে হবে। কে করবে বলো ? রিমাও পারবে না এত করতে। আমার তো সময় নেই দেখতেই পাচ্ছ। আর এতখানি জায়গা নিয়ে আমরা কী-ই বা করব? ভাবো মা! তাছাড়া কো-অপারেটিভ-এর কাছে আমরা কোনও অজুহাত-ই দেখাতে পারব না। বেশি করলে ওরা বেআইনি ভাবে ভাঙার কাজ শুরু করে দেবে, বুঝলে? তখন হাত পা কামড়ানো ছাড়া আর কিছু করার থাকবে না। তখন কিন্তু দু’কূল-ই যাবে। কাজেই না কোরো না, বুঝলে মা! আমি অনেক ভেবে চিন্তে দেখেছি, এগ্রিমেন্ট সাইন করে দিই। তোমাকে না বলে কোনওদিন কোনও কাজ করিনি তো। করেছি কি?

রিমা রান্নাঘর থেকে সব শুনে নিজের ঠোঁট নিজেই কামড়াচ্ছিল। আর ঘন ঘন পাশ ফিরে দেখছিল মা আর ছেলেকে। লিভিং রুমটা একেবারে রান্নাঘর ঘেঁষা। এইজন্যেই করেছিলেন ওনারা যাতে রান্না করতে করতেই সব দেখা বা গল্প শোনা যায়। মা সব শুনে ‘হ্যাঁ বা না’ কিছু বলছে না দেখে কল্পতরু ওরফে বাবি উঠে পড়ল। তুমি চিন্তা করে আমাকে জানিও মা। পজিটিভ বলবে আমি জানি৷

এইবার কল্পতরু তাদের ঘরে আসলে রিমা সালোয়ার কামিজের ওড়না গায়ে দিয়ে একরকম ছুটে ঘরে এল। দুনিয়ার সব দাপাদাপি ক্রুদ্ধ লোভ ভেঙে দিল অবিশ্বাস আর বাবির ছদ্মবেশী রূপ।

—বাবি! এটা কিন্তু তুমি ঠিক করছ না। মা যতদিন বেঁচে আছেন, না হয় একটু কষ্ট করেই থাকলাম। আর কষ্ট-ই বা কী? কি সুন্দর খোলামেলা বাড়ি। আজকাল তো হয়েছে সব ঘুপচি… আর বুবাই, টুম্পি-ও বেশ ন্যাচারাল পরিবেশে মানুষ হচ্ছে। দিদার সাথে হেসে খেলে বড়ো হচ্ছে। কত কষ্ট করে এত সব জানা অজানা গাছ লাগিয়েছিলেন। শুধু আমাদের মুখ চেয়ে তাই না? আমাদের মতন বাগানটাও মা-এর এক বন্ধন। আমরা বেরিয়ে গেলে ওই বাগান নিয়েই উনি থাকেন, বাড়ি আসলে একগাল হেসে দেখান বাগানে তাঁর হাতের ফসল। আলু, বেগুন, ঝিঙে, চালকুমড়ো। আবার কখনও বা এঁচোড়, কাঁচা আম। না, না আমি এটা কিছুতেই হতে দেব না। প্লিজ, একবার ভেবে দ্যাখো। মা তোমার নাম যে কেন কল্পতরু রেখেছিলেন, আমি বুঝি না!

—দ্যাখো তুমি এসবের কিছু বোঝো না। কাজেই চুপ করে থাকো। আমি যা করছি, আমাকে করতে দাও। আমাকে টেক্কা দিতে যেও না। তোমার আমার ভালোর জন্যেই করছি। কেবল নিজের জন্য না, বুঝলে?

—আমি তো চুপ করেই আছি। আর তোমাকে টেক্কা দিতে আমার বয়েই গেছে। আমার দাদারাও তো সব পুরোনো বাড়িতে আছে। কই শুনছি না তো যে, কো-অপারেটিভ বাড়ি নিয়ে নেবে।

—তোমার দাদারা কী করছে না করছে তা দেখার আমার প্রয়োজন নেই। আর কথায় কথায় দাদারা দাদারা কোরো না তো। ডিসগাস্টিং— বলেই বাথরুমে ঢুকে গেল কল্পতরু। যেতে যেতে বলল, আমাদের বাড়ির ঝুট ঝামেলা কি তোমার দাদারা সামলাবেন এসে? রিমা এই কথার জবাব দিল না। জানে জবাব দিলে তর্ক আরও বেড়ে যাবে। মায়ের কাছে শুনেছিল, একজন রেগে গেলে অন্য জনকে চুপ করে যেতে হয়। তাহলেই আর ঝগড়াটা এগোয় না।

(ক্রমশ…)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...