—অ্যাই শোনো! মেলা লেকচার মেরো না তো। আজকাল বড্ড বেশি আমাকে কন্ট্রোল করতে চাইছ।

–এ্যাই! ঠিক করে কথা বলো। শিক্ষিত মানুষের মুখে এসব মানায় না। আর মা আমাদের সম্বন্ধেই কী ভাববেন সেটা ভেবে দেখেছ? আগে বলো ভালোবাসা দুঃখের রক্তকে স্পর্শ করে, না দুঃখের রক্ত ভালোবাসাকে স্পর্শ করে? রিমা স্পষ্ট ভাবে বাবির চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল।

—ডিসগাস্টিং! এখন কবিত্ব ভালো লাগছে না রিমা। স্ন্যাক্স দাও। আই অ্যাম হাঙ্গরি। মাথা গরম করে দেওয়া ছাড়া কি তোমার আর কোনও কাজ থাকে না?

রিমা কথাটা শুনে বিড়বিড় করতে করতে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল। কারণ সেও তার শাশুড়িমার মতন অশান্তি পছন্দ করে না। রিমা নীরব থাকে। নীরব থাকাটাই এ মুহূর্তের দস্তুর। শব্দহীনতা শ্রেষ্ঠ সম্মতি। ছেলে কফিরুমে জানলার দিকে বসে পড়ল চুপচাপ।

এই কফিরুমটার আবার গল্প আছে বেশ। টিনাদেবী যখন জমি কিনে বাড়ি তৈরি করছিলেন সেই সময় সব ঘর হয়ে যাবার পর রান্নাঘরের পাশের ব্যালকনিটা বিশাল লাগছিল। তাই দেখে টিনা তাঁর স্বামীকে বলেছিলেন, ‘বাবি যখন বড়ো হবে — হয়তো বিদেশে যাবে নয়তো, একটা বড়ো চাকরি করবে তখন একটা ঘরে বসে বাবি আর বাবির বউ চা খাবে অফিস থেকে এসে বা ভোরবেলা। ওনার স্বামী হেসে বলেছিলেন, আর আমি আর তুমি? বলে এদিক ওদিক তাকিয়ে ওনার ফসা গালটা টিপে বুকের কাছে টেনে নিয়েছিলেন। অনেকদিন পর হঠাৎ করে একটা শিহরণ অনুভব করলেন টিনা।

টিনাদেবী একটা গল্প পড়ছিলেন প্রতিভা বসুর লেখা— জীবনের জলছবি। মনে মনে ভাবলেন তিনি যদি লিখতে পারতেন প্রতিভা বসুর মতো করে লিখে ফেলতেন নিজের জীবন কথা। নিজের এই সংসারের উত্তরণের কথা।

পরের দিন প্রমোটার এল দশটার সময়। চারিদিকে কেমন যেন থমথমে। মেঘে আকাশ ঢেকে গেছে। বৃষ্টি হবো হবো করেও হচ্ছে না। বাবি অফিস গেছে এক ঘন্টা পরেই আসবে বলে গেছে। টিনাদেবী চুপচাপ কাগজে সাইন করবার জন্য হাত বাড়ালেন। একটা কথাও উচ্চারণ করলেন না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে এদিক ওদিক দেখতে থাকলেন।

রিমা দেখল কীভাবে অসহ্য-কে মুখ বুজে সহ্য করতে হয়। বুকের ভেতরটা যেন ছারখার হয়ে যাচ্ছিল টিনার। এই ওনার ছেলে ভাবতেও খুব খারাপ লাগছিল সেই মুহূর্তে। আর থাকতে না পেরে রিমা প্রমোটার-এর কাছে এসে বলল সোজাসুজি, ‘এ বাড়ি আমরা বিক্রি করব না। ভুল ডিসিশন নেওয়া হয়ে গেছিল। যখন করব, তখন আমরা ভেবে দেখব। এখন আপাতত স্থগিত থাক।”

নাতি নাতনি বাড়িতে কালো কোট পরা লোক দেখে উঁকিঝুঁকি মারতে শুরু করল। ওরা স্কুলে শুনেছে বন্ধুদের পেরেন্টসরা ঠাম্মা-দাদুর বাড়ি বিক্রি করে এখন ছোট্ট ফ্ল্যাটে থাকে। তাই ওরা ওদের বাড়ি আসতে খুব ভালোবাসে।

ওরা দুই ভাই-বোন এসে ঠাম্মির গা ঘেঁষে বসল। ঠাম্মি মুখ নীচু করে বসে আছেন। নাতনি ঠাম্মির কানে কানে বলল, “ঠাম্মি, কোনও চিন্তা নেই। আমরা এই বাড়ি ছেড়ে কিছুতেই যাব না, দেখো।”

প্রমোটার রিমাকে বললেন, ‘কী বলছেন আপনি? আমাকে তো মিঃ কল্পতরু রায় আজকেই সাইন করার কথা বলেছিলেন।

—বলেছিলেন, কিন্তু আমরা আজকেই এই সিদ্ধান্তে এসেছি। উনি এখুনি এসে পড়বেন। প্লিজ! কিছু মনে করবেন না, আপনার সময়ের অপচয় করিয়ে দিলাম। কিন্তু আমরা অপারগ। হাত দুটো জড়ো করে রিমা প্রমোটর-কে বিদায় জানাল। এত তাড়াতাড়ি ঘটনাটা ঘটে যাবে বুঝতে পারেনি রিমা ও টিনাদেবী।

—আমি জানি, বাবি আসলেই এক যুদ্ধ শুরু হবে। আমার মনের ভিতর তাই সেই যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছে অবিরাম। ক্রমশ বড়ো হয়ে উঠছি আমি। সত্যিকারের বড়ো, ম্যাচিওরড। শাশুড়ি-বউয়ের কেমিক্যাল ইকোয়েশন যে এক, তা জানাতেই কি?

বাবি গাড়ি পার্কিং লটে রাখতে না রাখতেই প্রমোটরের গাড়ি পাশ দিয়ে চলে গেল। বাবি ঘরে ঢুকেই দেখে— মায়ের কাঁধে মাথা রেখে রিমা বসে আছে সোফা সেটে৷ দু’জনের চোখেই জল।

—সাইন করে দিয়েছ মা? গলাটা কেঁপে উঠল বাবি-র।

মায়ের দু’চোখে জল। রিমা মাথা তুলে লো ভেলোসিটিতে বলল, ‘না বাবি! ওনাকে ফিরে যেতে বলেছি।”

—ফিরে যেতে বলেছ? কিন্তু কেন? এই কথাটা বলতে এত দ্বিধা? আমি অনেক ভেবেচিন্তে এই সিদ্ধান্তেই তো এসেছিলাম। তা তুমি সেই কাজটি নিজেই করেছ। একেই বলে বোধহয় অর্ধাঙ্গিনী! বাবি-র হাসি মুখ রিমার বুকের বোঝা অনেকখানি নামিয়ে দিল।

মা স্তম্ভিত। এই ছেলেই কি তাঁর ইচ্ছের গাছ নাকি? যে-ছেলেকে প্রথম হাঁটি হাঁটি পা করে চলতে শেখানো, কথা বলতে, লিখতে শেখানো, তারপর মহিরুহ বাবিতে পরিণত করা। সব সম্ভব হয়েছে মিষ্টি বউ, না… না… আমার মেয়ে আমার রিমা মা-র জন্য! চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে আবার টিপটপ সাজানো লিভিংরুমের সোফায় টিনাদেবী গা এলিয়ে দিলেন। রিমার রুচিবোধ আছে।

বাবি আর একটিও কথা না বাড়িয়ে মাথা নীচু করে শুধু মা’কে প্রণাম করল। ফ্যাল ফ্যাল করে দেখছে বাবি রিমাকে। তিরতির সুখ কাঁপছে রিমার অশ্রুভরা

দু-চোখে। ওই কাঁপন ছড়িয়ে গেল তারও বুকে। শিরায়। উপশিরায়। সুখমুক্তোয় স্বপ্নের মালা গাঁথছে মা আর রিমা। হ্যাঁ, সুখের স্বপ্ন। যে স্বপ্নগুলো নিয়ে মা, রিমারা বেঁচে থাকে আজীবন। শুধু একটু পারস্পরিক বোঝাপড়াই তো সাংসারিক সুখের চাবিকাঠি হয়।

—রিমা আর দাঁড়িয়ে থেকো না প্লিজ! যাও দেখি গরম গরম পকোড়া করো। কী বলো মা। আজ আমরা বাইরে খেতে যাব। কেমন?

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...