কলকাতা মানেই কল্লোলিনী। বহমান আবেগে মেতে থাকা আর মাতিয়ে রাখার শহর। সংষ্কৃতির পীঠস্থান। আর এই সংষ্কৃতির নতুন সংযোজন ‘নৃত্যগাথা’। তিন বছরে পা রাখল ভারতীয় ধ্রুপদী নৃত্যের এই ফেস্টিভ্যাল। ‘ভারতীয় বিদ্যাভবন’ এবং ‘জে এল মেহতা ফাউন্ডেশন’-এর উদ্যোগে, এবারের ‘নৃত্যগাথা’-য় একেবারে চাঁদের হাট। মল্লিকা সারাভাই, শোভনা, অরুণা মহান্তিদের মতো দিকপাল নৃত্যশিল্পীরা মাতিয়ে দিলেন ত্যাগরাজ প্রেক্ষাগৃহ এবং জিডি বিড়লা সভাঘরের মঞ্চ। তিন দিনের (৮, ৯ এবং ১০ নভেম্বর) এই অনুষ্ঠানে ছিল না কোনও প্রবেশমূল্য। শুধুমাত্র ভারতীয় ধ্রুপদী নৃত্যকে আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দেবার জন্যই ‘ভারতীয় বিদ্যাভবন’ এবং ‘জে এল ফাউন্ডেশন’-এর এই উদ্যোগ। তাঁদের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন দর্শকরা।
প্রথম দিনের অনুষ্ঠানে ছিল বিশিষ্ট ওড়িশি নৃত্যশিল্পী অরুণা মহান্তির গ্রুপ-এর অনুষ্ঠান। ‘দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ’, ‘ভীমের দুর্যোধন বধ’– এইরকম টুকরো টুকরো মহাভারতের কাহিনি উঠে এসেছিল ওড়িশি নৃত্যের ছন্দে। দর্শকদের মন জয় করে নিয়েছে এই পরিবেশনা। তবে প্রথম দিনে আকর্ষণের কেন্দ্রে ছিলেন নৃত্যশিল্পী মল্লিকা সারাভাই। তিনি মঞ্চে এলেন, নাচলেন, মানুষের মন জয় করে নিয়ে চলে গেলেন। এক অনন্য নৃত্যকলার সাক্ষী থাকল কলকাতা।
মল্লিকা তাঁর পরিবেশনার নাম দিয়েছেন ‘পাস্ট ফরওয়ার্ড’। চিন্তা-ভাবনার এক অভিনব মিশেল এই পরিবেশনা। ভরতনাট্যমের ফর্ম, স্টাইল যেমন ধীরে ধীরে যুগ যুগ ধরে পাল্টেছে, তেমনই ভারতীয় সমাজে নারীদের অবস্থানও বদলেছে। পুরুষের চোখে,সমাজের চোখে নারীদের ভূমিকা কীভাবে বদলেছে, তা তিনি ভরতনাট্যমের ধারার বদলের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়ে এক অভূতপূর্ব আধুনিক থিম তুলে ধরলেন। এই পরিবেশনায় যেমন ছিল পৌরাণিক কাহিনি, তেমনই ছিল ‘গাল্লি বয়’-এর র্যাপ গানের ধ্রুপদী সংস্করণ। ওঁর প্রতিটা মুদ্রায় ফুটে উঠেছিল নারীর যন্ত্রণা, লাঞ্ছনা। মল্লিকা তাই সোচ্চার, তিনি মঞ্চ থেকে মুক্ত কন্ঠে আহ্বান জানিয়েছেন, ‘আমাদের জাগতে হবে। এখনও এই সমাজে মেয়েদের বড়ো হয়ে ওঠা, ছেলেদের থেকে অনেক আলাদা। আমাদের মায়েরা, নিজেরা মেয়ে হয়েও তাদের ছেলে সন্তানদের যে স্বাধীনতা দিয়ে বড়ো করেন, মেয়ে সন্তানদের বেলায় তারা খুবই রক্ষনশীল। এটা ভাঙতে হবে। তাই আমাদের উঠে দাঁড়াতে হবে।’
কলকাতা বরাবরই মল্লিকার কাছে স্পেশ্যাল। জীবনের প্রথম অনুষ্ঠান এই কলকাতায়, মায়ের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ‘চন্ডালিকা’ করতে এসেছিলেন ছোট্ট মল্লিকা। মা ছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের শিষ্যা, বাবা দিকপাল বিজ্ঞানী। মায়ের মতো মল্লিকার অনুপ্রেরণাও রবীন্দ্রনাথ। প্রথম গান শেখা, সেটাও রবি ঠাকুরের গান—‘মধু গন্ধে ভরা’। তাই কলকাতার কাছে বার বার ফিরে আসেন ‘পদ্মভূষণ’ মল্লিকা।
অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় দিনে ছিল শোভনার ভরতনাট্যম। শোভনা নিজে একজন অভিনেত্রীও বটে। ওঁর অনুষ্ঠান মন ভরিয়ে দিয়েছে দর্শকদের। শেষদিন শুভজিৎ দাসের ‘মনসা’ এবং জলসা চন্দ্র পারফর্মিং ট্রুপ-এর ‘অগ্নি–দ্য বার্ড অফ ফায়ার’ ছিল ‘নৃত্যগাথা’-র অন্যতম সেরা পরিবেশনা। এই তিন বছরেই মানুষের মনে ছাপ ফেলেছে ভারতীয় বিদ্যাভবন আয়োজিত এই ‘নৃত্যগাথা’। অপেক্ষা আবার আরেকটা বছরের।