দিনতিনেক পর শাশুড়িমায়ের ফোন পেয়ে সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ দীপেন পৌঁছায় শ্বশুরবাড়ি। দেখে, সেখানে স্বর্গীয় শ্বশুরমশাইয়ের ফটোর নীচে সোফায় বসে সুরজিৎ আর অজিত দুই ভায়রাভাই জমিয়ে গল্প করছে। ওকে দেখামাত্র ওরা সোৎসাহে বলে উঠল, ‘আরে এসো এসো, আমরা সকলে তোমার জন্যই অপেক্ষা করছি।’
তমালিকা খাটের উপর বসে দুই দিদির সঙ্গে কথা বলছিল। বাচ্চাদের কাউকে দেখা গেল না।
দীপেন গম্ভীর মুখে পাশের সোফায় বসল। বুঝতে পারে, এরা সকলে আজ একটা প্ল্যান নিয়েই এসেছে। সে-ও মোবাইলে মনোযোগী হল। দীপেন ওই ভায়রাদের সঙ্গে খুব একটা ফ্রি নয়। সুরজিৎ রাজনীতি করে, এককালে এমএলএ ছিল। অজিত পেশায় উকিল। আলিপুর কোর্টে প্র্যাকটিস করে। দীপেনের বরাবরই এদের দু’জনকে বড়ো ঘোড়েল মানুষ বলে বোধ হয়েছে। তাই সে সব সময় ওদের সঙ্গে মেপে কথা বলে।
একটু পর চা-সিঙাড়া-চানাচুর ইত্যাদি সহ কাজের মেয়েটি প্রবেশ করল। পিছু পিছু শাশুড়িমা। একে একে সকলে চায়ের কাপ হাতে নেয়। দীপেন ব্যতীত বাকি সকলে স্বাভাবিক স্বরে কথাবার্তা বলছিল। হঠাৎ শাশুড়িমা দীপেনকে বলে, ‘বাবা দীপেন, তুমি একজন ভদ্র-সভ্য মানুষ। তোমার কাছ থেকে আমরা এ ধরনের ব্যবহার আশা করিনি।’
প্রশ্নের আঘাতে দীপেন চায়ে চুমুক দিতে গিয়ে থেমে যায়। চশমার উপর দিয়ে তাকায় শাশুড়িমায়ের দিকে। খেয়াল করে, সকলে চুপ করে গেছে। ওর দিকে তাকিয়ে আছে উত্তরের অপেক্ষায়।
একটু সামলে দীপেন বলে, ‘ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না।’
—-বিয়ের এতদিন পর তুমি হঠাৎ বধূ নির্যাতন শুরু করলে?
—বধূ নির্যাতন! আমি! বিস্ময় বুঝি বাঁধ মানে না দীপেনের।
—হ্যাঁ তুমিই। তমালিকা তো আমার কাছে এসে কী কান্না। বলে মা, তোমার জামাই আমাকে সন্দেহ করে। দিনরাত ঝগড়া করে করে আমার জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে।
—দিন-রাতে আমি বাড়িতে থাকি কতক্ষণ। সকাল সাড়ে ন’টায় বেরিয়ে পড়ি। রাতে ফিরি সাড়ে আটটা-ন’টা নাগাদ। আর আপনি জানেন, আপনার মেয়ে কার সঙ্গে কী ধরনের গল্প করে? ও যা করছে তাকে বলে পরকীয়া, এক্সট্রা ম্যারিটাল অ্যাফেয়ার্স।
সঙ্গে সঙ্গে তমালিকা চেঁচিয়ে ওঠে, ‘মোটেও না, তুমি মিথ্যে কথা বলছ। রঞ্জিত আমার ছেলেবেলার বন্ধু। এ পাড়ারই ছেলে। আমরা সবাই এক সঙ্গে বড়ো হয়েছি। কারও সঙ্গে গল্প করলেই পরকীয়া হয়ে যায় না।’
–- তুই থাম, গর্জে ওঠেন শাশুড়িমা। বলেন, বাবা, তুমি বোধহয় ভুল করছ কোথাও। ওসব কিছু নয়, পাড়ার ছেলে তাই হয়তে একটু গল্পগাছা করে। তাই বলে তুমি ও নিয়ে আমার মেয়ের উপর মানসিক অত্যাচার করবে, এটা ঠিক নয়।
—একজন পুরুষের সঙ্গে আমার স্ত্রী রাত জেগে গল্প করবে, সাংসারিক কাজে অবহেলা করবে— তা নিয়ে কথা বললে সেটা মানসিক অত্যাচার হয়ে গেল? ওদের গল্পের বিষয়বস্তু জানেন আপনারা কিছু? মানে, কী ধরনের কথাবার্তা ওদের হয়? উত্তেজিত হলেও যতটা সম্ভব কন্ঠস্বর নিচু করে নিজের বক্তব্য পেশ করে দীপেন৷
তমালিকার মেজো বোন রূপা বলে, ‘আমরাও তো অনেক বন্ধুর সঙ্গে গল্প করি। কই তা নিয়ে আমাদের হাজব্যান্ড-রা কখনও কোনও অভিযোগ করে না। কীরে তপু?’
বড়ো বোন তপু ওরফে তপতী বলে, ‘না কখনও কোনওদিনই কিছু বলে না।’
তমালিকা চেঁচিয়ে বলে, ‘আরে ও ভয়ানক সন্দেহবাতিক লোক, মেন্টাল পেশেন্ট একটা। সব কিছুতে নোংরামো খোঁজে।’
শাশুড়িমা বলেন, ‘সত্যি, আমার বাকি দুই মেয়ে তো কোনওদিন তাদের স্বামীদের নামে এরকম অভিযোগ তোলেনি।’
অজিত হেসে বলে, ‘আরে ভাই, এসব সামান্য ব্যাপারে ছেলেদের মাথা ঘামাতে নেই। ওদেরকে ওদের মতো চলতে দাও। স্বামী- স্ত্রীর বন্ধন হল সাত জন্মের, ছেড়ে যাবে কোথায়?’ সুরজিতও হাসে।
সুপ্রিম কোর্টের লেটেস্ট অর্ডারটা পড়েছ তো? ওয়াইফ ইজ অলওয়েজ রাইট, তার মন জুগিয়ে স্বামীদের চলতে হবে। কী অজিত, তুমি তো আইনের লোক, ঠিক বলছি কিনা?
—ঠিক একদম ঠিক, জবাব দেয় অজিত। মুখে হাসি।
দীপেন হাসে না। বলে, ‘বিষয়টা আমার একদম ভালো লাগছে না। এটা নিয়ে আমাকে হয়তো শিগগির কোনও স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছোতে হবে।’ ওর উত্তরে ঘরের সকলে একদম চুপ করে গেল।
হঠাৎ তপু বলে উঠল, ‘তুমি যে সারাদিন বাড়ির বাইরে থাকছ, রাত সাড়ে আটটা-ন’টা নাগাদ ঘরে ফিরছ, বাড়ির বাইরে যে তুমি কিছু করে বেড়াচ্ছ না, তার কী প্রমাণ আছে?’
মনে হল সকলে বেশ উৎফুল্ল হয়ে উঠল ওর প্রশ্নে। উৎসুক চোখে তারা দীপেনর দিকে তাকাল। —আমি? বাইরে কিছু করে বেড়াচ্ছি! মানে পরকীয়া, তাই বলতে চাইছেন তো?
তমালিকা বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ তাই বলতে চাইছি।’
উত্তরে গম্ভীর কণ্ঠে দীপেন বলল, ‘আমার কোনও মেয়েবন্ধু নেই। খোঁজ করে দেখতে পারো তোমরা।’
—আহা মেয়ে বন্ধু থাকতে হবে কে বলল? এখন তো ছেলেদের সঙ্গেও ছেলেদের রিলেশন গড়ে উঠছে, মৃদু কণ্ঠে বলে ওঠে অজিত।
দীপেন, অজিতের দিকে সরাসরি তাকায়। ষড়যন্ত্রের শিকড় কত গভীরে উপলব্ধির চেষ্টা করে। তারপর আচকমাই উঠে দাঁড়ায়। একটি কথাও না বলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়।
পিছন থেকে বেশ কিছু কণ্ঠস্বর জেগে ওঠে, ‘দীপেন, আরে আরে চলে যাচ্ছ কেন? শোনো শোনো, কথা আছে, শোনো দীপেন৷’
দীপেন ফেরে না, রাস্তায় নেমে হাঁটতে থাকে।
(ক্রমশ……)