অটিজম! শব্দটা শুনলেই বুকটা ছ্যাৎ করে ওঠে! যারা জানেন এই রোগটি সম্পর্কে, তাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটি হাবাগোবা পাগল গোছের কেউ। অনেকে তাই মনে করেন, অটিজম-এর শিকার হলে আর কোনওদিনই সুস্থ জীবনযাপনে সক্ষম হবে না। আক্রান্ত শিশুটি হবে করুণার পাত্র! ভয়ের কারণ!
অথচ অটিজম যে সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যেতে পারে, সেই আশ্বাস বা প্রমাণ দেওয়ার মতো বিচক্ষণ মানুষের সংখ্যা খুবই কম। বর্তমানে সর্বাধুনিক বিজ্ঞানসম্মত সহজ ও সুলভ চিকিৎসা ব্যবস্থাকে মাধ্যম করে শিশুর জন্মের কয়েকদিনের মধ্যেই ধরে ফেলা যেতে পারে ভবিষ্যতে শিশুর অটিজম হওয়ার সম্ভবনা কতটা। আর জন্মের তিন মাসের মধ্যেই যদি নির্ণয় করে ফেলা যায় অটিজম-এর শিকার হতে পারে কিনা, তাহলে বিপদ মুক্ত করা যেতে পারে।
শিশুর তিনমাস বয়স থেকে আজ পর্যন্ত যারা আধুনিক বিজ্ঞানকে মাধ্যম করে যথার্থ চিকিৎসা (Early Intervention) পরিষেবা নিয়েছেন, তাদের শিশুরা বড়ো হয়ে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবনযাপন করে চলেছে। এখন প্রশ্ন হল, যাদের ইতিমধ্যে অটিজম হয়ে বসে আছে, তারা কি কখনওই সম্পূর্ণ ভালো হতে পারবে না? উত্তরে বলা যায়, অবশ্যই ভালো হতে পারবে, তবে সময় লাগবে। অর্থাৎ তাদের বাবা- মায়েরা যদি সঠিক চিকিৎসাকে মাধ্যম করার পথে হাঁটেন, তাহলে অবশ্যই অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলা যাবে। এই সঠিক চিকিৎসার নাম ‘ডেভেলপমেন্টাল মডেল’।
‘নবজাতক চাইল্ড ডেভেলপমেন্টাল সেন্টার’-এর ডিরেক্টর ডা. অঞ্জন ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, ‘কলকাতা ডেভেলপমেন্টাল মডেল’-এর ব্যবহারে, অটিজম আক্রান্ত শিশু, কিশোর-কিশোরীরা এখন স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে। সমাজের মূলস্রোতেও মিশে যেতে পেরেছে। তাদের কেউ কেউ বড়ো হয়ে গেছে এবং দেশে-বিদেশে স্বাভাবিক কর্মজীবন উপভোগ করছে।
বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে, নবজাতক চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টারে ২০১৪ সাল থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে দেখানো ৪৮৩ জন অটিস্টিক শিশুর মধ্যে ৩৮৬ জন (অর্থাৎ ৮৫ শতাংশ) শিশুই স্বাভাবিক ভাবে স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। এই ৩৮৬ জন শিশুর কাউকেই স্পেশাল স্কুলে যেতে হয়নি। অর্ধেক শিশুরই অটিজম শনাক্তকরণের সময়ে ডায়াগনোসিস করা হয়েছিল সিভিয়ার বা প্রোফাউন্ড হিসাবে অর্থাৎ মারাত্মক অটিজম। এই ডায়াগনোসিস করা হয়েছিল বিশ্বমানের আন্তর্জাতিক পদ্ধতি ব্যবহার করে, যাদের বলা হয়ে থাকে স্বর্ণমানের বা গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড টেস্টস, সেই পরীক্ষার মাধ্যমে।
শুধু তাই নয়, ৮৫ শতাংশ অটিস্টিক শিশু স্বাভাবিক ভাবে স্কুলে যেতে শুরু করে চিকিৎসা শুরুর গড়পড়তা ৮ মাসের মধ্যেই। গড়পড়তা মানে কেউ তিনমাস চিকিৎসার পরই স্বাভাবিক ভাবে স্কুলে যাওয়া শুরু করে, কেউ আবার স্বাভাবিক অবস্থায় পৌঁছোতে পেরেছে তিন বছর বাদে। তবে সময় যাই লেগে থাকুক না কেন, সঠিক চিকিৎসার ফলে কথা বলার ক্ষমতা এদের সবার মধ্যেই এসে যায়। আর এই সফল চিকিৎসাপ্রাপ্ত ৮৫ শতাংশের ভিতরে রয়েছেন হাসপাতালে কর্মরত ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার এবং স্কুল টিচাররা-ও।
চিকিৎসার পর অটিস্টিকরা যে শুধু লেখাপড়াতেই দুর্ধর্ষ সব রেজাল্ট করছে তাই নয়, খেলাধুলা, নাচ-গান, ডিবেটেও এরা মেডেল আনছে। তাহলে এখন প্রশ্ন, অটিজম-এর শিকার হওয়া বাকি ১৫ শতাংশ সুফল পেল না কেন?
বৈজ্ঞানিক অ্যানালিসিস দেখিয়েছে যে, তারা হল মূলতঃ সেই শিশুরা, যাদের বাবা-মা চিকিৎসকের কথা অক্ষরে অক্ষরে মানতে পারেননি। কিন্তু কলকাতা শহরে এবং ভারতে ও ভারতের বাইরে থেকে নানান দেশের যে সকল বাবা-মা নিজেদের শত অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও সুচিকিৎসা সম্পূর্ণ ভাবে গ্রহণ করেছেন, তাদের শিশুদের দেখে আজ আর কেউ কল্পনাও করতে পারবে না যে, শিশুটির এককালে অটিজম ছিল। এদের কেউ কেউ যে একসময় কথাই বলতে পারত না, লেখাপড়া তো দূরস্থল, বদ্ধ উন্মাদের জীবন কাটাতে হবে কিনা ভেবে বাবা-মা দু’চোখের পাতা এক করতে পারতেন না।
তবে বাবা-মায়েরা এমন ভাবে সচেতন থাকুন যেন তাদের সন্তান অটিজম-এর শিকার না হয়। তাই জন্মের পর তারা যেন দু’সপ্তাহের মধ্যে শিশুটিকে নিয়ে এসে পরীক্ষা করিয়ে নেন। এই টেস্টটির নাম— ‘অ্যাডভান্সড জিএম টেস্ট’ (Advanced General Movements Test)। এই টেস্ট-এর মাধ্যমে জানা যাবে, শিশুটির অটিজম, সেরিব্রাল পলসি, ভবিষ্যতে লেখাপড়ার সমস্যা কিংবা লার্নিং ডিলে বা গ্লোবাল ডেভেলপমেন্টাল ডিলে এইসব কিছু হওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা। ৬৭ শতাংশ থেকে ৯৮ শতাংশ নিশ্চয়তার সঙ্গে এই টেস্ট করা সম্ভব।
বৈজ্ঞানিক গবেষণা থেকে জানা যায়, জন্মের সময় যে-শিশুগুলি স্বাভাবিক দেখতে, এমনকী তাদের মধ্যেও অন্তত দশজনের মধ্যে একজনের উপরোক্ত বিকাশজনিত রোগ হতে পারে। এই ধরনের সমস্যাটিকে বলা হয় নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডারস (Neuro- Developmental Disorders or NDD)|
এতদিন যেহেতু জন্মের পরপরই বিজ্ঞানসম্মত কোনও টেস্ট আমাদের জানা ছিল না, তাই আমরা রোগ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বাধ্য হতাম। এখন যেহেতু এত শক্তিশালী এক সহজ টেস্ট এসে গেছে, যেখানে শিশুকে একটা সুঁচ না ফুটিয়েই টেস্টটি করিয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হল এই যে, অনেকে এই টেস্টটিতে আস্থা রাখেন না। তবে যারা আস্থা রাখেন, তাদের শিশুর জন্য এই টেস্টটি সুফল দেবেই।
যাদের শিশুর অটিজম আছে, তাদের উদ্দেশ্যে ডা. অঞ্জন ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, ‘আশা হারাবেন না। সব থেকে ভালো হয় যদি আপনার সন্তানের জন্মের দু’সপ্তাহ পর অ্যাডভান্সড জিএম টেস্ট-টি করিয়ে নেন। মনে রাখবেন, We have enough technology on earth to erase the disability from the planet.”