একদিকে বিচ, অন্যদিকে সব আলো ঝলমলে হোটেল, রেস্তোরাঁ, নাইট ক্লাব আর শপিং মল। রাতভর পার্টির জন্য আদর্শ জায়গা। বিচের ধার দিয়ে হেঁটে চলা পথ। পাশে ছোটো ছোটো কিছু দোকান, স্থানীয় লোকেরা খাবার আর ড্রিংক্স বিক্রি করছে। বিচের ধারে চেয়ার নিয়ে বসে আছে কত লোক। এখানে কিছুটা শান্ত পরিবেশ। বিচের ধারে একটু হেঁটে নিয়ে এবার এগোলাম রেস্তোরাঁর দিকে। পর্যটন শিল্পকেন্দ্রিক অর্থনীতি বলে বালির লোকজন জানে কীভাবে পর্যটকদের খুশি করে বিদেশি মুদ্রা রোজগার করতে হয়। তাই এখানে চয়েস-এর কোনও অভাব নেই। রেস্তোরাঁর সঙ্গে লাগোয়া ক্লাব। কোনও লোকাল ব্যান্ড পারফর্ম করছে। গান শুনতে শুনতে ডিনার শেষ করে হোটেলে ফিরলাম।
আজ বালিতে দ্বিতীয় দিন। সকালে তৈরি হয়ে অপেক্ষা করছি। সলিহিন এসে বলল, ‘আজ আপনাদের একটু অসুবিধা হবে।’ আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন?’
—আজ এখানে হলিডে। দোকান-পাট সব বন্ধ থাকবে। এইসময় বালির সব থেকে বড়ো রিলিজিয়াস ফেস্টিভ্যাল হয়।
আমি এ ব্যাপারে কিছুই জানতাম না। তাই আবার জিজ্ঞেস করলাম, “তোমরা এই দিন কী করো? মন্দিরে যাও? পুজো করো?”
সলিহিন হেসে বলল, “আমি মুসলিম। আমরা কিছু করি না। এটা হিন্দু বালিনিজরা সেলিব্রেট করে। তবে আমাদের বাড়িতেও ওদের মতো অনেক কিছু রান্না করা হয়। আত্মীয়স্বজন আসে। সারাদিন বেশ আনন্দে কাটে।’
—তাহলে হিন্দুরা এই দিন কী করে? আমি বেশ উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
সলিহিন ড্রাইভ করতে করতে আজকের মাহাত্ম্য শোনাতে লাগল। ‘গালুঙ্গান হল একটি বালিনিজ ধর্মীয় উৎসব, যা অধর্মের উপর ধর্মের বিজয় উদযাপন করে। এটা দশদিনের একটা অনুষ্ঠান। বালিনিজ হিন্দু ধর্মমতে এই সময় মৃত পূর্বপুরুষদের আত্মা পৃথিবীতে ফিরে আসে। তাই এই সময় বালিনিজরা তাদের বাড়িতে পুজো করে, ভালো ভালো খাবার রান্না করে, আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে। তারপর উদ্যাপনের শেষদিন কুনিঙ্গানষ মৃত পূর্বপুরুষদের আত্মা আবার পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়।’
আমি খুব মনোযোগ দিয়ে গল্প শুনছিলাম। কিন্তু ওর গল্পের মাঝে আমি যে কখন আমার ছোটোবেলার দুর্গাপুজো আর দীপাবলির দিনগুলোতে ফিরে গেছি খেয়াল করিনি। সত্যিই তো! দুটো দেশ, কিন্তু কত মিল।
আজ প্রথমেই উবুদ প্যালেস দেখতে যাব। এই প্যালেসের সঙ্গে বালির অনেক ইতিহাস জড়িয়ে আছে। মাজাপাহিত সাম্রাজ্য ছিল। ইন্দোনেশিয়ার সর্বশেষ এবং সবচেয়ে শক্তিশালী সাম্রাজ্যগুলোর মধ্যে একটি। ত্রয়োদশ শতকের শেষের দিকে এই সাম্রাজ্য জাভা দ্বীপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। রাজা হায়াম উরুক এবং তার প্রধানমন্ত্রী গাজাহ মাদা-র নেতৃত্বে মাজাপাহিত সাম্রাজ্য ধীরে ধীরে বালি-সহ আশেপাশের দ্বীপগুলিতে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। মাজাপাহিত সাম্রাজ্যের একটি পরিশীলিত সংস্কৃতি ছিল। বালির রাজ পরিবার এবং অভিজাত সম্প্রদায়ের বালিনিজরা খুব সহজেই এই নতুন সংস্কৃতিকে আপন করে নিয়েছিল। বালিনিজ রাজ পরিবার বৈবাহিক সূত্রে মাজাপাহিত রাজ পরিবারের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করেছিল। এই সময় নির্মিত মন্দির এবং অন্যান্য স্থাপত্যে মাজাপাহিত শিল্পকলার প্রভাব বেশ স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায়।
ষষ্ঠদশ শতকে বালি দ্বীপের মাঝখানে এই উবুদ প্যালেস তৈরি করা হয়েছিল। প্যালেসের চারদিকে বালিনিজ স্থাপত্যকলার, বিশেষ করে মাজাপাহিত শিল্পকলার নজির স্পষ্ট। পাথর খোদাই করে তৈরি করা হয়েছিল প্যালেসের দেয়াল। আর সেই দেয়ালের সূক্ষ্ম কারুকার্য আজ চার শতক পরেও পর্যটকদের মন জয় করে চলেছে।
উবুদ প্যালেস থেকে বেরিয়ে নজরে পড়ল আরেকটি মন্দির। জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম এটা সরস্বতী মন্দির। বালিনিজ ভাষায় যাকে বলে ‘পুরা তামন সরস্বতী’। বালিনিজ স্থাপত্যে তৈরি এই মন্দির। মন্দিরের গায়ে পাথরের কারুকার্য, সামনে পদ্মপুকুর। সব মিলিয়ে একটি সুন্দর বাতাবরণ। বালির সাহিত্যপ্রেমী মানুষদের মধ্যে এই মন্দির আধ্যাত্মিক, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হয়। এই সরস্বতী মন্দিরে প্রতিবছর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত লেখক এবং পাঠক উৎসব হয়ে থাকে।
উবুদ প্যালেসের খুব কাছেই রয়েছে বালির বিখ্যাত ‘মাঙ্কি ফরেস্ট”। এখানে লম্বা লেজযুক্ত ম্যাকাক প্রজাতির বানর দেখতে পাওয়া যায়। পর্যটকদের আনন্দদানের জন্য এদের কৌতুকপূর্ণ ব্যবহারের জুড়ি মেলা ভার। মাঙ্কি ফরেস্টটি একটি সুগভীর ও ঘন জঙ্গলের মধ্যে অবস্থিত। চারদিকের কয়েকশো বছরের পুরোনো লম্বা গাছ, শ্যাওলা ধরা পাথরের মূর্তি, আর প্রাচীন মন্দিরের কাঠামো আশেপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে শতগুন বাড়িয়ে তুলেছে। মাঙ্কি ফরেস্ট শুধুমাত্র পর্যটকদের আকর্ষণের জন্যই নয়, বালিনিজদের সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মিকতার সাথেও অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত। বালিনিজরা বিশ্বাস করে বানর মন্দিরের রক্ষাকর্তা। তাই এই বনটি বালিনিজদের কাছে একটি পবিত্র স্থান।
বিকেলের দিকে আর কোথাও না গিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম। কুটা বিচ থেকে সূর্যাস্ত দেখার লোভটা সামলাতে পারলাম না। বালির পশ্চিম দিকে হওয়ায় এই বিচ থেকে খুব সুন্দর সূর্যাস্ত দেখা যায়। বিচের ধারে চেয়ারে বসে সূর্যাস্ত দেখতে কার না ভালো লাগে?
আজ সকালে আমাদের দিন শুরু হল ‘বাজরা সন্ধি মনুমেন্ট’ দিয়ে। বালিনিজ ভাষায় বাজরা মানে ঘণ্টা এবং সন্ধি মানে ঐক্য। ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বালিনিজদের আত্মত্যাগের প্রতীক হিসেবে ডেনপাসারের কেন্দ্রস্থল পুপুতান স্কোয়ারে তৈরি করা হয়েছিল এই স্মৃতিস্তম্ভ। সপ্তদশ শতক থেকে বালিতে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। ইন্দোনেশিয়ার অন্যান্য দ্বীপে ডাচ কলোনির প্রভাব অনেক বেশি হলেও, বালিতে ডাচ প্রভাব সে তুলনায় অনেকটাই কম ছিল। বিশেষ করে বালির শিল্প, সংস্কৃতি এবং ধর্মের উপর ডাচ প্রভাব বিশেষ নেই বললেই চলে। বালিনিজরা কখনওই ডাচদের মেনে নেয়নি।
সলিহিন খুব গর্বের সঙ্গে আমাদের পুপুতান বিদ্রোহের গল্প শোনাল। বালিতে পুপুতান, যার অর্থ হল ‘মৃত্যুর লড়াই’। ডাচ বাহিনীর বিরুদ্ধে বালি রাজপরিবার ও অভিজাত পরিবারের আত্মঘাতী সংগ্রাম। ১৯০৬ সালে বাদুং-এর রাজা গুস্তি নুগুরাহ মেড আগুং সম্মুখ সমরে ডাচ কলোনির বিরোধিতা করে। বালি রাজ পরিবারের অনেকেই এই যুদ্ধে অংশ নেয় এবং আত্মসমর্পণের বদলে মৃত্যুবরণ করে।
আমি বেশ আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তারপর কী হল?’
(ক্রমশ…)