প্রায় সপ্তাহখানেক বাদে লোকটা আবার ফিরে এল গবুদার চায়ের দোকানে সকালবেলায়। উশকোখুশকো চুল। মুখে একটা চিন্তার রেখা। মুখ তুলে তাকাচ্ছে না। শুধু গবুদার কাছ থেকে চা রুটি নিয়ে বটগাছটার গোড়ায় বসে খেতে লাগল। রায়বাবু ও বিনয়বাবু ওর কাছে গিয়ে প্রশ্ন করলেন— এতদিন কোথায় ছিলে?

লোকটা কোনও উত্তর দিল না।

—তোমার খোঁজ করতে একজন ভদ্রমহিলা এসেছিলেন দিন দশেক আগে। কে উনি? তুমি চেনো ওনাকে? তখনও নীরব সে।

সেদিন লোকটা শিবমন্দির চত্বরে চুপচাপ বসে সারাদিন। কী যেন এক চিন্তায় মগ্ন।

ওদিকে গবুদার চায়ের দোকানে লোকটাকে নিয়ে নানান জল্পনা কল্পনা চা-খোর মানুষগুলোর। রহস্য ক্রমশ দানা বাঁধছে। লোকটা কে? কোথা থেকে এল এখানে? কেনই বা এল? কী তার উদ্দেশ্য? কোনও বদ মতলব নেই তো?

রবিবারের সকাল, গবুদার চায়ের দোকানে চাঁদের হাট। ছেলে ছোকরারাও আড্ডা জমিয়েছে পাশের বাঁশের মাচায়। এমন সময় থানার বড়োবাবু জিপ নিয়ে হাজির। ওই লোকটার ব্যাপারে নানান প্রশ্ন। আর তখনই সবাই লক্ষ্য করলেন যে, লোকটা আবার উধাও হয়েছে। সকাল থেকে পাত্তা নেই তার। গবুদাও কিছু বলতে পারল না। সে নাকি রোজকার মতো আজ আসেনি দোকানে।

বড়োবাবু চলে যেতেই সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ল। নিশ্চয়ই কিছু একটা ব্যাপার আছে তাহলে, পুলিশও খোঁজ করছে যখন। এবার গ্রামশুদ্ধ সবার চোখ লোকটাকে খুঁজতে থাকে। সবাইকে সতর্ক করে দেন গ্রামের মাথারা।

আবারও এক সপ্তাহ লোকটাকে গ্রামের ধারে কাছে দেখা গেল না। অনেকদিন কেটে গেলেও লোকটা আর এল না। সবাই প্রায় ভুলতে বসেছিল তাকে।

তারপর একদিন সাত সকালে হইচই ব্যাপার। গবুদা দোকান খুলতে এসে দেখে, দোকানের বেঞ্চে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে লোকটা। প্রথমে কিছু বুঝতে পারেনি গবুদা। পরে ডেকে সাড়া না পেয়ে ভয় পেয়ে যায়। সবার মুখে চোখে একটা হালকা আতঙ্ক। গাঁয়ের প্রায় সবাই এসে জড়ো হয়েছে গবুদার দোকানের সামনে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের লোকজন এসে হাজির সেখানে। লোকটা কি তাহলে শেষমেশ মারা গেল নাকি?

কে যেন বলল, থানার বড়োবাবুকে খবর দাও না একবার ।

থানায় খবর দেওয়া হল। বড়োবাবু আসতেই বিনয়বাবু পকেট থেকে চিরকুট বার করে ভদ্রমহিলার ফোন নম্বর দিলেন। বড়োবাবু ফোনে যোগাযোগ করলেন সেই ভদ্রমহিলার সঙ্গে।

সবাইকে অবাক করে দিয়ে লোকটা এবার ধীরে ধীরে উঠে বসল মাচায়।

বড়োবাবু এগিয়ে এসে নানান জিজ্ঞাসাবাদ করতে লাগলেন।

লোকটা কোনও কথার উত্তর দিল না। শুধু ডান হাতটা একটু ওপরে তুলে দু’বার নেড়ে শিবমন্দিরের দিকে সোজা হেঁটে গেল।

গবুদা চিৎকার করে বলল, ‘চা রুটি খেয়ে যাও।’

বড়োবাবু ফিরে যেতে যেতে বিড়বিড় করে বললেন, ‘পাগল একটা।’

গবুদা নিজে চা আর পাউরুটি নিয়ে মন্দিরের চাতালে গিয়ে দিয়ে এল লোকটাকে।

ঘণ্টাখানেক বাদে একটা গাড়ি এসে থামল। সবার চেনা সেই গাড়ি। সেই ভদ্রমহিলা নামলেন। সবাই দেখিয়ে দিল শিবমন্দিরের দিকে। লোকটা সটান শুয়ে চাতালে। নির্বিকার, নির্লিপ্ত। ভদ্রমহিলা পায়ে পায়ে লোকটার কাছে এগিয়ে গেলেন। সে এক দৃশ্য!

গবুদার চায়ের দোকানে ভিড় করে আসা কৌতূহলী মানুষগুলো নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে। যেন কোনও সিনেমার শুটিং দেখছে। কোনও কথা শোনা যাচ্ছে না। লোকটা উঠে বসেছে। মুখটা অন্য দিকে ঘোরানো। ভদ্রমহিলা হাত জোড় করে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে কথা বলে যাচ্ছেন। লোকটা নিরুত্তর। ভদ্রমহিলা এবার পা ধরে কাঁদতে লাগলেন। এদিকে সবার কৌতূহল ক্রমশ বাড়ছে। লোকটা নিশ্চুপ বসে।

গবুদার চায়ের দোকান ছেড়ে সবাই মন্দির চাতালে জড়ো হতেই ভদ্রমহিলা উঠে দাঁড়িয়ে সবার উদ্দেশ্যে বললেন, “আপনারাও একটু বোঝান না প্লিজ!” ভদ্রমহিলা কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন।

ব্যাপারটা জানা গেল একটু পরেই। ভদ্রমহিলাই সব জানালেন সবিস্তারে।

লোকটা আসলে ভদ্রমহিলার শ্বশুরমশাই। বেশ কিছুদিন আগে বাড়িতে কথা কাটাকাটি হয়। তার জেরেই বিপত্নীক সন্তোষবাবু ঘর ছাড়েন নিঃশব্দে। সংসারে নিজেকে বোঝা মনে করে সংসার ত্যাগ করেন তিনি। সেই থেকেই খোঁজাখুঁজি চলছে। আজ যখন পাওয়া গেছে তখন বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য বউমা কাকুতিমিনতি করছে।

এবার গবুদা এগিয়ে গেল ওনার দিকে। ‘আমরা খুব লজ্জিত। দুঃখিত। আপনাকে পাগল ভেবে অপরাধ করেছি। আপনি আমাদের ক্ষমা করে দিন, সেইসঙ্গে আপনার বউমাকেও। আপনি বাড়ি ফিরে যান। সংসারে একটু অধটু…’

কথা শেষ হল না, ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। বউমার মাথায় স্নেহের হাত রাখলেন। তারপর গাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলেন।

বউমার দু-চোখে তখন অশ্রুধারা। বাকিদের চোখেও…।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...