পরাগ এরকম পরিস্থিতিতে এর আগে কখনও পড়েনি। তার মহিলা ভক্তের সংখ্যা অগণিত। মাধবীলতা তার সুডৌল বাহু দিয়ে পরাগকে জড়িয়ে ধরলেন। পরাগ সামলাতে না পেরে বিছানায় পড়ে গেলেন। মাধবীলতা তার সরু আঙুলগুলো পরাগের মুখে পাখির পালকের মতো বুলিয়ে বললেন, ‘আমি তোমাকে সব দেব। গাড়ি, বাড়ি, টাকা-পয়সা আমার যা আছে। আমার দিকে তাকাও।’

পরাগ মাধবীলতার স্পর্শে ক্ষণিকের জন্য চোখ বন্ধ করেছিল। পরাগের মনে হল যে, তার বুকের উপর বিষধর সাপের মতো মাধবীলতার অতৃপ্ত নিঃশ্বাস ফোঁস ফোঁস শব্দ করে পড়ছে। মাধবীলতার নেশা নেশা চোখে কামনার আগুন যেন সদর্পে জ্বলছে। মাধবীলতার দীর্ঘ একাকীত্বকে চোখ রাঙিয়ে সে আঙুল তুলে ধিক্কার জানাচ্ছে।

মাধবীলতার ছোঁয়ায় পরাগের বুকের ভিতর কেমন একটা ভয়, একটা শিহরণ খেলে গেল। ঠিক যেন ঘোর অমাবস্যায় হঠাৎ ভূত দেখার মতো। পরাগের দম বন্ধ হয়ে এল। তিনি জোরে শ্বাস নিয়ে মাধবীলতাকে বললেন, “তোমার কাছে আমি কিছু চাই না। তোমার চাহিদা পূরণ করার মতো ইচ্ছা বা আগ্রহ কোনওটাই আমার নেই। তুমি আমাকে জোর করতে পারো না।’ মাধবীলতাকে সজোরে ঠেলে পরাগ দরজার বাইরে বেরিয়ে যেতে চাইলেন।

মাধবীলতার চুলে জুঁই ফুলের মালা খসে পড়ল। তার অবিন্যস্ত চুলগুলো হাওয়ায় উড়তে লাগল। রাগে-অভিমানে তিনি পরাগের পথরোধ করে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘তুমি আমাকে আঘাত করলে! এত বড়ো স্পর্ধা তোমার! তুমি কী ভাবো নিজেকে! কীসের এত দেমাক তোমার! রূপ- গুণের এত অহংকার তোমার।”

পরাগ জোর গলায় বললেন, ‘নিজের চরিত্রের। এখন বুঝতে পারছি যে, ‘তুমি’ সম্বোধনের কারণ কী, বন্ধুত্বের কারণ কী। ছি! ছি!”

মাধবীলতা রাগে গজরাতে লাগলেন। মুখের উপর গাঢ় মেকআপের প্রলেপ ভেদ করে চোয়ালের হাড় কর্কশ ভাবে মাথা তুলে দাঁড়াতে চাইল। তিনি পরাগের গায়ে ঢলে পড়ে বললেন, ‘স্ক্যান্ডেল ছাড়া নামজাদা শিল্পীর দৃষ্টান্ত এ পৃথিবীতে বিরল। আর তুমি তো রক্ত মাংসের মানুষ। যদি কোনও প্রেস, মিডিয়া ঘুণাক্ষরে আজকের সন্ধ্যার কথা জানতে পারে, তাহলে কাল সকালের খবরে এটাই মুখরোচক শিরোনামে বার হবে সত্য মিথ্যা যাচাই না করেই।’

পরাগ বললেন, ‘আমি ওসব নিয়ে ভাবি না। নিজের কাছে নিজে পরিষ্কার থাকা জরুরি।’

মাধবীলতা ব্যঙ্গের হাসি হেসে বললেন, “পুরুষ মানুষের আবার চরিত্র! চরিত্রে যখন যে রং দেওয়া হয়, সেই রঙেই সে নিজেকে রাঙিয়ে নেয়।’ মাধবীলতা পরাগের মুখোমুখি তির্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ‘পরাগ, শরীরের বয়স হলেও মনের বয়স অনেক সময় বাড়ে না। যাদের শরীরের সঙ্গে মনের বয়স বাড়ে, তাদের দলে আমায় ফেলো না। মানসিক চাহিদা কি অন্যায়! তোমার কি তাই মনে হয়! যদি তাই মনে হয়, তাহলে তোমার সৃষ্টিতে পুরুষ-নারীকে নিয়ে এত খেলা কেন!”

পরাগ বিরক্ত গলায় বললেন, ‘স্টপ দিস ননসেন্স। এসব শুনতে আমার ইচ্ছে করছে না।”

মাধবীলতা আদুরে গলায় বললেন, ‘ঠান্ডা মাথায় শুনলে তবে তো শুনতে ইচ্ছে হবে। পাগল ছেলে একটা। আমার কাছে এসো।’ মাধবীলতা তার উষ্ণ দু-হাতে অক্টোপাসের মতো পরাগের কোমর শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তার বুকে চুমু খেলেন। মাধবীলতার ব্যবহারে পরাগের ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। তিনি মাধবীলতাকে তার শরীর থেকে পৃথক করে সজোরে এক চড় মারলেন। তিনি রক্তচক্ষু বার করে বললেন, “তুমি বুঝতে পারছ না আমি কী বলছি। পথ ছাড়ো। তোমার কি লজ্জা বলে কোনও বস্তু নেই! মেয়েদের লজ্জা একটা অলংকার। তোমার তো সেসব ধাতেই নেই। অপমানবোধটাও তোমার মতো নারীদের নেই। সরে যাও।”

মাধবীলতা জোর গলায় বললেন, ‘যদি না সরে যাই তাহলে কী করবে! পরাগ, আমি তোমাকে ভালোবেসেছিলাম। ভেবেছিলাম যে, তুমি অন্তত আমার যন্ত্রণার কথা বুঝবে। আমার গায়ে তুমি হাত তুললে। আমাকে চড় মারলে।’

পরাগ বললেন, “আমার তোমাকে দেখে করুণা হচ্ছে। ভালোবাসা তো অনেক দূরের কথা। তুমি একজন স্বল্প পরিচিত অবিবাহিত পুরুষ মানুষের সঙ্গে যেরকম আচরণ করেছ বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে, তাতে তোমার ওটাই প্রাপ্য। সরে যাও।”

পরাগ কথা শেষ করে মাধবীলতাকে ধাক্কা মেরে ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে ডাইনিং-এ এলেন। তারপর হুড়মুড় করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে তার গাড়ির কাছে চলে এলেন। এসে ড্রাইভারকে বললেন, ‘গাড়ি স্টার্ট দাও।’

ওদিকে মাধবীলতা ধাক্কা খেয়ে উঠে দাঁড়ালেন। চিৎকার করে ডাকলেন, “পরাগ, তুমি এভাবে আমাকে ফেলে যেতে পারো না।” কোমরে বেশ চোট পেয়েছে। মুখে মেক আপের স্তর ম্লান হয়ে গেছে। পিঠ পর্যন্ত চুল এলোমেলো হয়ে গেছে। নীচে পরাগের গাড়ির স্টার্টের শব্দ শুনে ছুটে গেলেন বিস্তৃত ব্যালকনিতে। ব্যালকনি থেকে সামনে রাস্তাটার অনেকখানি অংশ দেখা যায়। ঘড়ির কাঁটা এগারোটার ঘর ছুঁয়েছে। ল্যাম্পপোস্টের আলো মাধবীলতার মতো নিস্তেজ, বড়ো ম্লান। দু-চারটে কুকুর রাস্তায় উদ্দেশ্যহীন ভাবে ‘ঘেউ ঘেউ’ করছে।

পরাগের গাড়ি মাধবীলতার বাড়ির গেট দিয়ে সশব্দে বেরিয়ে গেল। গাড়ির জানলা থেকে পরাগ ব্যালকনির দিকে তাকালেন। ব্যালকনির রেলিং-এ দু-হাত মেলে এলো চুলে মাধবীলতা এসে দাঁড়িয়েছেন। অস্তমিত যৌবন তাকে নিরন্তর শঙ্কা, দ্বিধা ও দ্বন্দ্বের গহ্বরে ফেলছে। তার মনের গহিন অরণ্যে কামনার দাবানল জ্বলছে। পরাগের মতো কোনও সুপুরুষ হয়তো ভুলবশত সেই আগুনে পুড়বেন। মাধবীলতার হাসি, চোখের চাহনি, শরীরী ভাষা, দীর্ঘসময় পুরুষ সান্নিধ্যে না আসা তারই ইঙ্গিত দিচ্ছে। তার প্রাসাদসম বাড়িকে পরাগের মনে হল একটা নিস্তব্ধতা ঢাকা আলো-আঁধারি প্রেতপুরী। মধ্যরাতে নিশি ডাকের মতো মাধবীলতার হৃদয়ের অতৃপ্ত বাসনা তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। পরাগ গাড়ির জানলার কাচ তুলে দিয়ে ড্রাইভারকে বললেন, ‘গাড়ি জোরে চালাও।”

(সমাপ্ত)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...