আমরা বেশির ভাগ লোকেরা প্রায়ই কথাবার্তায় হার্ট, পেট, ফুসফুস এবং মস্তিস্কের গুরুত্ব দিই। কিন্তু মানুষের শরীরের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল গল ব্লাডার যার বিষয়ে কোনও কথাবার্তা হয় না। মাত্র ৩ ইঞ্চি লম্বা এই অর্গান আপনার লিভারের ঠিক নীচে থাকে আর লিভারে তৈরি হওয়া পিত্তকে স্টোর করে। এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোকপাত করেছেন কলকাতা-র অ্যাপোলো গ্লেনইগল্স হসপিটালস-এর গ্যাস্ট্রো এন্ট্রোলজিস্ট ডা. মহেশ গোয়েঙ্কা।

ডা. গোয়েঙ্কা প্রসঙ্গত জানিয়েছেন, বাইল-কে গলও বলা হয়, যার থেকে এই অর্গানের এই নাম হয়েছে। পিত্তের কাজ হল চর্বিকে হজম করা (ইমপ্লিফিকেশন)। তাই আপনি যখনই কোনও খুশি বা উৎসব উপলক্ষ্যে ভালো ভালো খাবার খান বা পাঁচতারা বুফের মজা নেন, তখন তৈলাক্ত পদার্থ (ফ্যাট) হজম করে উপযোগী জ্বালানির রূপ দেওয়ার কাজ গল ব্লাডার করে থাকে।

আপনার পেটে আর অস্ত্রে যখনই হজম প্রক্রিয়া শুরু হয়, তখন গল ব্লাডার বাইল ডাক্ট নামের একটি নল থেকে আপনার ছোটো অস্ত্রে বাইল পাঠায় যাতে ফ্যাটের ইমপ্লিফিকেশন হতে পারে। কিন্তু গল ব্লাডার বা বাইল ডক্টে পাথর থাকলে বাইল ডক্টে বাইলের প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায় বা এতে বাধার সৃষ্টি করে। বাইল ডক্টের পাথরকে কোলেডোকোলাইথিয়াসিস বলা হয়। গলস্টোন (পাথর) হওয়ার কারণে বাইলের কিছু পদার্থ শক্ত হয়ে যায়।

কিছু সমীক্ষায় বলা হয় যে, গল ব্লাডারে পাথরের ১৫ শতাংশ রোগীর বাইল ডক্টেও পাথর হয়। কিছু রোগীর ক্ষেত্রে কেবল একটি পাথর হয়, আবার অনেক রোগীর ক্ষেত্রে একাধিক পাথর হতে পারে। পাথর বালুর দানার মতো খুব ছোটো বা লেবু বা গল্ফ বলের মতো বড়ো হতে পারে ।

কারণ এবং নিবারণ

বেশির ভাগ গল স্টোন কোলেস্টেরল থেকে হয়ে থাকে। সেই কারণে চিকিৎসকরা মনে করেন, স্থূলতা, মধুমেহ, খাবারে বেশি ফ্যাট আর ফাইবার কম থাকা আর শরীর কম সক্রিয় থাকলে তা গল ব্লাডারের সমস্যাকে নিমন্ত্রণ জানানোর সমান। অন্য এক ধরনের গলস্টোন বিলুরুবিন থেকে তৈরি হয়, যা লিভার দ্বারা ব্লাড সেল নষ্ট হওয়ার সময় তৈরি হওয়া পিগমেন্ট। লিভার সিরোসিসের রোগীর যদি রক্তের কোনও অসুখ বা বিলিয়রি ট্র্যাকে সংক্রমণ হয়, তবে লিভারে বিলুরুবিন অনেক বেশি তৈরি হওয়ার কারণে পাথর তৈরি হওয়া শুরু হয়।

পাথর হওয়ার বিপদ মহিলাদের মধ্যে বেশি থাকে। যদি আগে থেকেই কারও পাথর থাকে, তার ওজন দ্রুত কমতে থাকে, অ্যাস্ট্রোজেন-যুক্ত (কেবল মহিলাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য) ওষুধ বা ট্যাবলেট নেন আর তার বয়স ৪০-এর বেশি হয়, তবে পাথর হওয়ার বিপদ বেড়ে যায়।

পাথর হওয়ার কিছু সাধারণ লক্ষণ

  • পেটের ওপরে ডানদিকে হঠাৎ ব্যথা
  • স্তনের হাড়-এর (ব্রেস্টবোন) নীচে পেটের মাঝখানে হঠাৎ ব্যথা
  • কোমরের ব্যথা, ঘাড়ের (শোল্ডার ব্লেড) মাঝের অংশে ব্যথা
  • ডান কাঁধে ব্যথা

এই ব্যথা কয়েক মিনিটের জন্য হতে পারে বা কয়েক ঘন্টা ধরে সমস্যায় ফেলতে পারে। অন্য লক্ষণগুলি হল—

  • বমি
  • মাথা ঘোরানো
  • ধুসর রঙের মল

সমস্যা

পাথরের সমস্ত ঘটনায় স্পষ্ট লক্ষণ দেখা দেয় না। কিন্তু এই সব সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে যেমন—

কোলেসিস্টাইটিস: এটি গল ব্লাডার ফুলে যাওয়ার সমস্যা যা গল ব্লাডারের গলায় পাথর আটকে গেলে হয়। এর ফলে রোগীর খুব ব্যথা বা জ্বর হতে পারে।

বাইল ডাক্ট ব্লকেজ: যদি পাথরের ফলে বাইলকে লিভার হয়ে অস্ত্রে নিয়ে যাওয়ার ডাক্ট ব্লক হয়ে যায়, তবে সংক্রমণ এবং জন্ডিস (চোখ এবং ত্বক হলদে হয়ে যাওয়া কারণ বিলুরুবিন জমা হতে থাকে) হতে পারে।

প্যানক্রিয়েটাইটিস: যদি পাথর প্যানক্রিয়েটিক ডাক্ট-কে (প্যানক্রিয়াস-কে কমন বাইল ডাক্ট-এর সঙ্গে যুক্ত করার নল) ব্লক করে দেয়, তবে এর থেকে পাথরের সবচেয়ে বিপদজনক অসুখের মধ্যে অন্যতম প্যানক্রিয়েটাইটিস হতে পারে। এর ফলে প্যানক্রিয়াজ ফুলে যায় এবং খুব ব্যথা হয় আর প্রায়ই রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করার দরকার হয়। প্যানক্রিয়েটাইটিস কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রাণঘাতকও হতে পারে।

গল ব্লাডারের ক্যান্সার: যদিও এই ক্যন্সারের বেশি প্রকোপ নেই কিন্তু যদি কারও পাথরের সমস্যা থেকে থাকে তবে তার গল ব্লাডারের ক্যান্সার হওয়ার বিপদ থাকে।

নিরাময়

ল্যাব টেস্ট আর ইমেজিং টেস্ট থেকে পাথর সম্পর্কে জানা হয়। ইমেজিং টেস্ট থেকে চিকিৎসকদের পক্ষে গল ব্লাডার, বাইল ডাক্ট আর এসবের সঙ্গে যুক্ত অন্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গের পরীক্ষা প্রক্রিয়া সহজ হয় যাতে পাথর সম্পর্কে জানা যায়। এখন চিকিৎসকদের কাছে ইমেজিং-এর অনেক বিকল্প আছে যেমন—

আল্ট্রা সাউন্ড: এটি পাথর সম্পর্কে জানার অন্যতম ভালো পদ্ধতি। আল্ট্রা সাউন্ড মেশিন সাউন্ড ওয়েভ-এর সহায়তার অঙ্গের ইমেজ তৈরি করে আর এটাও দেখায় যে, সেই অঙ্গে পাথর আছে কি নেই। এতে রোগীর কোনও কষ্ট হয় না। এটি গর্ভবতী মহিলা- সহ সকলের জন্য সুরক্ষিত।

কম্পুটেড টোমোগ্রাফি (সিটি) স্ক্যান: এতে এক্সরে আর কম্পিউটার টেকনলজির সামঞ্জস্যের সাহায্যের মাধ্যমে গল ব্লাডার, বাইল ডাক্ট আর প্যানক্রিয়াস-এর ইমেজ তৈরি করা হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এই প্রযুক্তি খুব কার্যকর নয় আর কিছু পাথর এতে ধরা পড়ে না।

ম্যাগ্নেটিক রেসোনেন্স ইমেজিং (এমআরআই): এই মেশিন এক্সরে-র পরিবর্তে রেডিও ওয়েভস আর শক্তিশালী চুম্বকের সহায়তায় অঙ্গের সূক্ষ্ম ছবি তৈরি করে আর নানা স্থানে পাথরের অস্তিত্বের বিষয়ে জানতে সাহায্য করে।

এইচআইডিএ স্ক্যান: একে কোলেসাইনটিগ্রাফিও বলা হয়। এই পদ্ধতিতে রোগীর শরীরের ভেতরে খুব মাত্রায় সুরক্ষিত রেডিও অ্যাক্টিভ মেটিরিয়াল ইঞ্জেক্ট করা হয়, আর একটি বিশেষ ক্যামেরার সহায়তায় এর ওপর দৃষ্টি রাখা হয় যাতে গল ব্লাডারে যদি কিছু অস্বাভাবিক থাকে বা বাইল ডাক্ট ব্লক হয়— তার ছবি সামনে দেখা যায়।

অ্যান্ডোস্কোইক রেট্রোগ্রেড কোলেজিয়ো প্যাস্ক্রিয়েটোগ্রাফি (এআরসিপি) : এই পরীক্ষা অন্য পরীক্ষার চেয়ে বেশি ইনভেসিভ হয়ে থাকে। এতে চিকিৎসক রোগীর মুখে একটি লম্বা নমনীয় টিউব প্রবেশ করান, যা গলা হয়ে পেট এবং অস্ত্র পর্যন্ত যায়। এই প্রক্রিয়ায় পাথর দেখা এবং বের করাও যায়।

নতুন পদ্ধতিতে পাথরের সহজ এবং কার্যকর চিকিৎসা

পাথরের সবচেয়ে প্রচলিত চিকিৎসা কোলেসস্টেক্টোমি। কিন্তু গল ব্লাডার (বাইলের স্টোর) বের হয়ে গেলে বাইল লিভার থেকে সোজা অস্ত্রে পৌঁছে যায় আর রোগী যদি না খায় তবুও অন্ত্রে বাইলের নিঃসরণ চলতেই থাকে। তাই এই সার্জারির পর কিছু রোগীর হজমের সমস্যা আর কিছু রোগীর ডায়রিয়ার সমস্যা দেখা দেয়। আবার বার-বার মল ত্যাগের সমস্যা হতে থাকে। তবে বেশির ভাগ রোগী কিছু দিনের মধ্যেই নিয়মিত আহারের সঙ্গে স্বাভাবিক হয়ে যায়। পাথর ভাঙার কিছু ওষুধও সহায়ক হয়।

কোলেজিয়োস্কোপি-র জন্য উপলব্ধ নতুন প্রযুক্তিতে একটি ইসিআরপি থেকে ডাক্ট-এর ভেতর পাথর দেখা এবং নষ্ট করা সম্ভব হয়েছে। আগে চিকিৎসক বাইল দেখার জন্য এন্ডোস্কোপি টুলস ব্যবহার করত যা তাদের রোগীর মুখের ভেতরে প্রবেশ করাতে হতো, সেইসঙ্গে এক্স-রের ব্যবহার করতে হতো যাতে পাথর কোথায় আছে তা সঠিক ভাবে জানা যায়। আজকের আধুনিক টুলসের ফলে এক্স-রের প্রয়োজন নেই আর চিকিৎসকরা আধুনিক ইন্সট্রুমেন্ট এবং ছোটো ক্যামেরার সহায়তায় গল ব্লাডারের পাথর সোজা দেখতে পান। এতে চিকিৎসকরা পাথরের সঠিক অবস্থান জানতে পারেন আর সঠিক চিকিৎসার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এটি পাথরের সেই সব সমস্যায় কার্যকরী, যেখানে চিকিৎসা কঠিন।

পাথর অন্য অঙ্গ যেমন কিডনি-তে হলে চিকিৎসকরা শরীরের বাইরে থেকে শক ওয়েভ দিয়ে পাথর ভেঙে ফেলতে পারেন কিন্তু এই পদ্ধতি গল ব্লাডারের মতো কঠিন জায়গায় হওয়ার দরুন, খুব কার্যকর নয়। কিন্তু এই সার্জারির বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্যে এটি ন্যুনতম সার্জারির প্রক্রিয়া। রোগীর কষ্ট কম হয়, কয়েকদিন হাসপাতালে থাকতে হয়, তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনের আনন্দ নিতে পারে।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...