কেরিয়ার গড়ার জন্য অতি ব্যস্ততা এবং প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌড়ে শামিল হতে গিয়ে পারিবারিক জীবন এবং স্বাভাবিক শারীরিক ও মানসিক চাহিদা পূরণের বিষয়টি ভাবতে ভুলে যাচ্ছেন অনেকে। আর যখন ভাবার অবসর পান কিংবা ভাবতে বাধ্য হন, তখন সময় অনেকটা পার হয়ে যায়— স্বপ্ন আর পূরণ হয় না স্বাভাবিক পন্থায়। কারণ যাই হোক না কেন, স্বাভাবিক ভাবে বাচ্চার জন্ম দিতে অক্ষম হচ্ছেন এখন অসংখ্য নারী। আর তাই ইনভিট্রো ফার্টিলাইজেশন বা আইভিএফ-এর চাহিদা বাড়ছে সারা পৃথিবীতে। সমীক্ষা অনুযায়ী, এখন ১২৫জন বাচ্চার মধ্যে ১জন বাচ্চা হয় আইভিএফ পদ্ধতিতে। তাই, আগামী দিনে আইভিএফ-এর সংখ্যা হয়তো আরও বাড়বে।
জানা যায়, ১৯৭৮ সালের আগে যত বাচ্চার জন্ম হয়েছে, তারা সবাই মাতৃগর্ভে শুক্রাণু এবং ডিম্বাণুর স্বাভাবিক মিলনেই জন্ম নিয়েছেন। কিন্তু তারপর থেকে আইভিএফ পদ্ধতি চলে আসার ফলে, পুরো ছবিটা বদলে গেছে। আর এখন প্রতি মিনিটে অন্তত একজন বাচ্চার ভ্রূণ তৈরি হচ্ছে টেস্টটিউব-এ পুরুষের স্পার্ম এবং নারীর এগ ফার্টিলাইজ করে। তাই বলা যায়, সারা পৃথিবীতে অসংখ্য ভ্রূণ মাতৃগর্ভে স্বাভাবিক ভাবে তৈরি না হয়ে, আইভিএফ অর্থাৎ ইনভিট্রো ফার্টিলাইজ পদ্ধতিতে হচ্ছে। তবে, যাইহোক না কেন, প্রজনন স্বাস্থ্যের বিষয়ে এখনও অনেকে সচেতন নন বলে মনে করেন চিকিৎসকদের একাংশ। তাই, মাতৃদিবসকে উপলক্ষ্য করে, সম্প্রতি ‘ফার্টিলিটি ফ্যাক্টস’ শীর্ষক এক সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করেছিল অম্বুজা নেওটিয়া হেলথকেয়ার ভেঞ্চার লিমিটেড-এর ফার্টিলিটি সেন্টার ‘জিনোম’। প্রজনন স্বাস্থ্যে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধিই ছিল ওই সম্মেলনের মূল বিষয়।

ওই সাংবাদিক সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন ‘জিনোম’-এর ক্লিনিক্যাল সার্ভিসেসের পরিচালক ডা. সুজয় দাস গুপ্ত, প্রজনন মেডিসিন ও সার্জারির সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. সুদীপ সামন্ত, প্রজনন মেডিসিন ও সার্জারির সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. শবনম পারভীন, প্রধান ভ্রূণ বিশেষজ্ঞ আত্রেয়ী চট্টোপাধ্যায় এবং ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট অঞ্জনা ঘোষ। এঁরা প্রত্যেকে প্রজনন স্বাস্থ্যের প্রতিটি দিক নিয়ে আলোচনা করেন এবং সাংবাদিকদের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দেন।
এখন মেয়েরা যেহেতু ঘরে-বাইরে নানা কাজে ব্যস্ত থাকেন বেশিরভাগ সময়, তাই তাদের কাছে বাচ্চার জন্ম দেওয়ার বিষয়টি এক বিড়ম্বনায় পরিণত হয়েছে। কীভাবে সবকিছু সামলে উঠে বাচ্চা নেবেন একজন কর্মরতা নারী, এটা ভাবতে ভাবতেই বয়স ৪০ বছর পার হয়ে যায়। আর বাচ্চা নেওয়ার সঠিক বয়স পার হয়ে যাওয়ার পর যদি স্বামীর স্পার্ম কাউন্ট কিংবা স্ত্রী-র এগ্ প্রোডাকশন কমে যায় কিংবা ইউটেরাস-এ কোনও সমস্যা দেখা দেয়— তাহলে তখন তারা নিরুপায় হয়ে আইভিএফ সেন্টারগুলির দ্বারস্থ হন। কিন্তু তখন অনেকটা দেরি হয়ে যায় এবং চিকিৎসায় সুফল পেতে অসুবিধা হয় বলে মনে করেন চিকিৎসকরা।
‘ফার্টিলিটি ফ্যাক্টস’ শীর্ষক সাংবাদিক সম্মেলনে তুলে ধরা হয়, ক্লিনিকাল কেস হিস্ট্রির মাধ্যমে ইন্ট্রা সাইটোপ্লাজমিক স্পার্ম ইনজেকশন (ICSI), প্রি-ইমপ্ল্যান্টেশন জেনেটিক টেস্টিং (PGT) এবং ক্রায়োপ্রিজারভেশনের মতো সহায়ক প্রজনন চিকিৎসায় (ART) অত্যাধুনিক অগ্রগতির মাধ্যমে চিকিৎসা বিজ্ঞান নতুন সীমানায় পৌঁছেছে। বিশেষজ্ঞরা অনুসন্ধান করেছেন যে, প্রজনন স্বাস্থ্যকে ঘিরে অবিরাম অস্পষ্টতা রোগীদের মধ্যে জ্ঞানের ব্যবধান তৈরি করছে কীভাবে। এই অনিশ্চয়তা প্রায়শই মানসিক যন্ত্রণা এবং ভয় বৃদ্ধি করে, যা চিকিৎসায় সিদ্ধান্ত গ্রহণকে আরও জটিল করে তোলে।
এই অধিবেশনে প্রজনন স্বাস্থ্য সমস্যাগুলির প্রাথমিক লক্ষণগুলি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, যা সচেতনতার অভাবের কারণে প্রায়শই উপেক্ষা করা হয়, যা পুরুষ এবং মহিলা উভয়কেই প্রভাবিত করে। বিশেষজ্ঞরা ফার্টিলিটি-র চ্যালেঞ্জের সঙ্গে সম্পর্কিত মানসিক প্রভাব এবং শারীরিক চিকিৎসার পাশাপাশি, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাগুলি মোকাবেলার গুরুত্বও তুলে ধরেন। কীভাবে দম্পতিরা প্রায়শই গর্ভাবস্থায় উচ্চতর উদ্বেগ অনুভব করেন, বিশেষকরে যখন অতীতে গর্ভপাতের ইতিহাস থাকে।
পুরুষ বন্ধ্যাত্বের প্রতি ক্রমাগত অবহেলার দিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে এই আলোচনায়। বিশেষজ্ঞরা জোর দিয়ে জানিয়েছেন যে, ভারতীয় পুরুষদের মধ্যে প্রচলিত অ্যাজুস্পার্মিয়া (বীর্যে শুক্রাণু নেই), অলিগোস্পার্মিয়া (শুক্রাণুর সংখ্যা কম) এবং ভ্যারিকোসিল (পুরুষ প্রজনন ব্যবস্থায় প্রদাহিত অংশ), প্রায়শই পরবর্তী পর্যায়ে পর্যন্ত অচেনা থাকে, তাই চিকিৎসায় সুফল পেতে অসুবিধা তৈরি করে। পুরুষের উর্বরতার সমস্যাগুলি মোকাবেলার জন্য উন্নত সচেতনতা এবং প্রাথমিক রোগ নির্ণয়ের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেওয়ার কথা জানান চিকিৎসকরা।
এই প্রসঙ্গে ডা. সুজয় দাস গুপ্ত জানিয়েছেন, ‘প্রজনন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় সময়োপযোগী এবং প্রমাণ-ভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে, অনেক ব্যক্তি তখনই প্রজনন সেবা গ্রহণ করেন, যখন বয়স-সম্পর্কিত উল্লেখযোগ্য শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তনগুলি – যেমন স্ত্রী ডিম্বাশয়ের রিজার্ভ হ্রাস কিংবা পুরুষের বীর্যের পরিমিতি হ্রাস – ইতিমধ্যেই তাদের প্রজনন পূর্বাভাসের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে শুরু করে। তাই, ক্রায়োপ্রিজারভেশনের মতো ঐচ্ছিক প্রজনন সংরক্ষণ কৌশল সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা অপরিহার্য। পুরুষের প্রজনন বয়স বৃদ্ধি, অক্সিডেটিভ স্ট্রেস এবং জীবনধারা-সম্পর্কিত কারণগুলির জন্য সমানভাবে সংবেদনশীল, যা শুক্রাণু উৎপাদনকে ব্যাহত করতে পারে এবং নিষেকের সম্ভাবনা হ্রাস করতে পারে।’
ডা. সুদীপ সামন্ত জানিয়েছেন, ‘এটি একটি ভুল ধারণা যে, প্রজনন চ্যালেঞ্জগুলি কেবল মহিলা সঙ্গীর উপর নির্ভর করে। আসলে পুরুষ বন্ধ্যাত্বের বিষয়টিও মূল্যায়ন করা উচিত। প্রায় ১৫-২০% বন্ধ্যাত্বের ঘটনা অব্যক্ত বন্ধ্যাত্বের শ্রেণীতে পড়ে, যা উভয় অংশীদারের ব্যাপক মূল্যায়নের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেয়। মাসিক স্বাস্থ্য মহিলাদের উর্বরতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেমন– পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম (PCOS) এর মতো অবস্থা, যখন প্রাথমিক ভাবে নির্ণয় করা হয়, তখন সমস্যা মোকাবিলায় সুফল দেয়। একইভাবে, গুরুতর ডিসমেনোরিয়ার মতো লক্ষণগুলি অন্তর্নিহিত এন্ডোমেট্রিওসিস নির্দেশ করতে পারে, যা অবিলম্বে সমাধান না করা হলে উর্বরতা হ্রাস করতে পারে। অস্বাভাবিক বা অতিরিক্ত যোনি স্রাবের মতো ক্লিনিকাল লক্ষণগুলি দ্রুত পরীক্ষা করা উচিত।’
ডা. শবনম পারভিন জানিয়েছেন, ‘আজকের দ্রুতগতির বিশ্বে, প্রজনন স্বাস্থ্য প্রায়শই পিছিয়ে পড়ে, যেখানে বেদনাদায়ক পিরিয়ড এবং অনিয়মিত চক্রের মতো লক্ষণগুলি উপেক্ষা করা হয়। চকোলেট সিস্ট, ফাইব্রয়েড এবং হরমোনের ভারসাম্যহীনতার মতো অবস্থাগুলি নির্ণয় করা যায় না, যা শেষ পর্যন্ত উর্বরতার উপর প্রভাব ফেলে। জটিলতা প্রতিরোধ এবং ফলাফল উন্নত করার জন্য প্রাথমিক রোগ নির্ণয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম (PCOS), যদি প্রাথমিক ভাবে সনাক্ত করা হয় এবং চিকিৎসা করা হয়, তাহলে প্রজনন এবং বিপাকীয় ব্যাধি উভয়ই প্রতিরোধ করতে সাহায্য করতে পারে। স্বাস্থ্যকর খাদ্য, নিয়মিত ব্যায়াম এবং ওজন ব্যবস্থাপনার মতো জীবনধারার বিষয়গুলি PCOS পরিচালনার মূল বিষয়। উপরন্তু, বয়স বেড়ে গেলে IVF সাফল্যের হার হ্রাস পায়, বিশেষ করে তিরিশ বছর বয়সের পর। অতএব, উর্বরতা এবং সামগ্রিক সুস্থতার জন্য সক্রিয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা এবং প্রাথমিক সচেতনতা অপরিহার্য।’
ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট অঞ্জনা ঘোষ জানিয়েছেন, ‘বন্ধ্যাত্বের ক্ষেত্রে মানসিক চাপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শুক্রাণু এবং ডিম্বাণুর গুণমানের বাইরে, মানসিক কারণগুলিও উর্বরতার উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে। অনেক রোগী চাপকে একটি অভ্যন্তরীণ সমস্যা করে তোলেন, যা মানসিক বোঝাকে আরও জটিল করে তুলতে পারে। অন্যান্য যে-কোনও চিকিৎসা অবস্থার মতোই বন্ধ্যাত্বের জন্যও সমন্বিত শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রয়োজন। চাপ হরমোনের ভারসাম্য ব্যাহত করতে পারে, ফলস্বরূপ প্রজনন ফলাফলকে প্রভাবিত করে। কাউন্সেলিং অপরিহার্য কিন্তু তা শুধু মানসিক চাপ, উদ্বেগের জন্যই নয়, বরং দম্পতিদের বন্ধ্যাত্বের সমস্যা দূর করার জন্যও অপরিহার্য।’
ভ্রূণ বিশেষজ্ঞ আত্রেয়ী চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন, ‘আইভিএফ একটি জটিল প্রক্রিয়া, যার মধ্যে ক্লিনিকাল এবং ল্যাবরেটরি উভয় কাজই জড়িত, তবে ল্যাবে যা ঘটে, তার বেশিরভাগই রোগীদের অজানা। চিকিৎসার সময়, হরমোনাল ইনজেকশন ব্যবহার করে ডিম্বাশয়কে উদ্দীপিত করা হয় এবং একাধিক ডিম্বাণু তৈরি করা হয়, সাধারণত প্রায় ১০-১৫টি। এরপর ওই ডিম্বাণু সংগ্রহ করা হয় এবং শুক্রাণুর সঙ্গে মিলন ঘটানো হয়, যা সঙ্গীর কাছ থেকে আসে। ডিম্বাণু এবং শুক্রাণুগুলিকে কালচার করা হয় এবং বিশেষ অবস্থায় ল্যাবে একটি ভ্রূণ তৈরি করা হয়। কিন্তু, আইভিএফ-এর প্রযুক্তিগত দিক সম্পর্কে সচেতনতার অভাব প্রায়শই ভয় এবং অনিশ্চয়তার দিকে পরিচালিত করে।’