কাজের থেকে অকাজেই এখন বেশি ব্যবহৃৎ হচ্ছে মুঠোফোন। কারণ, মুঠোফোনকে মাধ্যম করে বেশিরভাগ সময় এখন ব্যয় হয় সোশ্যাল মিডিয়ায়। আর এই সোশ্যাল মিডিয়ায় দৌলতে আজকাল আমজনতা, বিশেষকরে কিছু সংখ্যক মহিলার ধ্যান-ধারণা বদলে গেছে। এরা সকলেই এখন মনে করেন যে, সোশ্যাল মিডিয়ার স্ক্রিন-এ যা দেখা যাচ্ছে, তা-ই ধ্রুবসত্যি, তা-ই দৈববাণী, তা-ই ধর্মাদেশ। আর যারা এই বিশ্বাসে অটল, তাদের বোঝানোর ক্ষমতা কারওর হয়নি। কে এদের বোঝাবে যে, সোশ্যাল মিডিয়ায় যা তুলে ধরা হচ্ছে, তার বেশিরভাগটাই ক্রিয়েটেড এবং মানুষকে বোকা বানিয়ে মুনাফালাভের চেষ্টা চলছে। অর্থাৎ, পরিকল্পনা মাফিক চিত্রনাট্য তৈরি করে ভিডিয়ো বানিয়ে তা সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করা হচ্ছে কিংবা সাজানো বক্তব্য তুলে ধরা হচ্ছে।
আসলে সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনও কন্ট্রোল নেই। বলা যায়, পুরো বিষয়টা একেবারে লাগামছাড়া। কমেন্ট বক্স-এ তো গালিগালাজও চলছে। কেউ কেউ তো ব্যক্তিগত আক্রমণও করে থাকেন নির্দ্বিধায়। এমন অনেকে আছেন, একবারও ভেবে দেখেন না যে, লাগামছাড়া যে তথ্য পরিবেশিত হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়, সেই তথ্য কতটা সত্যি, কতটা বিশ্বাসযোগ্য কিংবা সেই তথ্যের উৎস কী? কিন্তু যারা সুক্ষ্ম বিচারবুদ্ধি নিয়ে চলেন, তারা বেশ বুঝতে পারেন যে, এই সমাজমাধ্যম দিশাহীন এবং যে যার মতো ব্যক্তিগত অর্ধসত্য কিংবা একেবারে ভুল বিষয়কে তুলে ধরছেন লাগামহীন ভাবে।
এমনও দেখা যায় যে, সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক ক্ষেত্রে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে কোনও ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করা হচ্ছে কিংবা মিথ্যে বদনাম ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। আর এইসব খারাপ খবর কিংবা ভুল তথ্য একসময় এমন রসালো রূপ পায়, যা বিস্ময়কর লাগে।
মেয়েরা তো আরও নানারকম সমস্যায় ভোগেন। সোশ্যাল মিডিয়া-তেও আজকাল অনেকে ‘গুড টাচ এবং ব্যাড টাচ’ শিক্ষা দিয়ে কিশোর-কিশোরীদের মনে অহেতুক ভয় ধরিয়ে দিচ্ছেন। যিনি শেখাচ্ছেন, হয়তো এই বিষয়ে তার ন্যূনতম জ্ঞানটুকুও নেই কিংবা পুরোপুরি বিপথে চালিত করার জন্যও করছেন অনেকে। কিছু ক্ষেত্রে তো বিষয়টিকে এমনই অতি- নাটকীয় করে তোলা হচ্ছে যে, যা আদতে অর্ধসত্য কিংবা একেবারেই অবাস্তব। আর এসব বাড়াবাড়ি করা হচ্ছে বেশিরভাগই ফেক প্রোফাইল থেকে।
সবচেয়ে দুশ্চিতার বিষয় হল এই যে, যে মেয়েটি বাবা-মা ছাড়া একা কখনও বাড়ি থেকে বেরোয়নি, সেই মেয়েটি যদি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভায়োল্যান্স-এর অতি-নাটকীয় ভিডিয়ো দেখতে থাকে ক্রমাগত, তাহলে বহির্বিশ্ব সম্পর্কে তার এমন ভয় ধরে যাবে যে, সে আর বাইরে বেরিয়ে কোনও কাজ করতে পারবে না কনফিডেন্টলি। শুধু তাই নয়, এই ফিয়ার ফোবিয়া ছেলে-মেয়ে কিংবা নারী-পুরুষের মধ্যে সুস্থ-স্বাভাবিক মধুর সম্পর্কগুলোও নষ্ট করে দিতে পারে। এর ফলে অনেকের জীবনও একেবারে খাদের কিনারায় এসে দাঁড়াচ্ছে।
মানুষ যত সোশ্যাল মিডিয়া নির্ভর হচ্ছে, পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কিংবা আপনজনদের মধ্যে দূরত্বও তত-ই বাড়ছে। এখন আর কেউ কারওর তেমন বিশেষ খোঁজ রাখেন না। সবাই যেন এক-একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো হয়ে যাচ্ছেন। সবটাই যেন আজ ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ড নির্ভর।
মুঠোফোনকে মাধ্যম করে একান্ত ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখও তুলে ধরছেন ফেসবুক-এ। এ রোগ বড়ো ভয়ংকর। মুঠোফোন-নির্ভর এই ভয়ংকরতা ধীরে ধীরে গ্রাস করে নিচ্ছে আমাদের জীবনের সমস্ত সংবেদনশীলতা, মানবিকতা এবং ফিজিক্যাল ওয়ার্ল্ড-কে। এর থেকে কবে মুক্তি ঘটবে কিংবা আদৌ মুক্তি ঘটবে কিনা জানা নেই।