মিহিরের কথা শুনে গাড়ির ব্রেক কষলেন অভিজিৎ। তারপর বললেন, ‘নো প্রবলেম। বরং ভালোই হল। এখানে গাড়িটা ভালো ভাবে, নিশ্চিন্তে পার্ক করা যাবে। শপিং মল-এর পার্কিং খুব বাজে, বেরোতে সময় লেগে যায়। আর এইটুকু তো রাস্তা। আমি আর পৃথা হেঁটে মল-এর দিকে এগোচ্ছি। তুমি গাড়িটা পার্ক করে এসো।”

মিহির গাড়ি পার্ক করতে চলে গেল বস্-এর কথামতো। আর অভিজিৎ এবং পৃথা পাশপাপাশি হাঁটতে শুরু করল। এমন সময় হঠাৎ-ই অভিজিতের মোবাইল ফোন বেজে উঠল। ফোনে কথা যখন শেষ হল, তখন ওরা পৌঁছে গেছে শপিং মল চত্বরে। কথা শেষ করে অভিজিৎ জানালেন পৃথাকে, ‘মুম্বই থেকে আসা আমাদের কলিগরা আর শপিং করতে আসতে পারবে না, কাজে আটকে গেছে। চলো পৃথা, মিহির না আসা পর্যন্ত ওই সামনের বেঞ্চে গিয়ে বসি।’

এক সময় অভিজিৎ ক্রাশ ছিল পৃথার। তবুও আজ এতদিন পর অভিজিতের পাশে বসতে কেমন যেন একটু বাধো বাধো লাগছে তার। কারণ, সে এখন মিহিরের স্ত্রী, সুখের দাম্পত্য। অবশ্য এসব ভাবনার মধ্যেও সে কখন যেন বসে পড়েছে অভিজিতের পাশে। কয়েক সেকেন্ড দু’জনে চুপচাপ বসে থাকার পর মুখ খুললেন অভিজিৎ— ‘পৃথা, দেখা যখন হয়েই গেল এত বছর পর, আমার জীবনের কিছু না-বলা কথা শেয়ার করতে চাই তোমার সঙ্গে। আজ না বললে আর কোনও দিন হয়তো বলাই হবে না।”

অভিজিতের কথা শুনে পৃথা একটু ঘাবড়ে যায়। আজ এতদিন বাদে অভিজিতের মনের কথা শোনার পর সে যদি নতুন করে অভিজিতের প্রতি কোনও টান অনুভব করে, তাহলে তো মিহিরের সঙ্গে তার মনের দূরত্ব বেড়ে যাবে। কিন্তু অভিজিতের কথা না শুনেও তো উপায় নেই, আফটার অল তিনি তো মিহিরের বস্। বস্ রেগে গেলে কর্মক্ষেত্রে মিহিরের ক্ষতি হতে পারে। কিন্তু এরই মধ্যে যদি মিহির এসে পড়ে? এমনই কিছু ভাবনা যখন ঘুরপাক খাচ্ছে পৃথার মনে, ঠিক তখনই আবার অভিজিতের ফোনটা বেজে উঠল।

ফোনে কথা বলার পর অভিজিৎ পৃথাকে জানালেন, ‘মিহিরের ফোন। আমাদের এক ক্লায়েন্ট-এর সঙ্গে দেখা হয়ে গেছে পার্কিং এরিয়ায়, তাই মিহিরের আসতে একটু সময় লাগবে জানাল।’

মিহিরের দূরভাষ বার্তার পর অভিজিৎ এবং পৃথা দু’জনেই হয়তো একটু নিশ্চিন্ত বোধ করল। তারপর অভিজিৎ পৃথা-কে বলতে শুরু করলেন, “জানো পৃথা, চার বছর আগে আমি বিয়ে করেছিলাম। আমার স্ত্রীর নাম ছিল বিদিশা। খুব সুন্দরী ছিল। আমি খুব ভালোবাসতাম তাকে।’

—বিদিশা একা থাকত। বলেছিল, ওর মা-বাবা মারা গেছেন। টিউশন করে নিজের এবং ভাইবোনের লেখাপড়া-সহ সমস্ত দায়িত্ব বহন করত বলেই, শুনেছিলাম ওর থেকে। আমাদের এক ক্লায়েন্ট-এর অফিস-এ কাজ পেয়েছিল পরে। ওখানেই ওর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল আমার। ওর দুঃখ-কষ্টের কাহিনি শুনিয়েছিল আলাপ-পরিচয়ের পরে। বিয়ের আগে প্রায়ই আমাকে বলত, ‘অভিজিৎ, আই লাভ ইউ ফ্রম দ্য কোর অফ মাই হার্ট”। শুধু তাই নয়, বিদিশা আমাকে বলেছিল, “এত খেটে, কষ্ট করে আর আমি পারছি না। বিয়ে করে তুমি আমার কষ্ট লাঘব করো প্লিজ।’ ওর এই কথা শোনার পর আমি আর দেরি করিনি। ওকে বিয়ে করে ঘরে এনেছিলাম।”

—বিয়ের আগে বিদিশার সঙ্গে কোর্টশিপ-পর্বে আমার বন্ধুস্থানীয় দু’তিনজন আমাকে বলেছিল, “বিদিশা ভালো মেয়ে নয়, সরে যাও ওর থেকে।’ কিন্তু তখন আমি কারও-র কথা শুনিনি। কারণ, বিদিশাকে খুব বিশ্বাস করেছিলাম। কিন্তু বিয়ের কয়েক মাস পরই ধীরে ধীরে ওর আসল রূপ দেখাতে শুরু করে দিল। প্রায় দিনই নতুন নতুন পুরুষ বন্ধুদের সঙ্গে পার্টি করে গভীর রাতে মাতাল হয়ে ফিরত। বিরক্ত হয়ে যখন আমি প্রতিবাদ করতে শুরু করলাম, তখন বিদিশা জানিয়েছিল, ‘ওটা ওর পার্সোনাল লাইফ, তাই যা- ইচ্ছে করবে।’ অবস্থা এক সময় এতটাই চরমে উঠেছিল যে, প্রায় দিনই হাত তুলত আমার গায়ে।”

পৃথা অবাক হয়ে শুনে চলেছে তার পুরোনো বন্ধু কিংবা বলা যায় এক সময়ের ভালোলাগা মানুষটার দুঃখের কাহিনি৷ আর অভিজিৎ বলে চলেছিল, ‘বিয়ের মাস পাঁচেক পর একদিন হঠাৎ বিদিশা জানাল, সে মুক্তি চায়, উড়তে চায় বাঁধনহারা হয়ে। আমার কোনও অসম্পূর্ণতা কিংবা অন্যায় না থেকেও, শুধু সম্মান বাঁচানোর তাগিদে, চাহিদা মতো আমার থেকে মোটা টাকা নিয়ে ডিভোর্স দিয়েছিল বিদিশা। পরে জেনেছিলাম, আমি একা নই, আমার আগে প্রতারিত হয়েছিল আরও দু’জন। আমি ছিলাম বিদিশার থার্ড হাজব্যান্ড।’

এবার একটু থামলেন অভিজিৎ। তারপর আবার বলতে শুরু করলেন, ‘আমি একা ছিলাম একাই হয়ে গেলাম। নেশায় ডুবিয়ে রাখলাম নিজেকে৷ সিগারেট আর মদ আমার ‘বন্ধু’ হয়ে উঠল। মনটা শূন্যতা আর হাহাকারে ভরে গেল। কখন যেন আমি আমূল বদলে গেলাম। মেয়েরা সুযোগ নিতে শুরু করল। শূন্যতা কাটানোর জন্য আমি মেয়েদের সঙ্গে ক্লাব-এ, বার-এ, পার্টিতে গিয়ে আকণ্ঠ মদ গিলতে শুরু করলাম আর নেশা চড়ে গেলে আমার গাড়ির ড্রাইভার-এর হাত ধরে বাড়ি এসে শুয়ে পড়তাম। মেয়েরা দু’- একজন আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে চাইত, কিন্তু বিদিশার মুখটা ভেসে উঠলেই আমার রাগ চড়ে যেত। সব মেয়ে সমান নয় জেনেও, কেমন যেন বিদিশার মতো মনে হতো সবাইকে। কাউকে টাচ করার ইচ্ছেও এখন হয় না আমার। শুধু একরাশ ঘৃণা জমে আছে মনের মধ্যে। কিন্তু তোমার মুখোমুখি হতেই আমি কেমন যেন সেই পুরোনো ‘আমি’-কে ফিরে পেলাম। তোমার আর মিহিরের সুখী দাম্পত্য জীবন দেখে ভালো লাগছে। কত বিশ্বাসে ভরা তোমাদের দাম্পত্য! এমনই থেকো তোমরা চিরকাল। আজ তোমাদের দেখে কেন জানি না শুধরে যেতে ইচ্ছে করছে, নতুন করে বাঁচতে ইচ্ছে করছে।”

পৃথার হঠাৎ চোখ পড়ে অভিজিতের চোখে। তার চোখ তখন জলে টইটম্বুর। অভিজিতের ওই অবস্থা দেখে পৃথা কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। মনের একটা স্তর বলছে, অভিজিতের মাথাটা ধরে নিজের কাঁধে রাখতে। আবার মনের অন্য স্তর মনে করিয়ে দিচ্ছে, সে মিহিরের বিশ্বাস, মিহিরের ভালোবাসা, মিহিরের স্ত্রী। তাই পৃথা আবেগ কাটিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘তোমার সঙ্গে যা ঘটেছে তা খুব বেদনাদায়ক। আমার খুব খারাপ লাগছে তোমার জন্য। কিন্তু এখন কী-ই বা করতে পারি আমি? বড়োজোর তোমার ভালো বন্ধু হতে পারি। তোমার যখন মন চাইবে ফোন করবে নির্দ্বিধায়। মিহির আমার হাজব্যান্ড হলেও, খুব ভালো বন্ধু। ওকে আমি সময়মতো সব বুঝিয়ে বলব। আই অ্যাম শিওর, মিহির আমাকে সাপোর্ট করবে। আশা করি, অফিসে তুমি ওর বস্ হলেও, বাইরে মিহির তোমার ভালো বন্ধু হয়ে উঠবে। প্লিজ তুমি অবসর সময়ে আঁকায় মনোনিবেশ করো আবার। তোমার দুঃখ- যন্ত্রণা ফুটিয়ে তোলো ক্যানভাসে, প্লিজ…।’

(ক্রমশ…)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...