যতটুকু দেখলাম, সৌন্দর্যের ছিঁটেফোটা চোখে পড়ল না। মেয়েদের মধ্যে কিছুটা আবাহন থাকলেও পুরুষদের নজর বহিরাগতদের কাছ থেকে শুধু ব্যাবসা করায়। পাহাড়ের গায়ে বিপজ্জনক ভাঙা সিঁড়ির ফাঁকে একটু চাতাল মতো পেরলেই বালটি কুইজিন-এর রেস্তোঁরা। পরিচিত উত্তর ভারতীয়, চিনা ও তিব্বতি খাবারও ‘বালটি কুইজিন’ বলে হুড়িয়ে বিকোচ্ছে। আমাদের প্রবৃত্তি হল না। নেমে একটা বাগানঘেরা পরিচ্ছন্ন স্নিগ্ধ মনোরম রেস্তোঁরায় খেলাম। তুরতুক থেকে থং পর্যন্ত বেশ কয়েকটা রেস্তোরাঁ আছে সবুজের মধ্যে।
পাশেই সেনা চেক পোস্ট। শুকনো ফল কিনলাম সেনার একটি স্টল থেকে। তারপর এগিয়ে গেলাম নিয়ন্ত্রণরেখা বা Line of Control (LOC) দেখার জন্য। এখানেও LOC!
নিয়ন্ত্রণ রেখা বা Line of Control (LOC)
১৯৭১-র যুদ্ধে শুধু তুরতুক নয়, আরও তিনটি গ্রাম ভারতভুক্ত হয়েছিল — চালুংখা (Chalunkha), থং (Thang) ও তাকশি (Takshi)। এরই সৌজন্যে তারা ভারত সরকার প্রদত্ত ভর্তুকি, পর্যটন, স্কুল, অঙ্গনবাড়িসহ গ্রামীণ উন্নয়ন— সব সুবিধাই পায় নিয়ন্ত্রণরেখা থং গ্রামে।
কাঁটাতারের সামনে দাঁড়িয়ে দূরের পাহাড়ে অস্পষ্ট চেকপোস্ট, বাঙ্কার ইত্যাদি দেখে অবাক লাগছিল এই ভয়ানক দুর্গম, প্রায় অগম্য স্থানে মানুষ কীভাবে ডিউটি করতে পারে। চারপাশে পাকিস্তান কবলিত পাহাড়চূড়া। যে-কোনও মুহূর্তে উপর থেকে গোলাগুলি আসতে পারে। তাই ছোটো ছোটো বাঙ্কারে ভারতীয় সেনা নজরদারি করছে। এমন বিপদসংকুল জায়গায় সরকার পর্যটকদের যেতে অনুমতি দিচ্ছে কেন? Indo-Pak Border View Point-এ সেলফি তুলিয়ে দেশাত্মবোধ সঞ্চারিত করতে?
সীমা সুরক্ষার কারণেই লাদাখ পুরোপুরি ভারতীয় সেনা নিয়ন্ত্রিত। যদিও লাদাখিদের তরফে কোনও অশান্তি নেই, ক্ষোভও নেই। ৩টি দেশের সঙ্গে প্রায় ২২১৭ কিলোমিটার আন্তর্জাতিক সীমান্তরেখা থাকলেও পশ্চিমবঙ্গ ভাগ্যিস সীমান্তবর্তী রাজ্য নয়।
সুমুর থেকে সিয়াচেন
ভাগ্যিস ২৫ তারিখেই নুব্রা উপত্যকায় মোটামুটি যা কিছু করণীয় বলে জানতাম, সেগুলো সেরে নিয়েছিলাম। কারণ ২৬ তারিখে পাকিস্তান সীমান্ত থেকে ফিরে এসে বালিয়াড়িতে সময় কাটানো কোনওভাবেই সম্ভব ছিল না। তুরতুক থেকে নুব্রা ফিরে যে অফিসার্স মেসে উঠলাম, তা বর্ডার রোডস নয়, খাস আর্মির তত্ত্বাবধানে।
পরতাপুর
জায়গাটার নাম যে পরতাপুর এবং সামরিক অভিযানে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ, ঐতিহাসিক ভূমিকাও আছে, সেসব নিয়ে ক্লান্ত শরীরে আর মাথা ঘামাইনি। শুধু ছবির মতো পটচিত্রে সাজানো গোছানো কটেজ দেখে মুগ্ধ। মন খারাপ হয়ে গেল, আগামীকাল ভোরেই এটা ছেড়ে যেতে হবে। এমন জায়গা পেলেই রাতবিরেত না মেনে আমি কষে কাচাকুচি, শ্যাম্পু, ত্বক পরিচর্যা, মিরর সেলফি ইত্যাদি সেরে ফেলি। ঝাঁ চকচকে ঘরের ভিতরেও বৃষ্টির টুপটাপ। ছবি তুলে কোয়ার্টার মাস্টারকে জানানোর পর সমস্যার কিছুটা সমাধান হল। কিন্তু অমন সুন্দর কক্ষে মিলিটারি কেতায় সুখাদ্য সহযোগে প্রকৃতির স্পর্শ মন্দ লাগল না। তেমন ঠান্ডা তো নেই। প্রসঙ্গত লে-র দিকে বৃষ্টিপাত প্রায় শূন্য, সব পাথুরে। কিন্তু নুব্রা উপত্যকার বালিয়াড়ি উট ইত্যাদি সহকারে মরুসদৃশ্য পরিবেশেও কিছুটা সবুজের স্নিগ্ধতা আছে।
বৃষ্টির সঙ্গে সহাবস্থান করেই আরেকটা দিন পরতাপুরের স্বপ্নালু আর্মির ফিল্ড ওয়ার্কশপ-এর এই অফিসার্স মেস-এ কাটাতে পারলে সিয়াচেন দেখার জন্যও ঠাঁইনাড়া হতে হয় না। বস্তুত নুব্রায় থাকার জন্য পরপর তিনদিনই চেয়েছিলাম; পাইনি। অগত্যা ২৭ জুলাই সকাল সকাল প্রাতরাশ সেরে গাড়িতে সব মালপত্র তুলেই সিয়াচেনের উদ্দেশে রওনা হতে হল। পথে নুব্রা উপত্যকারই সুমুর নামে একটা ছোটো শহরে ছিমছাম একটি অতিথি নিবাসে নিজেদের মালপত্র রেখে দিলাম।
সিয়াচেন বেস ক্যাম্প
সেই কাদায় ঘোলাটে নদী আর বাদামি ন্যাড়া পাহাড়ের মাঝখানে আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে যাত্রা। পাহাড়ের গায়ে মাঝে মাঝে গুহা চোখে পড়ছিল। সুযোগ পেলেই ফেসবুকে সচিত্র দিনলিপি লিখে প্রাইভেসি সেটিং ‘ওনলি মি’ করে রাখি। আসলে ভ্রমণকাহিনির খসড়া তুলে রাখছি। সেই আবশ্যিক কাজ করার জন্য গাড়িতে উঠে মোবাইল দেখতে গিয়ে আমার প্রচণ্ড গা গুলিয়ে উঠল। যাঃ! ওষুধের ভাঁড়ার তো হোটেলে ঢুকিয়ে এসেছি। জলখাবার পুরোটাই উগরে ধাতস্থ হলাম। মিলিটারি খাতির হজম হয়নি। রাস্তায় সিয়াচেনের জন্য চেকপোস্টে দাঁড়িয়ে আবার আপশোশ।
ইস্! গতকাল গোটা ইউনিটের কম্যান্ডিং অফিসার কর্নেল নিজে এক ঝলক এসে আমাদের খোঁজ খবর নিয়ে গেছেন, পরেরদিন বুকিং হয়নি বলে মেসের দায়িত্বে থাকা ক্যাপ্টেন চারবার ফোন করে দুঃখপ্রকাশ করেছেন। কিন্তু চেকপোস্টে এসে আমার যে-প্রশ্ন জাগল, সেটা আগের দিন মাথাতেই এল না? আসলে কার্গিল যুদ্ধে পরতাপুরের ভূমিকা তো ভুলেই গিয়েছিলাম। যাঁর সবকিছু নখদর্পণে, সেই মহাশয় তো কিছু চাইতে জানেন না। ‘কুছ ভি চাহিয়ে তো বতা দিজিয়ে গা ম্যাডাম’-এর উত্তর দিতে ভুলটা আমারই হয়েছে। আসলে বেস ক্যাম্পের অধিক এগোনো যায়, ভাবিইনি। ধরেই নিয়েছি, সেখানেই হিমবাহ ও যুদ্ধক্ষেত্রের আরম্ভ।
যাইহোক, সিয়াচেন বেসক্যাম্পে গিয়ে সুদূরে তুষারাচ্ছাদিত পর্বতচূড়া দেখতে দেখতে কিটকিটে মিষ্টি চা ও মোমো খেলাম। ক্যাম্পের সুবেদার বেশ গপ্পোবাজ মানুষ। জানালেন, সিকিমে নাথুলায় যেমন বাবা মন্দির’ আছে এক সৈনিকের স্মৃতিতে, এখানেও তেমনই আছে আরেক বাবা মন্দির আরেক মৃত সৈনিকের স্মৃতিতে। ‘ওপি বাবা”। নাথুলার হরভজন সিং কিংবা সিয়াচেনের ওম প্রকাশ— এঁরা কেউ বীরচক্র পাওয়া যোদ্ধা নন। কিন্তু তাঁদের বিদেহী আত্মা সেনা ও সাধারণ মানুষকে বিপদ থেকে রক্ষা করে, এই বিশ্বাস আমাদের কাছে আষাঢ়ে গল্প শোনালেও সুকঠিন পরিস্থিতিতে জীবন-মরণের মাঝখানে দাঁড়ানো উর্দিপরা মানুষগুলোর মনোবলের একটা করে উৎস।
(ক্রমশ…)