সুলগ্না ক্ষণিকের জন্য শিশির কাকার মুখটা মনে করে বলল – ‘একজনকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার আছে। শাস্তি দেওয়ার আছে।’ সুনীতা কপাল সংকুচিত করে বললেন, ‘উচিত শিক্ষা! শাস্তি! তুই কী বলছিস কিছুই তো আমার মাথায় ঢুকছে না।’

সুলগ্না বলল, ‘একজন আমার ক্ষতি করেছে পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে। আমার অসহায়তার সুযোগ নিয়ে আমাকে মলেস্ট করেছে। আমার সারা শরীর তার নোংরা হাতে স্পর্শ করেছে। এতদিন মুখ বুজে সহ্য করেছি। আর নয়।’

সুনীতা বললেন, ‘কী বলছিস তুই? তোর মাথার ঠিক আছে!’

সুলগ্না বলল, ‘হ্যাঁ মা, আমি ঠিকই বলছি। একবর্ণ মিথ্যে বলছি না।’ সুনীতা বললেন, “যে তোর এত বড়ো সর্বনাশ করল কে সে? বল মা।’

সুলগ্না আর্দ্র গলায় বলল, ‘মা, বাবার বন্ধু শিশির কাকা।’

সুনীতা চমকে উঠে বললেন, ‘শিশিরদা! তুই আমাকে বলিসনি তো আগে!’

সুলগ্না বলল, ‘বাবার দুর্ঘটনার সময় তুমি প্রায়ই বাবার সঙ্গে হসপিটালে থাকতে একথা শিশির কাকা আমার মুখ থেকে শুনেছিল। বাড়িতে তুমি আর বাবা না থাকার সুযোগে শিশির কাকা একদিন সন্ধ্যায় আমাকে জোর করে শারীরিক নির্যাতন করে। ভয় দেখিয়ে খারাপ আচরণ করে আমার সঙ্গে। দিদি কিছুটা হয়তো জানে। কিন্তু ও তো অসহায়। আমি মুখ খুলব বলে শিশির কাকা আমায় ভয় দেখায় যে, সে গ্রামের সকলকে জানিয়ে দেবে আমি কতটা নোংরা। শিশির কাকা ভয় দেখায় এই বলে যে, গ্রামের সকলে আমাদের একঘরে করে দেবে। আমি তখন অনেকটা ছোটো ছিলাম। ভয়ে মুখ খুলতে পারিনি। কিন্তু দশ বছর কেটে যাওয়ার পরও ওই লোকটার নোংরা চোখ আমার দিকে চেয়ে আছে। আজ সকালে টোটো থেকে নেমে আসার সময় নোংরা ইঙ্গিত করছিল। অর্পণের সঙ্গে সংসার বাঁধার আগে ওই লোকটাকে উচিত শিক্ষা দিতে চাই।’

সুনীতা বললেন, ‘জানোয়ারটা ওই কারণে সপ্তাহ দুয়েক আগে আমার কাছে তোর খোঁজ নিচ্ছিল। আমি বুঝতেই পারিনি।” সুনীতা সুলগ্নাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘তুই এত বড়ো একটা ঘটনা কী করে আমার থেকে লুকিয়ে রাখলি! মেয়ের বয়সি একটা মেয়ের সঙ্গে অসভ্যতার ফল ওকে ভোগ করতেই হবে।’ সুলগ্নার কানে কানে কী যেন বললেন সুনীতা। তারপর দু’জনেই দু’জনের দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে শুয়ে পড়লেন।

পাঁচদিন সুলগ্নার গতানুগতিক ভাবেই বাবা-মা-দিদির সঙ্গে কেটে গেল। পাঁচদিন পর সুলগ্না পাড়ার দোকানে কিছু জিনিস কিনতে গেল। সেখানে পাড়ার এক কাকিমার সঙ্গে সুলগ্নার দেখা হতেই তার বাড়ির খবরাখবর নিতে শুরু করল। কথায় কথায় সুলগ্না সজোরেই বলল, ‘মায়ের শরীর ভালো নেই। আজ বিকেলে বাবাকে নিয়ে মা-ও ডাক্তার দেখাতে যাবে।’ অদূরে চায়ের দোকানে বসে শিশির কাকার কানে গেল সুলগ্নার কথাগুলো। তার মুখের লালায় দীর্ঘক্ষণ আটকে থাকা গুটখা ফেলে উঠে দাঁড়াল।

শিশির কাকা সুলগ্নার পা অনুসরণ করতে করতে ফাঁকা রাস্তায় দাঁড়াল। সে সুলগ্নাকে জোর গলায় ডাকল— ‘এই শোন৷’ সুলগ্না হাঁটতে হাঁটতে দাঁড়িয়ে গেল। সে বলল, ‘পিছু ডাকলে কেন?’

শিশির কাকা সুলগ্নার কানের কাছে মুখ এনে বলল— ‘তোকে পিছু ডাকব না তো কাকে ডাকব। তুই তো আমার পিছুটান। তোর জন্যে আমি মরেও শান্তি পাব না রে। আজ বিকালে তোর বাপ-মা চলে গেলে সদর দরজাটা খুলে রাখিস। তোকে অনেকদিন ভালো করে দেখিনি। তোর পরিপুষ্ট ডগডগে গতরটা বহুদিন দেখিনি। এখন তো শহুরে জলে গতরে চিকনাই ধরেছে।’

সুলগ্না বলল, ‘ছি! ছি!’

শিশির কাকা বলল, ‘ছি ছি করিস না। যদি দরজা না খোলা দেখি তাহলে কী করব তোর নিশ্চয়ই মনে আছে। গ্রামের মানুষ তোকে দেখলে ছি ছি করবে। কথাটা মাথায় রাখিস।’

বিকালে সুলগ্নার বাবাকে বাড়ি থেকে বার করা হল। সুনীতাও সকলের দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল। ধীর পায়ে সন্ধ্যা নামছে। এমন সময় সদর দরজায় মৃদু আওয়াজ হল। শিশির কাকা এল। সে ঘরগুলো চারদিক চেয়ে দেখল একটি ঘরে সুলগ্নার দিদি হুইল চেয়ারে বসে ঝিমুচ্ছে। সে ক্রূর হাসি হেসে সুলগ্নার কাছে এসে বলল— ‘বাগান খালি, আমিই মালি। ‘

সুলগ্না বলল— ‘কাকা, তুমি এসব বন্ধ করো। আমাকে মুক্তি দাও।’

শিশির কাকা সুলগ্নার পিঠে কাঁধে হাত বুলিয়ে বলল – ‘খোলাই হল না কিছু, বন্ধ করব কী রে! মুক্তি আমি মরলেই পেয়ে যাবি।’ সে হাসতে হাসতে সুলগ্নার গায়ের ওড়নাটা টান মেরে ফেলে দিল। সুলগ্নাকে জাপটে ধরে বলল – “তোকে না আমার খুব খেতে ইচ্ছে করে। খিদে পেয়েছে রে।’

সুলগ্না জোরে বলল, ‘আমাকে ছেড়ে দাও কাকা। দোহাই তোমার।’

শিশির কাকা বলল— ‘বহুদিন পর বাঘ হরিণ শিকার করলে কি ছেড়ে দেয় পাগলি!’

সুলগ্না সজোরে বলল— ‘ভালো হবে না কিন্তু কাকা৷’

শিশির কাকা ঠেলে সুলগ্নাকে বিছানায় ফেলে বলল— ‘ভালো হবে না খারাপ হবে সেটা দেখছি।’ সুলগ্না শিশির কাকার হাত থেকে বেরোবার প্রাণপণ চেষ্টা করে বলল, “ছেড়ে দাও আমাকে।’

সুনীতা সজোরে দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে বলল, ‘শিশিরদা, ছেড়ে দিন আমার মেয়েকে। আপনি যা অন্যায় করেছেন আমার মেয়ের সঙ্গে তার উপযুক্ত সাজা আপনি পাবেন। মানুষের মতো দেখতে হলেই সে মানুষ হয়ে যায় না। আপনার মধ্যে মনুষ্যত্ব বলে কিছু নেই।’ সুনীতাকে দেখে শিশির কাকার হাত আলগা হতেই সুলগ্না তার মায়ের পিছনে এসে দাঁড়াল।

শিশির কাকা বলল— ‘কী প্রমাণ আছে আমি তোর মেয়ের সঙ্গে অন্যায় করেছি। কিন্তু আমি যদি সকলকে ডেকে বলি ওই তোর শহুরে ফেরত মেয়ে আমাকে ডেকেছিল শারীরিক চাহিদা পূরণের জন্য।’

সুনীতা শিশির কাকার গালে একটা সজোরে থাপ্পড় মেরে বলল, ‘আর একটা নোংরা কথা আমার মেয়ের নামে নয়। আর প্রমাণ আমি দেব। এই দ্যাখো, তুমি যা যা একটু আগে আমার মেয়ের সঙ্গে করেছ, তার পুরো ভিডিও আমি জানালার বাইরে থেকে এই ফোনে তুলে রেখেছি। পুলিস এলেই হাতে তুলে দেব।’

শিশির কাকা সুনীতাকে রক্তচক্ষু বার করে বলল – ‘তবে রে শালি। দে ফোন দে।’

সদর দরজা ঠেলে স্থানীয় পুলিস অফিসার তার দলবল সহ বাড়িতে প্রবেশ করলেন। সুনীতা বললেন— ‘স্যার, আমি আপনাকে ফোন করেছিলাম। নিয়ে যান এই শিশির দাস-কে। আমার মেয়েকে ভয় দেখিয়ে তার অনেক ক্ষতি করেছে। আমার মেয়ের সঙ্গে অসভ্য আচরণ করার ভিডিও এই ফোনে আছে।’

শিশির কাকা হুমকি দিয়ে বলল – ‘তোদের মা-মেয়ে কাউকেই আমি ছাড়ব না। এর প্রতিশোধ আমি নেবই।’

সুলগ্না বলল, ‘আগে তো জেলের ঘানি টেনে এসো, তারপরে প্রতিশোধের কথা ভাববে।’

অফিসার তার দলবলকে বললেন, ‘এই লোকটাকে গাড়িতে তোলো। আর আপনারা কাল সকালে থানায় একবার দেখা করবেন।’

শিশির দাস-কে গাড়িতে তুলে নিয়ে চলে গেল পুলিস। পূর্ণিমার গোলাকার চাঁদের আলো সুনীতার বাড়িকে তখন যেন ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। সুনীতার বুকে সুলগ্না একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে অস্ফুট কণ্ঠে ডাকল— ‘মা।’ সুনীতা মেয়ের কপালে সোহাগ চুমু খেয়ে মৃদু হাসলেন।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...