তাপমাত্রার হেরফেরের সঙ্গে শরীরকে অভ্যস্ত করাটা বেশ বড়োসড়ো একটা চ্যালেঞ্জ। এই সময় শরীরের সঠিক যত্ন নিলে, রোগভোগের থেকেও রেহাই পেতে পারেন। আবার ডিহাইড্রেশন, অ্যালার্জি, ব্রণ, ঘাম কিংবা ময়লা জমে ফাংগাল ইনফেকশন, চুলকানি, ঘামাচি, র্যাশ প্রভৃতি সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় জানা থাকলে, উষ্ণতাও হয়ে উঠতে পারে উপভোগ্য।
জরুরি বিষয়
১) হাইপার হাইড্রোলিসিস অর্থাৎ শরীরের কিছু অংশে যেমন হাতের পাতা, পায়ের তলা প্রভৃতি অতিরিক্ত ঘামতে থাকে। এর ফলে অস্বস্তি তৈরি হতে থাকে। এই পরিস্থিতিতে ডার্মাটোলজিস্ট-এর পরামর্শ মতো অ্যান্টিপার্সপিরেন্ট ক্রিম ব্যবহার করতে পারেন। এতে ঘাম কম পরিমাণে নিঃসৃত হয়। এছাড়া হাত-পা বেশিবার ধোওয়ার চেষ্টা করুন। হাইজিন-এর বিষয়টি মাথায় রেখে হ্যান্ড স্যানিটাইজারও ব্যবহার করুন।
২) গরমে আন্ডারআর্মস পরিচ্ছন্ন রাখতে মুলতানি মাটির প্রলেপ লাগিয়ে কিছুক্ষণ পর ধুয়ে ফেলুন। ভিটামিন ‘ই’-যুক্ত নারকেল তেল মাসাজ করলে, আন্ডারআর্মস-এর ঘাম কমবে এবং সেই সঙ্গে দুর্গন্ধও।
৩) রোদে বেরোনোর সময় ব্যাগে অবশ্যই ওয়েট ওয়াইন্স ও সুতির রুমাল রাখুন। মুখ পরিচ্ছন্ন থাকলে র্যাশ বেরোবে না। চুলকানি, র্যাশ বা ফাংগাল ইনফেকশন রোধ করতে গোলাপজলে মুখ ধুয়ে নিন। রাতে নারকেল তেল মাসাজ করুন।
৪) কেউ কেউ বছরভর হালকা গরমজলে স্নান করতে অভ্যস্ত। এটি করা উচিত নয়। গরমকালে স্বাভাবিক জলে স্নান করুন। একান্তই যদি অভ্যাস ত্যাগ করতে না পারেন, চেষ্টা করুন বেশিক্ষণ ধরে গরমজলে স্নান না করতে। ত্বকের উপর গরমজলের ক্ষতিকারক প্রভাব পড়ে, ত্বক শুষ্ক হয়ে যায়।
৫) বেশি সময় ধরে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে না থাকার চেষ্টা করুন, কারণ এতে ত্বক শুষ্ক হয়ে গিয়ে চেহারা রুক্ষ হতে থাকে।
৬) মুখের ত্বক সজীব ও কোমল রাখতে দিনে অন্তত তিনবার জলের ঝাপটায় মুখ ধোন এবং মাইল্ড ক্লিনজারের সাহায্যে মুখ পরিষ্কার করুন।
৭) একটি গবেষণায় জানা গেছে যে, শতকরা ৯০ শতাংশ এজিং-এর সমস্যা সৃষ্টি হয় অতিরিক্ত সময় রোদে ঘুরে কাজ করার জন্য। তাই রোদে বেরোনোর আগে সানস্ক্রিন মাস্ট এবং ফিরে আসার পর স্ক্রাবার ব্যবহার করাও সমান জরুরি।
৮) গরমে পরিশ্রান্ত হয়ে এনার্জি লেভেল ড্রপ করে যায়। তাই তাজা ফলের রস নিয়মিত ভাবে পান করুন।
৯) সপ্তাহে দুবার এক চামচ মধু, ২০ ফোঁটা লেবুর রস, আধা চামচ দুধের সর, ১ চামচ দেশি ঘি ও ১ চামচ জবের ভুসি একসঙ্গে মিশিয়ে একটি পেস্ট তৈরি করে সমস্ত গায়ে লাগান। আধঘণ্টা পর ঈষদুষ্ণ গরম জলে ধুয়ে ফেলুন। তারপর ভিটামিন ‘ই’-যুক্ত ক্রিম লাগান।
১০) আপনার ত্বক যদি তৈলাক্ত হয়, দুধের সর ব্যবহার করবেন না এবং মাস্ক ধোওয়ার পর ভিটামিন ‘ই’-ক্রিমের বদলে ময়েশ্চারাইজার লাগান।
ডা. পায়েল কে রায়, প্রধান ডায়েটিশিয়ান এবং ক্রিটিক্যাল কেয়ার নিউট্রিশনিস্ট, টেকনো ইন্ডিয়া ডামা হাসপাতাল
প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় হালকা এবং সহজ পাচ্য খাবার রাখা উচিত। এই জাতীয় খাবার ফিজিক্যাল এনার্জি বজায় রাখতে সাহায্য করে। প্রচুর তাজা ফল এবং স্যালাড খান। কারণ, ফল এবং স্যালাড হজমে সাহায্য করে। তাছাড়া, এগুলিতে প্রচুর পরিমাণে জল থাকে, তাই হাইড্রেশনে সাহায্য করে শরীরকে সতেজ রাখে।
তবে, ভাজাভুজি এবং জাঙ্ক ফুড এড়িয়ে চলুন। কারণ, এগুলি হজম হতে সময় নেয় এবং মশলাদার খাবার শরীরের তাপ বাড়িয়ে দিতে পারে। এর ফলে গ্রীষ্মকাল অবিশ্বাস্য ভাবে ক্লান্তিকর হতে পারে। তাই, দ্রুত হজমে সাহায্যকারী খাবার এবং সুস্বাদু পানীয় দিয়ে নিজেকে সতেজ করার চেয়ে ভালো আর কিছুই হতে পারে না। অতএব, গরমকালে তরমুজ এবং শসা খান। সেইসঙ্গে, অ্যাসিডিটির সমস্যা না থাকলে, লেবুর জল পান করুন প্রতিদিন। মনে রাখবেন, বিভিন্ন ফলে রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা নির্দিষ্ট স্বাস্থ্য সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে।
আর তাপপ্রবাহের প্রতিকূল প্রভাব থেকে শরীরকে বাঁচাতে কিছু অতিরিক্ত পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। যেমন—
- ঠান্ডা জল দিয়ে মুখ পরিষ্কার করুন, কিন্তু বারবার নয়। নরমাল জলে মুখ ধোওয়ার পর, মুখে বরফ ঘষুন
- রোদে বেরোনোর আগে সানস্ক্রিন লোশন লাগান। এটি ত্বকের কালো দাগ এড়াতে সাহায্য করবে এবং ঘাম ও তাপ থেকে অ্যালার্জি হওয়ার সম্ভবনা কমাবে
- খাদ্যতালিকায় আরও ভিটামিন সি এবং ক্যালসিয়াম অন্তর্ভুক্ত করতে হবে
- শরীরকে ভালো ভাবে হাইড্রেটেড রাখার জন্য আরও বেশি জল বা তরল অন্তর্ভুক্ত করতে হবে
- জোজোবা তেল, ল্যাভেন্ডার তেল, রোজশিপ তেল এবং আঙুর বীজের তেলের মতো হালকা তেল গরমকালে ব্যবহার করা ভালো। কারণ, এই তেলগুলির ঘনত্ব কম, তাই রোমকূপ বন্ধ করে না, বরং ত্বককে হাইড্রেট রাখে।
ডা. এম এস পুরকাইত, মেডিকেল সুপারিনটেনডেন্ট, টেকনো ইন্ডিয়া ডামা হাসপাতাল
তাপমাত্রা ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করার কারণে, বয়স্ক এবং শিশুদের জন্য ইতিমধ্যেই দুপুরের ‘হিট অ্যালার্ট” জারি করা হয়েছে। সূর্যের রশ্মির তীব্রতা বৃদ্ধির পাশাপাশি, দুপুরে প্রচণ্ড তাপ এবং শুষ্কতা অনুভূত হচ্ছে। আর এই অস্বাভাবিক তাপপ্রবাহের কারণে হালকা জ্বর, মাথা ঘোরা, তীব্র ঘাম, বমি, ক্লান্তি এবং অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যা তৈরি হচ্ছে।
আসলে, অস্বাভাবিক তাপ-প্রবাহের কারণে শরীর থেকে তরল পদার্থের ক্ষয় হয়, যার ফলে শরীর গরম হয় এবং অস্বস্তি হতে থাকে। গত ২ সপ্তাহে, এই ধরনের সমস্যা নিয়ে অনেক রোগী ওপিডিতে এসেছেন। কেউ-কেউ আবার পেটের সংক্রমণের কারণে শরীরে জলের অভাব হওয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এর মধ্যে অজ্ঞান হওয়া, শ্বাসকষ্ট প্রভৃতি সমস্যাও দেখা দিচ্ছে। আর গর্ভবতী মহিলারা অনেকে বমির সমস্যা এবং ডায়রিয়ার সমস্যায় পড়ছেন।
অতএব, এই অস্বাভাবিক তাপপ্রবাহেও সামগ্রিক সুস্থতার জন্য যা যা করণীয়, তা হল—
- আরামদায়ক তাপমাত্রা এবং ছায়াযুক্ত অঞ্চলে থাকার চেষ্টা করুন এবং ঠান্ডার জায়গায় ভ্রমণ করুন
- ORS এবং গ্লুকোজ-জল গ্রহণের পরিমাণ বাড়ান
- ঢিলেঢালা এবং হালকা রঙের পোশাক পরুন, যাতে অস্বস্তি এড়াতে পারেন এবং আপনার শরীর শ্বাস নিতে পারে
- মাথার উপর তাপ এড়াতে আপনার মাথা সুরক্ষিত রাখুন। রোদে বেরোলে টুপি এবং ছাতা ব্যবহার করুন
- ঠান্ডা জল বহন করুন এবং সারাদিনে ৩-৪ লিটার জল পান করুন
- গরমকালে অ্যালকোহল এড়িয়ে চলুন এবং হালকা খাবারের উপর নির্ভর করুন। ফল খান বেশি পরিমাণে
- খুব প্রয়োজন না হলে দুপুরে রোদে বেরোবেন না
- তীব্র গরমে ভারী ব্যায়াম এড়িয়ে চলুন, বিশেষকরে যাদের শ্বাসকষ্ট আছে। পরিবর্তে, বেশি গরমে হালকা ব্যায়াম করুন।
(সমাপ্ত)