কালীপদবাবু ছাপোষা মানুষ, একটা ছোটোখাটো প্রাইভেট কোম্পানিতে কেরানির চাকরি করেন। বিয়ে করেননি, একা মানুষ। থাকেন বাগবাজারের পৈতৃক বাড়িটাতে আর থাকে এক ঘর ভাড়াটে। শরিকি বিবাদে দীর্ঘদিন বাড়িটাতে কোনও রক্ষণাবেক্ষণ হয়নি। শুধু একটা দিক কোনওমতে এখনও টিকে আছে।

ওর শখের মধ্যে শুধু পুরোনো গ্রামোফোন রেকর্ড সংগ্রহ করা। খুঁজে পেতে নানা পুরোনো রেকর্ড কিনে আনেন ওয়েলিংটন, সদর স্ট্রিট বা ফ্রি স্কুল স্ট্রিট থেকে। প্রায় সারাদিনই বাবার আমলের পুরোনো রেকর্ড-প্লেয়ারটায় সেসবই চালান। ভীমসেন যোশী, পাহাড়ী সান্যাল, গীতা দত্ত, পিট সিগার বা পালুসকরের গান তাকে নিয়ে যায় কোনও না-পাওয়া স্বর্গরাজ্যে।

আজ মাসের প্রথম দিন। মাইনে পেয়েই কালীপদবাবু ঠিক করলেন লেনিন সরণিতে একবার ঢু মারবেন জামালউদ্দিনের দোকানে। যদি কিছু মণিমুক্তো পাওয়া যায় কম দামে। দু-তিন হাজার টাকা খরচা করে দুর্লভ অ্যান্টিক রেকর্ড কেনার সামর্থ্য তার নেই। তবু চোখের দেখা। গিয়ে দেখেন জামালের দোকান সেদিন বন্ধ। ওরও বাপ ঠাকুরদার ব্যাবসা। আজকাল সব পেন ড্রাইভ, মোবাইল আর ইউটিউবের যুগ। বিক্রিবাটা প্রায় নেই বললেই চলে। তবুও কী যে মায়া-ভালোবাসা জড়িয়ে আছে পুরোনো দিনের স্মৃতি ঘিরে, ওই জানে, আর জানেন কালীপদবাবু।

যা হোক চলেই যাচ্ছিলেন, হঠাৎ একটা ফ্যান্সি আইটেমের দোকানে চোখ পড়ল রাস্তায়। কত সুন্দর সুন্দর ঘড়ি, শোপিস, সিগারেট কেস, টর্চ, লাইটার, নানারকম বিদেশি জিনিস ধরে থরে সাজানো দেখে, বেশ লোভ লেগে গেল কালীপদবাবুর। একটা পেনের দিকে তার নজর পড়ল, হাতে নিয়ে বেশ পছন্দ হল। চকচকে কালো মেটালিক ফিনিশ, সঙ্গে গোল্ডেন টিপ আর হ্যান্ডেল। কিন্তু যেখানে চোখ আটকে গেল সেটা আর কিছুই নয়, কালোর উপরে গোল্ডেন কালারে খোদাই করা ইংরেজিতে ‘কালি’ নামটা, তার নামের সঙ্গে তো বেশ মিলে যাচ্ছে। হতে পারে কোম্পানির নাম।

দোকানিকে জিজ্ঞেস করতে বলল জাপানি পেন, দেড়শো টাকা দাম। কিন্তু ওই চকচকে কালো রঙের পেন আর ওই স্বর্ণাক্ষরে লেখা ‘কালি’র মোহে ততক্ষণে পড়ে গেছেন কালীপদবাবু। দরদাম আর বেশি না করে, পেনটি পকেটস্থ করলেন। মনটা তার বেশ প্রফুল্ল হয়ে গেল, এতদিনে মনের মতো একটা পেন পেলেন। এমন একটা মহার্ঘ জিনিস যে হঠাৎ করে এইভাবে হস্তগত হয়ে যাবে, তা তিনি ভাবতেও পারেননি। ঠিক করলেন, এবার থেকে এই পেনটাই সবসময় ব্যবহার করবেন, অফিসের কাজে হোক বা বাড়িতে শখের কবিতা লেখাতেই হোক৷

পাড়ায় ঢুকতেই হঠাৎ দেখা হয়ে গেল পুরোনো বন্ধু অনুপের সঙ্গে। “কি রে কালী, কোথায় গেছিলি?’ নিজেই এগিয়ে এসে কথা বলল অনুপ৷

একবার শ’পাঁচেক টাকা ধার নিয়ে আর এ তল্লাট মাড়ায়নি অনুপ, কথাবার্তাও হয়নি দীর্ঘদিন। পথে-ঘাটে দু’একবার দেখা হলেও এড়িয়ে চলত। সেই অনুপই আজ নিজে এসে পকেট থেকে পাঁচশো টাকা ফেরত দিয়ে দেঁতো হেসে বলল, “কিছু মনে করিস না রে ভাই, সেই কবে থেকে তোকে টাকাটা দেব দেব করেও দেওয়া হয়নি। একটি ফাস্ট ফুডের স্টল দিয়েছি, ভালোই চলছে।”

—তাই নাকি? ভালোই করেছিস, তা আসিস একদিন বাড়িতে। যা দিনকাল পড়েছে। আজ আছি, কাল নেই। বলে এগোলেন কালীপদবাবু।

বাড়িতে ঢুকতে গিয়েই চমক, একটা বড়োসড়ো খাম এসে পড়ে আছে। খুলে দেখেন, সেই কবে একটা কবিতা পাঠিয়েছিলেন নামী পত্রিকায়। এতদিন কোনও খবরই ছিল না। ভেবেছিলেন হয়তো মনোনীত হয়নি। হঠাৎ সেই পত্রিকাই আজ এতদিন পরে ছেপেছে কবিতাটা। আজকাল ফেসবুকের যুগে বাংলা বই পড়ার লোকজন এত কমে গেলেও, এই পত্রিকাটি ছাপা পত্রিকা বের করছে কষ্ট করে। পত্রিকার সঙ্গে একটা হাজার টাকার চেকও পাঠিয়ে দিয়েছে। পরপর এতগুলো প্রাপ্তিযোগে কালীপদবাবু একেবারে দিশাহারা হয়ে গেলেন। হাওয়ায় যেন তিনি ভাসছিলেন!

বিকেলে ইজিচেয়ারে বসে, তিনি একটা কবিতা লিখে ফেলবেন ঠিক করলেন। মনটা আজ বেশ উড়ু উড়ু। কথারা ঝাঁক বেঁধে আসছে। তার উপর নতুন পেন। পেনটা বের করেই খেয়াল হল, আচ্ছা পেনটা বেশ পয়া তো!

সবে ভাবটা এসেছে, দু-এক লাইন লিখেছেন, তখনই সবিতা আসে চা নিয়ে, সঙ্গে আজ পিঁয়াজি-মুড়ি। ওপাশে ভাড়া থাকে ওরা। সবিতার মা-ই মাঝেমধ্যে বিকেলে চা-টা পাঠিয়ে দেয়। তবে আজকাল এ বাড়ি ও বাড়ি মানুষজনের যাওয়া আসা প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে, সবাই মোবাইলে ব্যস্ত।

—কী রে আজকে দারুণ ব্যাপার যে, দে দে। হঠাৎ পেঁয়াজি ভাজল তোর মা! বলেই ফেলেন তিনি।

—না গো জেঠু, আজ বাবা ফিরেছে না দিল্লি থেকে বোনাস পেয়ে, তাই বাড়ির সবাই খুব খুশি। তোমার ছ’মাসের বাকি বাড়িভাড়াও পাঠিয়ে দিয়েছে মা। এই নাও। বলে একটা খাম বাড়িয়ে দেয় সবিতা।

নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না বাক্যহারা কালীপদবাবু। কী সব হচ্ছে আজকে! এত সব ভালো ভালো ব্যাপার একদিনেই ঘটছে কী করে? তিনি স্বপ্ন দেখছেন না তো? চিমটি কাটতে গিয়ে বিস্তর লাগল, বুঝলেন সব সত্যি। সবিতা চলে যেতে তিনি সকাল থেকে হয়ে যাওয়া ঘটনাগুলো পরপর ভাবতে লাগলেন। সবই তার পাওনা ছিল কিন্তু আটকে ছিল। একদিনে সব একসঙ্গে হওয়াটা কি স্রেফ কাকতালীয়? ভাগ্যের চাকা হঠাৎ এইভাবে ঘুরে গেল? কালীপদবাবু আদর করে পেনটায় হাত বোলাতে লাগলেন, সঙ্গে পিঁয়াজিতে কামড়। হঠাৎ দরজায় কে যেন কড়া নাড়ল।

—কে? বলে গেঞ্জিটা পরে দরজাটা খুলতে গেলেন। ওদিক থেকে কে যেন বলে উঠল ‘মামা, আমি’।

দরজা খুলে দেখেন বড়দির ছেলে সুবিমল। ওদের সঙ্গেই তো শরিকি মামলাটা চলছে। বাড়িটা এতদিন এভাবে পড়ে আছে, না বিক্রি হচ্ছে, না সারানো যাচ্ছে। সেই সুবিমল এই সময়!

—কীরে, কী ব্যাপার? হঠাৎ ?

—না গো মামা। এই এলাম আর কী। অনেকদিন আসা হয় না তো। তা বাড়িটার কী দশা হয়েছে গো? সুবিমল বলে।

—হবে না? কী করব বল।

কোর্ট-কাছারি, মামলাতেই তো সব আটকে আছে, জানিস তো।

—সেই জন্যই তো এলাম মামা। আমরা মামলা তুলে নিয়েছি। এই নাও কোর্টের কাগজ। বাড়ি এখন থেকে তোমার, তুমি যা করার করবে। সুবিমল এক নিঃশ্বাসে বলে কথাগুলো।

—সে কী রে? হঠাৎ কী মনে করে! আয় আয় ঘরে এসে বোস। কালীপদবাবুর গলায় উৎফুল্লতা।

—না গো মামা, ভিতরে আর ঢুকব না। আজ রাতেই ফ্লাইট। জানো, আমার ইউকেতে পোস্টিং হয়ে গেছে। বাবাও মারা গেল, কোর্ট কাছারি করে কী আর হবে! আর এইসব মামলা-মোকদ্দমা ভালো লাগছে না। মা যতদিন বেঁচেছিল, মা-ও তো চায়নি। সুবিমল সব কাগজপত্র দিয়ে চলে গেল।

—এ-ও হয়! এ যে মেঘ না চাইতেই জল। বাড়ির মামলা তাহলে মিটল। এবারে বাড়িটাকে মনের মতো করে সারানো যাবে। তিনিই এখন মালিক, বিক্রিও করে দিতে পারেন, করলে অবশ্য সবাইকে ভাগ দেবেন। অনেকদিন ধরে তেওয়ারি বলে একটা প্রোমোটার ছুঁকছুঁক করছে। তিনি ভালো করেই জানেন এ বাড়ি বিক্রি করলে কোটি খানেকের বেশি টাকা পাওয়া যাবে।

খুশিমনে কালীপদবাবু আবার ইজি চেয়ারটায় এসে বসলেন। সামনে সাদা পাতাটা খোলা আর তার উপর পেনটা রাখা। আর কবিতা লেখা হল না। আলগোছে পেনটাকে হাতে তুলে নেন তিনি, অদ্ভুত তো পেনটা! এটার মধ্যে কি জাদু আছে? কেনার পর থেকেই তো একের পর এক সুখবর! পেনটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে থাকেন কালীপদবাবু।

পরদিন সকালে কাজের মেয়ে কলি বারবার দরজা ধাক্কা দিয়েও কোনও সাড়া পেল না। একা থাকে মানুষটা, কী হল! লোকজন ডেকে আনল সে। দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকতেই খাটে শোওয়া অবস্থায় কালীপদবাবুকে পাওয়া গেল। শরীরটা প্রাণহীন, ঠান্ডা অথচ মুখে কী সুন্দর একটা হাসির রেখা লেগে আছে।

ডাক্তার এসে দেখে বলল, ঘুমের মধ্যেই হার্ট অ্যাটাক। মৃত্যুকে যেন তিনি আলিঙ্গন করে নিয়েছেন খুশি মনে, হাসতে হাসতেই। ডান হাতে তখনও মুঠো করে কী একটা ধরা… কলি দেখে একটা কালো পেন। ইভিনিং স্কুলে পড়ে কলি, পেন সে-ও ভালোবাসে। কৌতূহলবশত চুপিচুপি পেনটা নিজের হাতে নিয়ে দেখে ওরই নাম লেখা আছে পেনটাতে ‘কলি’। অদ্ভুত তো! লোভ সামলাতে পারে না কলি। এ মাসের মাইনেটা তো গেল, কলি পেনটা ব্লাউজে গুঁজে বিলাপ করে কেঁদে ওঠে।

ওদিকে ঘরে তখনও লং প্লেয়িং রেকর্ডটা কীসের যেন দুঃখে বিদীর্ণ হয়ে কেটে গিয়ে, বেজে চলেছে নজরুলের গাওয়া গানখানি ‘ঘুমিয়ে গেছে শ্রান্ত হয়ে আমার গানের বুলবুলি’।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...