স্বামী-স্ত্রী দুজনেই শিক্ষিত এবং রুচিসম্পন্ন মানুষ। জীবনে স্বচ্ছলতার অভাব নেই। অভাব শুধু দুটি কচি হাতের আদরের। বিয়ের পাঁচ বছর বাদেও ওরা কেউ মা-বাবা ডাক শুনতে পাননি। আত্মীয় পরিজনেরা যে যেমন বলেছে, তেমনটি করেছেন। জ্যোতিষ, ঠাকুরের কাছে মানত কোনও কিছুই বাদ যায়নি। নিজেরা তাবিজ মাদুলিতে বিশ্বাস না করলেও, গুরুজনদের মুখ চেয়ে সবকিছু চুপচাপ মেনে নিতে হয়েছে।

আসলে, মা হওয়ার আকাঙক্ষায় মেয়েরা বোধহয় সবকিছুতেই বিশ্বাস রাখেন। আর যখন বিফল হন, তখন সবকিছুই ভাগ্যের হাতেই ছেড়ে দেন।

অনেক দম্পতি আছেন, যাদের মেডিকেল টেস্ট-এ তেমন ভাবে কোনও শারীরিক ত্রুটিবিচ্যুতি ধরা পড়েনি, তবু তাদের কোল শূন্য। বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আজ আইভিএফ অর্থাৎ ইনভিট্রোফার্টিলাইজেশন-এর সাহায্যে কৃত্রিম উপায়ে সন্তান ধারণ করা সম্ভব হচ্ছে। নিঃসন্তান দম্পতিদের কাছে এটা একটা বড়ো আশীর্বাদ।

কে না চায় সন্তান সুখ

যে-কোনও মানুষের দুর্বলতম স্থান হচ্ছে নিজের সন্তান। এবিষয়ে বিখ্যাত মানুষের যে অনুভূতি, সেই একই অনুভূতি সাধারণ মানুষ তথা ভিখারিরও। নিজের সন্তানের জন্য মা-বাবা করতে পারে না হেন কাজ নেই। যারা নিঃসন্তান দম্পতি তারা সন্তানকামনায় কী না করে।

পুরাকালে অযোধ্যার রাজা দশরথ পুত্রলাভের জন্য যজ্ঞ করেন। এ কাহিনি প্রায় সকলেই জানে। আমাদের বাঙালিদের বারো মাসের ব্রতকথায়ও সন্তান কামনায় অনেক বার-ব্রতর প্রচলন আছে। ঈশ্বরী পাটনির বিখ্যাত উক্তি আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে। যার সন্তান নেই, সেও কামনা করে সন্তানের সাফল্য।

আজকের মেডিকেল সায়েন্স জানাচ্ছে, প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ৬ জন মানুষ সন্তানহীনতার শিকার হয়। আরও জানা গেছে, প্রতি ৮ জনের মধ্যে এক দম্পতি দুবছরের মধ্যে সন্তান ধারণ করতেই পারে না। কিন্তু চিকিত্সা বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে ৭৫ শতাংশ দম্পতি বিবাহের এক বছরের ভিতরে এবং ৮৮ শতাংশ দম্পতি আধুনিক চিকিত্সা পরিষেবা নিয়ে সন্তানলাভ করছেন।

নিঃসন্তান হওয়ার কারণ

আজকের আধুনিক লাইফস্টাইল কিংবা দূষিত পরিবেশ সব কিছুরই প্রভাব পড়ছে শরীরের উপর। চাপা টেনশন কিংবা নিদ্রাহীনতার ফলে ধীরে ধীরে মানব শরীরের স্বাভাবিক সুস্থতা অনেক কমে যাচ্ছে, ফলে দেখা দিচ্ছে নানা ধরনের সমস্যা। আমাদের খাদ্যাভ্যাস শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তনের মূল কারণ। ফাস্ট ফুড, জাংকফুড, শরীরের প্রত্যঙ্গগুলোকে করে তুলছে দুর্বল। ফলস্বরূপ জন্ম হচ্ছে বিকলাঙ্গ শিশুর।

দূষণের কারণে দুই শতাংশ মানুষ হচ্ছে নপুংসক। শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে দম্পতিরা জেনে যায় শিশুটি সুস্থ হয়ে পৃথিবীর আলো দেখবে কিনা? সুস্থ সবল সন্তান ধারণ না করতে পারলে জীবনটাই বৃথা। তাই কৃত্রিম উপায়ে সন্তানধারণের জন্য আইভিএফ এখন প্রচলিত উপায়। কৃত্রিম উপায়ে সন্তানধারণ সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় নিঃসন্তান দম্পতিদের কাছে। কিন্তু এই প্রক্রিয়া-পদ্ধতি এখনও সব দম্পতির কাছে খুব স্বচ্ছ নয়।

নিঃসন্তান দম্পতিদের সকলের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি কার্যকরী না হতেও পারে। ৩০-৪০ শতাংশ মানুষের জন্য এই প্রক্রিয়া কার্যকরী। আইভিএফ পদ্ধতিতে সন্তানধারণ বেশ খরচসাপেক্ষও বটে। তবে সন্তানলাভের আশায় দম্পতি এবং তার পরিবার অর্থব্যয় করতে কার্পণ্য করে না। আজ দিল্লি, মুম্বই, কলকাতার মতন বড়ো শহরেই শুধু নয়, গাজিয়াবাদ, লুধিয়ানার মতন ছোটো শহরেও আইভিএফ সেন্টার গড়ে উঠেছে। এদের আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন, লোভনীয় স্বপ্নপূরণের হাতছানি নিঃসন্তান দম্পতিদের প্রলুব্ধ করবেই।

রাজধানী দিল্লিতে রয়েছে প্রায় চল্লিশটির মতন আইভিএফ সেন্টার। প্রতিদিন এইসব সেন্টারে কৃত্রিম উপায়ে সন্তানলাভের আশায় নিজেদের পরীক্ষানিরীক্ষা করানোর জন্য আসেন বহু নিঃসন্তান দম্পতি।

না জানার বিপত্তি

আইভিএফ পদ্ধতি সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা থাকা প্রয়োজন। মানুষ সন্তানের আশায় ছোটে। সবাই আশায় বুক বাঁধে যদি আমি সন্তানলাভ করি, যদি ঈশ্বর সদয় হন, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু শারীরিক ত্রুটি-বিচ্যুতি, মহিলা কিংবা পুরুষের শরীর কী ধরনের তার উপর নির্ভর করে সন্তান উত্পাদনের ক্ষমতা। সচরাচর মহিলাদের মধ্যে যে-ধরনের সমস্যা দেখা যায় তা হল-

  • ফ্যালোপিয়ান টিউবে কোনও সমস্যা
  • ওভারিতে সিস্ট
  • হর্মোনাল ডিসব্যালেন্স
  • নিষিক্ত ডিম্বাণু পরিণত না হওয়া।

এছাড়াও ১০ শতাংশ মানুষের অজ্ঞাত কারণে সন্তান লাভ হয় না। মেডিকেল টেস্টে সব ঠিক থাকলেও সন্তানধারণ করতে সক্ষম হয় না বহু সংখ্যক মহিলা। শুক্রাণু ঠিকমতন নিষিক্ত হলেও তিন-চার মাস পর্যন্ত গর্ভধারণ করার পর অজানা কারণে অনেক মহিলার গর্ভপাত হয়ে যায়। বারংবার এ ধরনের ঘটনা মহিলাকে শারীরিক এবং মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে।

কিছু কিছু পুরুষ শরীরে শুক্রাণুর পরিমাণ কম থাকে। এটাই সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। তবু সন্তানের আশায় ঠিক কবে থেকে আইভিএফে চিকিত্সা করানো উচিত, তা বুঝতে বুঝতে কখনও বা অনেক দেরি হয়ে যায়।

স্বামী-স্ত্রী মোটামুটি এক-দেড় বছর অপেক্ষা করে মা-বাবা হতে চান। আবার কেরিয়ারিস্ট দম্পতিরা পাঁচ-ছয় বছরের প্ল্যানিং নিয়ে চলেন।

আইভিএফ বিশেষজ্ঞ

বিশেষজ্ঞদের মত অনুযায়ী, এক-দুই-তিনবার এই পদ্ধতির প্রয়োগ করা উচিত মহিলাদের শরীরে, নয়তো অন্য বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তবে এই আইভিএফ শুধুমাত্র একজন বিশেষজ্ঞের কাজ নয়। এটি একটি টিমওয়ার্ক। একজন গাইনিকোলজিস্ট, একজন এমব্রয়োলজিস্ট, একজন হরমোন বিশেষজ্ঞ এবং একজন আল্ট্রাসাউন্ড বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন হয়। সর্বোপরি সার্জন তো আছেই। জটিলতা দেখা দিলে তবেই সার্জনের প্রয়োজন।

মহিলাদের শারীরিক জটিলতার তুলনায় পুরুষদের জটিলতা অনেক বেশি। শুনতে অবাক লাগলেও পুরুষরা চট করে নিজেদের পরীক্ষা করাতে আসতে সংকোচ বোধ করেন। স্বাভাবিক ভাবে সন্তান উত্পাদনে অক্ষম হলেও, পুরুষরা প্রথমে স্ত্রীদের এগিয়ে দেন পরীক্ষা করার জন্য।

খরচ

আইভিএফ পদ্ধতি যথেষ্ট খরচসাপেক্ষ। যখন দম্পতিরা ওষুধ, অপারেশন সব ধরনের পরীক্ষানিরীক্ষা করেও হতাশ, তখন আইভিএফ-এর দিকে ঝোঁকে। মোটামুটি খরচ লক্ষাধিক। ১৯৭৮ সালে লন্ডনে প্রথম আইভিএফ পদ্ধতিতে সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়। ১৯৯৮ সালে অর্থাৎ কুড়ি বছর বাদে দিল্লিতে প্রথম আইভিএফ-আইসিএসআই (In Vitro Fertilization-Intracytoplasmic Sperm Injection) শিশুর জন্ম হয়। আশার কথা এই যে, ভারতের মাটিতে এই পদ্ধতির খরচ লক্ষাধিক হলেও, ইউএস কিংবা ইউকে-র থেকে অনেক কম। তাই বিদেশি দম্পতিরা ভারতে আসছেন, রিপ্রোডাকটিভ টুরিজিমের জনপ্রিয়তাও বাড়ছে। যাইহোক, আশার কথা এই যে, নিজের উত্তরাধিকারের জন্য দম্পতিরা ধীরে ধীরে স্বাগত জানাচ্ছেন আইভিএফ বা ইনভিট্রো ফার্টিলাইজেশন পদ্ধতিকে।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...