দীপাবলি একটি জনপ্রিয় উৎসব, যা সারা বিশ্বে উদযাপিত হয়। আলোক উৎসব নামেও পরিচিত এই উৎসব কার্তিক মাসের অমাবস্যার রাতে উদযাপিত হয়। এই উৎসবে শহর ও গ্রামগুলি প্রদীপের আলোয় আলোকিত হয় এবং আকাশ জুড়ে আতশবাজি ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু সমস্ত উৎসাহ এবং আনন্দের মধ্যেও, এই সময় এমন সতর্ক থাকা উচিত, যাতে আপনার এবং অন্য কারওর কোনও ক্ষতি না হয়।

দিশা আই হসপিটাল-এর কনসালট্যান্ট পেডিয়াট্রিক এবং কমপ্রিহেনসিভ অপথালমোলজি সার্ভিসেস-এর ডা. আঁচল মিত্র-র পরামর্শ—
সতর্কতা
- যদি কোনও স্প্লিন্টার (অথবা গরম এবং জ্বলন্ত কিছু) চোখে পড়ে, তাহলে দ্রুত (কয়েক সেকেন্ড-এর মধ্যে) পরিষ্কার জল দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। কলের জল, পানীয় জল— যে কোনও পরিষ্কার জল চলবে। সম্ভব হলে আপনি বরফ বা ঠান্ডা কম্প্রেসও লাগাতে পারেন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ মতো উপযুক্ত চিকিৎসা করাও দরকার।
- আলোর উৎসবের এই সময় সাধারণ চশমা (পাওয়ার ছাড়া) পরা উচিত, যা আপনার চোখকে সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করবে। যখন বিপজ্জনক উপায়ে পটকা ফাটানোর চেষ্টা করে কেউ, তখনই দুর্ঘটনা ঘটে। এটি অত্যন্ত বোকামি। অনেক সময় দেখা যায়, কোনও পটকা প্রথমে ফাটে না এবং তারপরে কেউ আবার এটি জ্বালানোর চেষ্টা করে, তখন অনেক সময় এটি হঠাৎ মুখে কিংবা হাতে ফেটে যায়। বছরের পর বছর ধরে দীপাবলির সময় এগুলি শত শত গুরুতর আঘাতের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং এগুলি নিষিদ্ধ করা উচিত।
- শব্দের প্রভাব কিংবা অতিরিক্ত শব্দের জন্য কাচের বোতল, টিন, বাক্স, অথবা মাটির পাত্র দিয়ে বাজি ঢেকে রাখবেন না। এগুলো ফেটে ছোটো ছোটো টুকরো হয়ে যেতে পারে এবং আশেপাশে উড়ে যাওয়ার সময় আপনার চোখকে চিরতরে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। আকাশের নীচে খোলা জায়গায় এগুলো ফাটান।
- যেসব বাজি ফাটেনি, তার কাছে যাবেন না। দূর থেকে দেখলে দ্রুত নিভিয়ে ফেলার চেষ্টা করুন।
- যদি আপনি কন্টাক্ট লেন্স পরে থাকেন, তাহলে বাজি ফাটাতে যাবেন না, কারণ দীর্ঘ সময় ধরে উচ্চ তাপে রাখলে কন্টাক্ট লেন্সযুক্ত চোখ দুটিকে, চোখে জ্বালা হতে পারে এবং বড়ো ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।
- চোখে আঘাত লাগলে চোখ ঘষবেন না কিংবা চোখে এবং চোখের আশেপাশের অংশে হলুদ গুঁড়ো, নারকেল তেল ইত্যাদির মতো ঘরোয়া প্রতিকার ব্যবহার করবেন না। চোখের ভিতরে যদি কোনও ক্ষুদ্র কণা থাকে, তাহলে ঘষলে আরও খারাপ হতে পারে। পরিবর্তে, প্রায় ১০ মিনিট ধরে পরিষ্কার জল দিয়ে চোখ ধুয়ে ফেলুন এবং তারপরে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
- রঙ্গোলি তৈরির পর বা আতশবাজি ধরার পর চোখ স্পর্শ করার আগে সবসময় হাত ধোয়া বা সাবান দিয়ে ভালো করে ধুয়ে নিতে ভুলবেন না। রং, চক পাউডার, পটকায় থাকা বারুদ এবং রাসায়নিক পদার্থ চোখে জ্বালা, চুলকানি এবং কিছু ক্ষেত্রে অপূরণীয় ক্ষতি করতে পারে।
- আতশবাজি দেখতে আকর্ষণীয় এবং উজ্জ্বল হলেও, এগুলি থেকে দূরে থাকাই ভালো। ছোটো বাচ্চাদের পটকা জ্বালাতে দেবেন না। যদি তারা পটকা ফাটায়, তাহলে বড়োদের উপস্থিতি এবং সতর্কতা আবশ্যক।

টেকনো ইন্ডিয়া ডামা হাসপাতাল-এর মেডিকেল সুপারিনটেনডেন্ট ডা. এমএস পুরকায়েত-এর পরামর্শ—
দীপাবলি হল আলোর উৎসব। কিন্তু এখন এটি বায়ু দূষণ এবং শব্দ দূষণের একটি বিশাল উৎসে পরিণত হয়েছে। কিছু মানুষের বোকামোর কারণে, ব্রঙ্কিয়াল অ্যাজমা, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ(সিওপিডি), হৃদরোগীদের জন্য অনেক সময় সমস্যা সৃষ্টি করে এই উৎসব।
সতর্কতা
- দীপাবলির সময় আমরা যে সবচেয়ে সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যাগুলি দেখতে পাই, তা হল—পুড়ে যাওয়া। এই বিপদ এড়ানোর জন্য উচিত খাঁটি সুতির পোশাক পরা। কারণ সিন্থেটিক কাপড়ে সহজেই আগুন ধরে যায়। পায়ে পোড়া আঘাত এড়াতে পা সম্পূর্ণ ঢেকে রাখা (শু-জাতীয়) জুতো পরা উচিত।
- দীপাবলির সময় মোমবাতি বা প্রদীপ জ্বালালে বায়ু দূষণ অনেকাংশে রোধ করা যায়। অথবা রঙিন LED আলো ব্যবহার করতে পারেন। বায়ু দূষণের ফলে চোখ, নাক, গলা, ত্বকে জ্বালাপোড়া হতে পারে, যার ফলে চোখে জল আসে, হাঁচি, শুষ্ক কাশি হয়। এটি ব্রঙ্কিয়াল অ্যাজমা বা সিওপিডির লক্ষণগুলিকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে, যার ফলে শ্বাসকষ্ট হতে পারে। রোগীরা ফেস মাস্ক ব্যবহার করতে পারেন। নাকের স্প্রে এবং অ্যালার্জির মতো ওষুধ মজুত রাখাও বাঞ্ছনীয়।
- ইকো-ফ্রেন্ডলি পটকা ফাটানো, সাধারণ পটকার চেয়ে ভালো। কারণ এটি কম দূষণ সৃষ্টি করে এবং ১২৫ ডেসিবেলের কম শব্দ উৎপন্ন করে। বেশি শব্দ উৎপন্নকারী পটকা শ্রবণশক্তি হ্রাস, মাথাব্যথা, উদ্বেগ, উচ্চ রক্তচাপ বা হৃদরোগের অবনতি ইত্যাদির কারণ হতে পারে।
- শ্বাসনালী হাঁপানি, সিওপিডি বা হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীদের জন্য সন্ধ্যার সময় ঘরে থাকা ভালো। কারণ বাজি থেকে নির্গত গ্যাস গ্রহণ করলে লক্ষণগুলি আরও বেড়ে যেতে পারে। রোগীদের ইনহেলারের মতো প্রয়োজনীয় সমস্ত ওষুধও মজুত রাখা উচিত।
- এই সময়কালে বাইরের ব্যায়াম করা এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেওয়া হয়, কারণ দূষণের মাত্রা বেশি থাকে এই সময়।
- এই সময়ে শিশুদের বাইরের কার্যকলাপ সীমিত করারও পরামর্শ দেওয়া হয়।
- প্রত্যেকেরই নিজেদের সঠিক ভাবে হাইড্রেটেড থাকা উচিত। ডিসলিপিডেমিয়া বা ইস্কেমিক হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীদের ভাজা খাবার এবং ঘি জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলা উচিত। ডায়াবেটিস মেলিটাসে আক্রান্ত রোগীদের দীপাবলির সময় আমরা যে মিষ্টি বিনিময় করি, সেইসব মিষ্টি এড়িয়ে চলা উচিত।

টেকনো ইন্ডিয়া ডামা মাল্টিস্পেশালিটি হাসপাতালের ডায়েটিক্স বিভাগ এবং ক্রিটিক্যাল কেয়ার-এর পুষ্টিবিদ (HOD) ডা. পায়েল কৃষ্ণ রায়-এর পরামর্শ —
- বাংলায় ভূত চতুর্দশী এবং চোদ্দো শাক খাওয়ার রীতি বাংলার সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি অপরিহার্য অংশ। বাংলায় আলোর উৎসবের আগে ভূত চতুর্দশী পালন করা হয় এবং ১৪টি প্রদীপ জ্বালিয়ে এবং চোদ্দো শাক খাওয়ার মাধ্যমে এই রীতি পালন করা হয়, যা ১৪টি শাক দিয়ে তৈরি একটি খাবার। এগুলি সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
- আসলে, ১৪টি শাক খাওয়া হয়, কারণ এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং শীতকালে শরীরকে সুস্থ রাখে। পালং শাক থেকে শুরু করে কুমড়োর পাতা পর্যন্ত শাক ভিটামিন এবং খনিজ সমৃদ্ধ, যা পুষ্টিকর খাবারের মধ্যে পড়ে।
- ১৪ শাক খাওয়ার ঐতিহ্য শীতকালে ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কারণ, এই সময়কালে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রায়ই দুর্বল হয়ে পড়ে, যা মানুষকে অসুস্থ করে তোলে। ১৪ শাকে ব্যবহৃত পাতা শারীরিক সুস্থতা নিশ্চিত করে। এই খাবারটি পুষ্টিতে সমৃদ্ধ এবং এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় বলে বিশ্বাস করা হয়, যা আবহাওয়ার পরিবর্তনের সময় শরীরকে মৌসুমী অসুস্থতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে। অনেক সবুজ শাক শরীরের জন্য প্রাকৃতিক বিষমুক্তি মাধ্যম হিসেবে কাজ করে।
- বিভিন্ন ধরণের সবুজ শাক একত্রিত করে তৈরি খাবার হিসেবে, ১৪ শাক ভিটামিন এবং খনিজ পদার্থের একটি চমৎকার উৎস, যার মধ্যে রয়েছে ফলিক অ্যাসিড, ভিটামিন সি, ভিটামিন কে, আয়রন, ক্যালসিয়াম এবং পটাসিয়াম।
- শাকসবজিতে দ্রবণীয় এবং অদ্রবণীয় উভয় ধরণের ফাইবার থাকে, যা হজমে সহায়তা করে, কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করে এবং অন্ত্রের স্বাস্থ্য উন্নত করে।
- শাকসবজিতে উচ্চ মাত্রার অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং যৌগ থাকে, যা প্রদাহ-বিরোধী এবং অ্যান্টিহিস্টামিন প্রভাব প্রদান করে।
- শাকসবজি রক্তচাপ কমাতে, রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে এবং কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করতে পারে, যা হৃদপিণ্ড এবং বিপাকীয় স্বাস্থ্যের উন্নতি নিশ্চিত করে।
- সবুজ শাকসবজিতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন থাকে, যা ত্বকের জন্য উপকারী, ফুসকুড়ি এবং ব্রণ প্রতিরোধে সাহায্য করে। ক্যারোটিনয়েড এবং অন্যান্য পুষ্টি উপাদান চোখের স্বাস্থ্য রক্ষা করতেও সাহায্য করে।