কতকাল হল আকাশের গায়ে কোনও কথা দানা বাঁধছে না। এই আবছায়া সন্ধ্যাটাকে বড়ো অপরিচিত মনে হচ্ছে সুমনের। সে এখন যেখানে বসে আছে সেখান থেকে রান্নাঘরটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। আধুনিক এই ফ্ল্যাটের রান্নাঘর দরজাবিহীন। তাই যিনি রান্না করছেন তাঁর পিছনটা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে সুমন। ছেড়ে দেওয়া কালো চুল মহিলার কোমর পর্যন্ত নেমে এসেছে। তার সরু কোমর, গায়ের রং, ঈষৎ মেদবহুল নিটোল স্বাস্থ্য— থেকে থেকে সুমনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার ভদ্রমহিলাকে সুমন ঠিক চিনে উঠতে পারছে না। সে এখন এখানে কী করছে সেটাও সে বুঝতে পারছে না। আসল কথা সম্ভবত আকাশের গায়ে কোনও কথা দানা বাঁধছে না!

যে আরামদায়ক সোফাটায় সুমন বসেছিল, সেখান থেকে ব্যালকনিটা দেখা যায় না। সুমন সোফা ছেড়ে ব্যালকনিতে এল। এখান থেকে শহরটার বহুদূর দেখা যায়। তার মনে হল, এই শহরটাকে সে বহুবার দেখেছে। কিন্তু তবুও সে এই শহরটাকে চিনতে পারছে না। আকাশ থেকে টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। তার এক ফোঁটাও সুমনের গায়ে লাগছে না। বহুতল ফ্ল্যাটের নিরাপদ আশ্রয়ে বৃষ্টি ঢুকতে পারে না।

কয়েকদিন ধরেই কেমন একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছে সুমন। সে বুঝতে পারছে সে আছে। কিন্তু কোথায় আছে, সেখানে সে এল কেমন করে, সেটা তার কিছুতেই মনে পড়ছে না। তার যতটুকু মনে পড়ছে শেষবার সে ছিল তার শোবার ঘরে। দেয়াল ঘড়িতে তখন সন্ধ্যা ছ’টা বেজেছিল। রিস্ট ওয়াচে তারিখ ছিল পাঁচ আগস্ট দু’হাজার তিরিশ।

ব্যালকনি থেকে আবার সোফায় ফিরে এল সুমন। আবার তার চোখ গেল রান্নাঘরের দিকে। ওখানে যে মহিলা কাজ করছিল সে ততক্ষণে সুমনের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তার হাতে একটা থালা। থালার উপর কোনও খাবার রয়েছে। এতক্ষণে মহিলাটিকে ভালো করে লক্ষ্য করল সুমন। মহিলা না বলে একে মেয়ে বলাই ভালো। খুব বেশি হলে বছর বাইশ-তেইশের হবে মেয়েটি। সে একদৃষ্টে সুমনের দিকে তাকিয়েছিল। মেয়েটি যথেষ্ট সুন্দরী। সুমন চোখ ফেরাতে পারছিল না। কিন্তু একটা ব্যাপার খেয়াল করে সুমন চমকে উঠল। মেয়েটির শরীরে কোনও পোশাক নেই। বদলে তার শরীরের উপর রয়েছে স্বচ্ছ আলোর একটা আস্তরণ। বলতে গেলে মেয়েটি সম্পূর্ণ নিরাভরণ। সুমন নিজের দিকেও এবার খেয়াল করল। ওই একইরকম আলোর আস্তরণ রয়েছে তার শরীরেও। বলতে গেলে এই মেয়েটির সামনে সুমন নিজেও সম্পূর্ণ নিরাভরণ ভাবে রয়েছে।

মেয়েটি ধীরে ধীরে সুমনের সামনে এসে দাঁড়াল। তারপর থালাটা ধরিয়ে দিল ওর হাতে। থালার উপর থকথকে সবুজ জেলির মতো কিছু একটা রয়েছে। মেয়েটি ওকে ইশারায় খেয়ে নিতে বলল। এবার সুমনের মনে হল তার খিদে পেয়েছে। অনেকটা বাঁধাকপির তরকারির মতো খেতে খাবারটা। তবে সুস্বাদু। তাড়াতাড়ি খেয়ে নিল সুমন। অনেকটা দিয়েছিল মেয়েটা। পেট ভরে গেল সুমনের। আরেকটা থালা হাতে নিয়ে সুমনের পাশে বসেই খেল মেয়েটা।

খাওয়ার পাট চুকে গেলে, নিজের শরীরের উপরের আলোর আস্তরণটা আঙুলের একটা অদ্ভুত কায়দা করে সরিয়ে দিল মেয়েটা। সম্পূর্ণ নিরাভরণ হয়ে এগিয়ে এল সুমনের দিকে। তবে ও সুমনকে স্পর্শ করল না। শুধু ওর দিকে তাকিয়ে বসে রইল। হঠাৎ সুমনের মনে হল তার কানে কানে কেউ কিছু বলছে। পরিষ্কার বাংলায়। কণ্ঠটা কোনও মহিলার।

—স্বাগতম, আপনি শুনতে পাচ্ছেন?

আশ্চর্য হলেও সুমন কথাটার উত্তর দিল।

—পাচ্ছি।

আবার ওপাশের অদৃশ্য কণ্ঠ কথা বলে উঠল, “মুখে বলার দরকার নেই। যা বলার মনে মনে বলুন। আমি সব শুনতে পাব৷’

—কীভাবে?

—কারণ আমরা কথা বলছি স্নায়ু তরঙ্গের মাধ্যমে। যেটা মূলত একটা ইলেকট্রো কেমিক্যাল ইমপালস। আমার মস্তিষ্কের নিউরো ট্রান্সমিটার থেকে সেটা বেরোচ্ছে। তারপর আপনার ঘরের ক্যাচার কাম কনভার্টার সেটাকে ক্যাচ করছে। তারপর সেটাকে এনক্রিপটেড করে বাংলায় কনভার্ট করে আপনার ব্রেনে পাঠাচ্ছে। সেটা ক্যাচ করছে আপনার রিসেপ্টর নার্ভ। আর আপনি স্পষ্ট বাংলায় আমার কথা শুনছেন। উলটো দিকে আমিও নিজের ভাষায় আপনার কথা শুনতে পাচ্ছি একই ভাবে।

—আমি কোথায়?

—আপনি এই মুহূর্তে রয়েছেন আমাদের গ্রহে। এটা আপনাদের সৌরজগৎ থেকে প্রায় দুই আলোকবর্ষ দূরে।

—এখানে আমি এলাম কী করে?

—আপনি এখানে এসেছেন ছায়াপথের মাধ্যমে। যা নিয়ে আপনার কাকা বহুদিন গবেষণা করেছেন। আরও শুনতে চান?

—নিশ্চয়ই।

—আপনার কাকার সূত্র ধরেই বলি। পৃথিবীর প্রতিটি পথ আর ছায়াপথ পাশাপাশি যায়। কিন্তু দুটোর মাত্রা আলাদা। আর সেই মাত্রা হল সময়। ছায়াপথকে সাধারণ ভাবে সময়ের মাপকাঠিতে বাঁধা যায় না। তার সময়ের মাত্রা অন্যরকম। এই সময়ের মাত্রার পার্থক্যের জন্য ছায়াপথ সবার অগোচরে থেকে যায়। কিন্তু মহাজাগতিক বিস্ফোরণের ফলে এক এক সময় তৈরি হয় ব্ল্যাক হোল। ওই ব্ল্যাক হোলের ভিতর দিয়ে ছায়াপথে আসা যায়। তবে এটা একটা দুর্ঘটনা। সেই দুর্ঘটনাই আপনার সঙ্গে ঘটেছে। আপনি ভুলবশত ব্ল্যাক হোলে পড়ে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ছায়াপথ ধরে আমাদের এখানে চলে এসেছেন।

—আমার কাকার কথা আপনারা জানলেন কীভাবে?

—মেন্টাল ইলেকট্রো কেমিক্যাল সিগন্যাল সিস্টেমের মাধ্যমে। এটি সবচেয়ে শক্তিশালী যোগাযোগ ব্যবস্থা। যাকে আপনারা মন বলেন। এর মাধ্যমে খুব দ্রুত যোগাযোগ করা যায়।

সুমনের আর কোনও কথা বলতে ইচ্ছা করছিল না। গোটা ব্যাপারটা কেমন যেন আজগুবি আর ধোঁয়াটে মনে হচ্ছিল। সে চুপ করে গেল। তাকে চুপ করে যেতে দেখে অদৃশ্য মহিলা কণ্ঠ আবার কথা বলল।

—আপনার সামনে যে মেয়েটা বসে আছে, ওর নম্বর কুড়ি হাজার সাতশো। এখানে কারও-র নাম হয় না। লটারিতে ও আপনাকে পেয়েছে। আপনার কাজ ওর সঙ্গে থাকা, ঘরের কাজ করা আর ওর সঙ্গে রতিক্রিয়া করা। আপনাদের লক্ষ্য সন্তান উৎপাদন। অদৃশ্য কণ্ঠ থেমে গেল। ঠিক তখনই আর একটি নারীকণ্ঠ কানে গেল সুমনের।

—আমি কুড়ি হাজার সাতশো বলছি। এখন আমাদের মিলনের সময়।

এরপর কিছুটা জোর করেই সুমনের সঙ্গে মিলিত হল মেয়েটি। সুমনের ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু কিছুটা বাধ্য হয়ে ওর ইচ্ছায় সায় দিতে হল। তবে ভীষণ যান্ত্রিক মিলন। তৃপ্তি পেল না সুমন। ওদিকে কুড়ি হাজার সাতশোর চোখ মুখ দেখে কিছুই বোঝা গেল না।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...