নিধি হকচকিয়ে পিছন ফিরে বিল্টুকে দেখে বলে, “কী রে আবার কী হল? এদিকে আমার পিছনে কেন? তোর তো মনোজের দোকানে যাওয়ার কথা এখন৷ বিল্টু হাঁপাতে হাঁপাতে বলে— আরে বাবা ফ্লেক্স তো বানাতে বলব, কিন্তু ম্যাটারটা বলবে না?”
—ও, আচ্ছা। এই একটা সামান্য ব্যাপার সেটাও আমাকেই বলে দিতে হবে? কী মুশকিল। তোরা কি কিছুই পারিস না। যতসব অপোগণ্ডের দল কোথাকার। এক কাজ কর, ওটা তুই ফোন করে ওই যে রে ‘চালচিত্তির’ ম্যাগের সম্পাদক দালাল মিত্তিরের কাছে জেনে নে৷ যা যা, যা তো দেখি এখন। আমাকে যেতে দে ঘ্যানঘ্যান না করে।
বিল্টু ব্যোমকে দাঁড়িয়ে উলটো দিকে পা বাড়াল, ‘যাঃ শালা’ বলে!
অগত্যা বিল্টু প্রথমে রিকশ তারপর মিনিট দশেক পায়ে হেঁটে গলির গলি তস্য গলি পেরিয়ে, কেন্দুবাজারের মনোজের দোকানে। মনোজ চেনে বিল্টুকে আগে নিধিরামের সঙ্গে বারকয়েক যাওয়ার সূত্রে।
—আরে কী খবর বিল্টুভায়া।
—নিধিদার জন্য একটা ফ্লেক্স বানিয়ে দিতে হবে। আজ সোমবার তো। তা সামনের শনিবার সকালের মধ্যে পেলেই হবে।
—চিন্তা কোরো না, হয়ে যাবে। শনিবার সকালে নিয়ে যেও।
—ঠিক আছে।
বিল্টু উঠে দাঁড়াতেই মনোজ বলল, “আরে যাও কোথায়? ম্যাটারটা দাও।’
—ও হ্যাঁ, নিদুদা বলেছে তুমি ওটা দালাল মিত্তিরের থেকে নিয়ে নিও। বলেই চম্পট।
মনোজ ওর চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে অস্ফুটে বলল, ‘যাচ্চলে! কে দালাল মিত্তির তার ঠিক নেই। আমি জানব কী করে? যত্তসব…’
দিন দুয়েক পর সাতসকালে চটি ফটফটিয়ে নিধিরাম বিল্টুর বাড়ি হাজির। বিল্টু তখনও বিছানা ছাড়েনি। বিল্টুর মা বসার ঘরে বসতে বলে ভিতরে চলে গেলেন। বিল্টু মিনিট কয়েকের মধ্যেই চোখ কচলাতে কচলাতে নিধির সামনে হাজির।
—কী ব্যাপার নিদুদা এই সাতসকালে?
—কেন রে আসতে মানা আছে নাকি?
—না, তা না, তবে ভয়ানক কিছু নয় তো…..
—আরে, না না। ভিতরে গিয়ে দ্যাখ তো টিফিনটা এখনও আসছে না কেন? খুব খিদে পেয়েছে বুঝলি কিনা। এতটা পথ ঠেঙিয়ে আসা তো!
এর মধ্যেই বিল্টুর মা থালাভরতি লুচি, মিষ্টি, আলুভাজা নিয়ে হাজির। বাঁ-হাতে জলের গেলাস। নিধিরামকে খেতে বলে চলে গেলেন।
—তুমি খাও, আমি ব্রাশ করে আসি।
বিল্টু ভিতরে ঢুকে গেল। যখন ফিরে এল ততক্ষণে প্লেট সাফ। জল খেয়ে নিধিরাম তৃপ্তির ঢেকুর উগরে দিল। মায়ের ডাক শুনে বিল্টু চা নিয়ে এল। নিধি চায়ে চুমুক দিল। মুখের সিগারেট আগুনের অপেক্ষায়।
—হ্যাঁ রে বিল্টু, ফ্লেক্সটার কী খবর?
—চিন্তা কোরো না, শনিবার সকালে দেবে বলেছে মনোজদা। তুমি শুধু একবার গিয়ে ম্যাটারটা দিয়ে এসো।
—সে কী রে, দালাল মিত্তির দেয়নি?
—তা তো জানি না। আমি মনোজদাকে বলেছিলাম দালালবাবুর থেকে ম্যাটারটা নিয়ে নিতে। তবে নিয়েছে কিনা জানি না। -গেল গেল রে সব গেল। এই আমি এখন কী যে করি!
—একটু বোসো। আমি রেডি হয়ে নিই। তারপর বেরোব দু’জনে মিলে।
—আচ্ছা, বলছিস যখন… কিন্তু আমার আর এক কাপ চা লাগবে তাহলে।
—ঠিক আছে।
বিল্টু মিনিট দশেক পরে ওর নিজের জন্য বরাদ্দ ঠান্ডা মেরে যাওয়া চা-টা তার নিদুদাকে ধরিয়ে দিল। তাতেই খুশি নিধিরাম। বিল্টু সকালের টিফিন খেয়ে তারপর নিধিরামের সঙ্গে জয় মা বলে বেরিয়ে পড়ল কেন্দুবাজারের মনোজের দোকানের উদ্দেশ্যে। যেতে যেতে মেইন রাস্তায় উঠেই দেখল একটা মৃতদেহ নিয়ে— বলো হরি, হরিবোল করতে করতে যাচ্ছে। দু’জনেই অভ্যাসবশত মাথা নুইয়ে কপালে হাত ঠেকাল।
—আচ্ছা, নিদুদা তুমি সেদিন চালতা বাগান, মঠ, শ্রাদ্ধ— এসব নিয়ে কিছু একটা বলছিলে। কিন্তু শুরু হতে না হতেই থেমে গেলে। এখন ব্যাপারখানা একটু বিশদে খুলে বলো তো দেখি দাদা।
—ও হ্যাঁ, ঠিক মনে করিয়েছিস তো। সে বেশ গোছানো চমৎকার ব্যবস্থাপনা রে। আমাদের এখানে নেই। একদম নেই অথচ থাকা উচিত ছিল।
অধৈর্য বিল্টু বলে ওঠে, “আরে বাবা অত ধানাই-পানাই না করে মোদ্দা কথাটা বলো দেখি। সেদিন থেকে আমার মাথা গরম করছ।’
—আহা, বলছি তো। দেখছিস না আমি কি না বলে চুপ করে আছি? তুই তো কথার মাঝে কথা কেটে দিয়ে খামোকা রাগারাগি করছিস। তা জানিস উপর নীচের দু’টো হলঘরে একসাথে দু’দুটো শ্রাদ্ধের কাজ একসঙ্গে করার ব্যাবস্থা রয়েছে রে। এক্কেবারে ‘টার্ন কি’ প্রোজেক্টের মতোন। শুধু টাকা ফেলে দাও। খাটবিছানাসহ সমস্ত উপচারাদি, পুরুত বাহ্মণ, রান্নাবান্না, লোক খাওয়ানো সব সেই সংস্থার। যাকে বলে পার্মানেন্ট এস্টাব্লিশমেন্ট। ঝামেলাহীন। বসার খাওয়ার টেবিল, চেয়ার, পায়খানা, বাথরুম… কী নেই!
—তাহলে তো প্রচুর টাকার ব্যাপার নিশ্চয়।
—আরে না না। ওইখানেই তো আসল ব্যাপারখানা ঘাপটি মেরে বসে রয়েছে। বেশ ভালো লাগল বুঝলি। পারলৌকিক কাজকম্মো চুকেবুকে গেলে এবার খাবার টেবিলে। বেশি না, আমি ক্ষমাঘেন্না করে এই নামমাত্তর গোটা পঞ্চাশেক লুচি আলুর দমসহ বোঁদে, রসগোল্লা আর ক্ষীরকদম্ব সাঁটালাম। বলতে বলতে ততক্ষণে ওরা মনোজের দোকানে।
মনোজ নমস্কার করে বলল, ‘আরে দাদা এসো এসো। কী সৌভাগ্য আমার সাতসকালে তোমার চরণধুলোয় আজ আমার দিনটা ভালো যাবে আশা করি।’
নিধিরামও অমায়িক বলল, ‘তা আর বলতে। একটা সিগারেট দে আর চা বল, দুধ চিনি বেশি করে।
—তা হ্যাঁ রে, শনিবার সকালে ফ্লেক্সগুলো ঠিক পেয়ে যাব তো? তোর যা কথার দাম! বিল্টু বলছিল বটে, তবে নিশ্চিত হতে আমি নিজেই এলাম এই সাত সকালে।
–আচ্ছা বলেছ দাদা। ম্যাটারটা দেবে তবে তো কাজ শুরু করব নাকি?
—সে কী রে, দাদাল মিত্তির তোকে দেয়নি এখনও? আর না দিলে তুই চেয়ে নিবি না, কী যে বলি। তোরা না সব… আজকালকার ছেলেপিলেদের সব এই এক দোষ!
—আরে সেদিন থেকে তোমরা দু’জন দালাল দালাল করছ, তা এই মালটা কে? আর মোদ্দা কথা আমি কি ছাই ওকে চিনি, না জানি? দ্যাখো, এখনও ম্যাটারটা দিলে সময়মতো পেয়ে যাবে, না হলে ঘুড়ি ওড়াবে। ক্ষমা করো দাদা আর চেটো না।
—আচ্ছা আচ্ছা, বোসো। সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। এই মনোজ একটা কাগজ কলম নিয়ে বোস তো দেখি তাড়াতাড়ি।
মনোজ রেগেমেগে বলল, ‘কাগজ কলম দিচ্ছি, ইচ্ছে হয় নিজে বোসো। আমি পারব না। ব্যস, এটাই আমার শেষ কথা।”





