বাড়ি ফেরার পরে পোশাকটা তখনও ছাড়েনি। বড়দির পরপর ফোন, তাও আবার অফিসের ফোনে। প্রথমটাতে একটু ঘাবড়ে গেছিল সোনালি। এমনি সময় অফিসে মানে হাসপাতালে ডিউটিতে থাকলে, দুই দিদির কেউই ফোন করে না। সোনালিই বারণ করে দিয়ে বলেছে, “খুব দরকার থাকলে অফিসের নম্বরে মিস কল দিবি, আমি ঠিক সময় মতো রিটার্ন ফোন করে নেব।”
হাসপাতালে থাকাকালীন সাধারণত বাড়ির ফোনটাকে সাইলেন্ট মোডে করে রাখে। আজ অফিস থেকে বাড়ি ঢুকতেও একটু দেরি হয়েছে। বদমাস এই ডিপার্টমেন্টাল হেডটা। ছ’টা-সাড়ে ছ’টাতেও বেরোতে দিচ্ছে না। নিজে ব্যাটা ঠিক দুপুর বারোটার সময় হাসপাতালে ঢুকছে। স্বাভাবিক ভাবেই আটটা সাড়ে আটটা পর্যন্ত অনায়াসে থাকতে পারছে। কিন্তু যে-মানুষটা সকাল সাড়ে আটটা থেকে ন’টার মধ্যে হাসপাতালে আসে তার কাছে রাত সাড়ে আটটা ন’টা মানে তো বারো ঘণ্টা।
এতক্ষণ কেন থাকবে? কিছু বলবার উপায় নেই। ডিএইচ হলেও ভদ্রলোক তো প্রায় ডিরেক্টর র্যাংক-এর, ওনার সাথে খারাপ ব্যবহার করা মানেই নেগেটিভ ইমপ্যাক্ট পড়বে। দিদিদের তো এইসব কথা বলে বোঝানো যায় না। প্রথম কয়েকবার রিং হয়ে যাওয়ার একটু পরে ধরবে ভেবেও উপায় নেই। পরপর রিং হয়েই যেতে লাগল। সোনালি বাধ্য হয়ে ফোনটা রিসিভ করতেই উলটো দিক থেকে একরকম বাজ পড়বার মতো শব্দ শুনতে পেল— “তুই কী আরম্ভ করেছিস রে? আমাদের তো একটা মান সম্মান আছে।”
সোনালি সব শুনল। কিছু সময় পর বড়দি ক্লান্ত হয়ে পড়লে সোনালি জিজ্ঞেস করে, “আর কিছু বলবি?’ এই কথাতে বড়দি আরও রেগে ওঠে। ফোনটা রেখে দেওয়ার আগে বলে উঠল, “তোর জামাইবাবুকে আমি পাঠাচ্ছি, তোর এই ধ্যাষ্টামো বার করছি।”
ফোনটা রেখে ঠোঁটদুটো চেপে কিছু সময় সোনালি বসে থাকল, ধ্যাষ্টামোই বটে। পঁয়তাল্লিশ বছরের একটা মেয়ে এতদিন ধ্যাষ্টামো করল না, আজ করবে?
গত বছর শীতের সময় একদিন ভোর চারটের সময় মাকে ভর্তি করতে হল, টানে খুব কষ্ট হচ্ছিল। এই পাড়ার বাবলুদার গাড়িটা পাওয়া গেল না। পাশের পাড়ায় টুকাইদার গাড়িটা বলবার জন্যেও মাকে একা রেখে যেতে হয়েছিল। আগের রাত থেকে মায়ের শরীর খারাপ ছিল। বড়দিকে ফোন করে জামাইদাকে একদিনের জন্যে আসতে বললেও জামাইদা আসেনি। কী একটা অর্ডারের কথা বলে এড়িয়ে গেছিল। অথচ ‘নিজের গ্রামে ভালো স্কুল নেই,’ এই কথা বলে সেই কেজি থেকে ক্লাস টুয়েলভ পর্যন্ত এতগুলো বছর বড়দি ও বুবাই এই ঘরেই থেকেছে। মাকে এক পয়সা খাওয়ার খরচ দেয়নি। পুরোটা হয়েছে বাবার ডেথ কেস-এ পাওয়া মায়ের চাকরি ও পরে পেনশনের টাকায়।
কথাগুলো মনে পড়লেও সোনালি কোনও উত্তর না দিয়ে একটা লম্বা শ্বাস ফেলে। অফিসের জামা কাপড়গুলো চেঞ্জ করতে যাবে এমন সময় ওর নিজের ফোনটা বেজে ওঠে। একটু পরে হলে হয়তো রিসিভ করা যেত না। ফোনটা তুলতেই দেখে, ‘মেজদি কলিং।’ এটাই মনের মধ্যে ঘুরঘুর করছিল। মেজদির কানে কি খবরটা যায়নি? ফোনটা রিসিভ করে হ্যালো বলবার আগেই ওদিক থেকে আরেকটা ঝাঁঝালো প্রশ্ন, “তোর নামে এসব কী শুনছি বল তো? এই বয়সে এইসব শুনতে ভালো লাগে। বুবাই, টুবলু দু’জনেই এখন অ্যাডাল্ট। ওদের নামে কোনওদিন কিছু শুনলাম না, আর তোর নামে এইসব শুনতে হচ্ছে।’
—তুই কি আর কিছু বলবি, না হলে আমি রাখছি। আজ কাজের খুব চাপ ছিল। ফ্রেশ হয়ে এবার একটু শুতে হবে।
সোনালির কথাগুলো শুনে ও-প্রান্ত থেকে ফোন কেটে দেওয়াটা বোঝা গেল। একটু বাঁচল সোনালি। যাক, মেজদি আর জামাইবাবুর কথা বলেনি। শুকনো জামাকাপড় নিয়ে বাথরুমে ঢোকার সময় পাশের দেয়ালে মায়ের ঝোলানো ছবিটার দিকে চোখ গেল। একটু থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। বেশি সময় দাঁড়াতে পারল না, ছবিটা দেখে রাগও হল। কেমন হাসছে, যেন বলছে, ‘ঠিক হয়েছে, ঠিক হয়েছে, তখন বারবার বলার পরেও বিয়েতে রাজি হলি না, এখন নিজেই বোঝ। তিন বছর বয়সে তোর বাবা মারা যাবার পর তোকে এই বড়ো করলাম, কিন্তু তুই কোনও কথা শুনলি না।”
মা কি বোঝেনি, বিয়ে করলে এই বাড়িতে তাকে দেখবার কেউ থাকত না?
সোনালি বাথরুমে ঢুকে শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে থাকল। হাসপাতাল থেকে এই সন্ধেবেলাতে ফিরেও সবদিন স্নান করে না। আজ স্নান করতে ইচ্ছে হল, অন্তত কিছু সময়ের জন্যে নেমে আসা জলের ধারার নীচে দাঁড়িয়ে থাকলে একটু শান্তি আসে, কান্নার ফোঁটাগুলো জলের ধারাতে ধুয়ে নেমে গেলে নিজেকে কিছু বলার থাকে না।
ঘাড়ের কাছে জল লেগে কেমন যেন জ্বলছে। পিঁপড়ে কামড়াল, নাকি অন্য কিছু? ডান হাতটা ঘাড়ে রাখতেই একটা ছড়ে যাওয়ার দাগ বুঝতে পারল। তাহলে কি অপূর্বের আংটিতে ছড়ে গেল? লাঞ্চের সময় ছেলেটা এসেছিল। সোনালি তখন টেবিলে মাথা রেখে বসেছিল। অপূর্ব এসে এভাবে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করে, “কি গো, এখনই ক্লান্ত হয়ে গেলে, আজ তোমায় অনেকগুলো বিল রেডি করতে হবে।”
—সেই তো রে, কিন্তু ঘাড়ে খুব লাগছে।
—হঠাৎ, আমি তো রাতে তোমার কাছে যাইনি?
চমকে উঠল সোনালি। ‘তুই এসে কী করতিস?’
—না ওই অনেক সময় টানাটানিতে ব্যথা…
—খারাপ হয়ে যাচ্ছে কিন্তু…
শেষের কথাগুলো বলে ঘাড়টা তার দিকে ঘোরাতেই ব্যথাটা আরও বেড়ে যেতে সোনালি টেবিলে মাথাটা রেখে আবার বসে যায়।
—খুব ব্যথা করলে বসকে বলে বাড়ি চলে যেতে পারো।
কথাগুলো কানে গেলেও কোনও উত্তর দিল না। কী বলবে, এই সময় বাড়ি যাওয়া আর এখানে থাকা দুটোই সমান। তাও এখানে প্রয়োজনে ফিজিও-র কাছে গিয়ে একটু দেখিয়ে নেওয়া যাবে। বাড়ি গেলে শুধু শূন্যতাকে আঁকড়ে ধরে থাকা। তাও মা যতদিন বেঁচেছিল কিছু না পারলেও জিজ্ঞেস করত।
কিছু সময়ের মধ্যেই ঘাড়ে একটা হাতের স্পর্শ পেতেই পায়ের নীচ থেকে সারাটা শরীরে একটা অদ্ভুত শিহরণ লাগল। জোরে শ্বাস পড়তে আরম্ভ করল। সোনালির বন্ধ চোখ দুটো আরও বন্ধ হয়ে আসছিল। সেদিন ভাগ্যিস পার্টনার রুমা শরীর খারাপের জন্যে আসেনি। সকালে উঠে সোনালিকেই পেটে ব্যথার কথা জানায়। সোনালি তাও কিছু সময়েই নিজেকে সামলে বলে উঠল, ‘এই অপূর্ব, কী হচ্ছে, এটা অফিস…. ‘
—চলো ক্যান্টিন থেকে চা খেয়ে আসি। বস ডাকলে বলবে, মাথায় খুব ব্যথা করছিল। রুমের মেশিনে কফি, তাই চা আনতে গেছিলাম।
কথাগুলো শুনে ভালো লাগলেও যাওয়া হয়নি। অ্যাকাউন্টসের রুম থেকে হঠাৎ ডাক আসতেই চলে যেতে হল। চা পড়ে থাকলেও ঘাড়ের কাছে ছড়ে যাওয়াটা রয়ে গেল। সেটাও অবশ্য এই বুঝতে পারে।
ছেলেটা একটু অদ্ভুতরকমের। বয়সে সোনালির থেকে তেরো বছরের ছোটো। বড়দির ছেলে বুবাই এখন ছাব্বিশ, মেজদিরটা বাইশ। অপূর্বর একটাই বদ অভ্যাস। কথা বলবার সময় খারাপ শব্দ ব্যবহার করে। জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেয়, “আমার ব্যাড হ্যাবিটটাই খুব খারাপ।’
প্রতিদিন নীল রঙের জামা পরে অফিসে আসে। সোনালি একদিন কারণ জিজ্ঞেস করেছিল। উত্তর না দিয়ে হেসে উঠেছিল। জন্মদিনে ডিপার্টমেন্ট থেকে নীলের বদলে একটা কালো শার্ট দিলে উত্তর দেয়, ‘এই রে আমার পরিচয়টা তো বদলে দিলে গো।’
আচ্ছা বর্ধমানের সেই ছেলেটা তো বয়সে বড়োই ছিল। ওরা নিজে থেকে সোনালির মাকে বলেছিল। সেটা তো এগারো-বারো বছর আগের কথা। তখন বড়দি কিছু না বললেও মেজদি বলে, ‘বর্ধমান চলে গেলে মাকে কে দেখবে শুনি, আমি অত কাজ ফেলে আসতে পারব না। এখন দিদি আছে, যেদিন বুবাইয়ের পড়া হয়ে যাবে?’
বড়দি কিছু না বললেও রাতে দুবোনের আলোচনা সোনালিরও কানে এসেছিল। ‘ফুচিকে বলব, মাঝে মাঝে এখানে এসে থাকতে। ছেলেটা তো চাকরি করে, একটু মানিয়ে নেবে। আমিও মাকে নিয়ে যাব।’
সকালে উঠে মায়ের সামনে বাড়িটা বিক্রির কথা উঠলে সোনালি মায়ের চোখে জলের দাগ লক্ষ করে। সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে, ‘শোন, তোদের অত চিন্তা করতে হবে না, আমি বিয়ে করছি না। মাকে নিয়েই এই বাড়িতে থাকব। তোরা সময় সুযোগ পেলে এখানে আসবি, থাকবি।”





