পরীক্ষার ফলাফলই আজ বলে দিচ্ছে মেয়েদের স্থান। রেজাল্টে মেয়েদের পাশের সংখ্যা যেমন ছেলেদের তুলনায় বেশি, তেমনি তাদের সাফল্যও চমকে দেওয়ার মতো। আজও অনেক বাধা থাকা সত্ত্বেও মেয়েরা যেমন এডুকেশন-এ টপ করছে তেমনি পেশার জগতেও বহু ক্ষেত্রে পুরুষদের পিছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে। আর শুধু এইটুকুতেই তারা থেমে থাকেনি, পুরুষদের মতোই বাড়ি এবং সমাজের দায়িত্বও কাঁধে তুলে নিয়েছে।
কিন্তু পিছন ফিরে তাকালে দেখা যাবে একসময় ধরেই নেওয়া হতো যে, কন্যাটি স্কুলের শিক্ষা শেষ করেই সংসারের কাজে হাত লাগাবে। উচ্চ শিক্ষার বদলে সংসারে খুঁটিনাটি শিখতে পারলেই বিয়ের বাজারে তার মূল্য বাড়বে। পাত্রর সন্ধান পেতেই নাবালিকা মেয়েদের বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দেওয়া হতো। তাদের নিজেদের ইচ্ছার কোনও মূল্যই থাকত না।
কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমাজ বদলাচ্ছে। বদলাচ্ছে মানুষের মানসিকতাও। সংসারের সীমিত গন্ডির মধ্যে আজ তারা থাকতে বাধ্য নয়। উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আজ মেয়েরা, বাড়ির পুরুষ সদস্যদের থেকে এগিয়ে রয়েছে। তাই বলে কি পুরুষরা নিজেদের দায়িত্ব পালনে কোথাও পিছিয়ে যাচ্ছে? এটা ঠিক মেয়েরা মা-বাবা, পরিবারের সমস্ত দায়িত্ব সামলে বাইরের সমাজেও যেভাবে নিজের পরিচিতি গড়ে তুলছে ঠিক তেমনটা পুরুষদের ক্ষেত্রে বিশেষ চোখে পড়ে না। বাইরের কাজেই তারা নিজেদের সীমাবদ্ধ করে ফেলে। বাড়ির দায়-দায়িত্ব স্বাভাবিক ভাবেই মেয়েদের উপর এসে বর্তায়।
মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি
মেয়েরা যদি বাড়ির কাজ সামলে বাইরের কাজও সমান দক্ষতার সঙ্গে করতে পারে, তাহলে ছেলেরা পিছিয়ে রয়েছে কেন? বাড়ির কাজের প্রতি ছেলেদের একটা অবজ্ঞার ভাব লক্ষ্য করা যায়। মেয়েরা যেখানে রান্নাঘরের পুরো দায়িত্ব সামলাচ্ছে সেখানে পুরুষেরা বাড়ির আরও অন্য কাজে হাত না লাগিয়ে বাইরেই নিজেদের ব্যস্ত রাখছে। রান্না ছাড়াও বাড়ির অনেক কাজ থাকে যেমন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, প্লাম্বার, ইলেকট্রিশিয়ানের প্রয়োজন হলে তাদের ডেকে আনা জামাকাপড় প্রেস করা ইত্যাদি – যেগুলো পুরুষদের জন্য একেবারেই কঠিন কাজ নয়। সপ্তাহের সাতদিন যদি মেয়েরা ঘরে-বাইরে একসঙ্গে কাজ করতে পারে, তাহলে পুরুষদের করতে বাধা কোথায়?
আসলে অনেক আগে থেকে নারী এবং পুরুষের মধ্যে ভেদাভেদ করা শুরু হয়েছে। কোন কাজটা মেয়েরা করবে আর কোনটা পুরুষদের করার, সেটাও ধার্য করা রয়েছে বহু আগে থেকেই। সেইজন্যই ছেলেদের মনের মধ্যে বসে গেছে বাড়ির যাবতীয় কাজই মেয়েদেরই শুধু করার। কিন্তু এখন এই মানসিকতা সব পরিবারে আর নেই। আমাদের সমাজও বদলাচ্ছে। এর সঙ্গে তাল রেখেই সেইসব পরিবারের ছেলে ও মেয়েরা বাড়ির সব কাজেই সমান ভাবে হাত লাগাচ্ছে।
লিঙ্গ ভেদাভেদ করার আগে প্রত্যেকটা মানুষের কর্তব্য, মনুষত্ব বজায় রেখে একজন ভালো মনের মানুষ হয়ে ওঠার দায়িত্ব পালন করা। আজও যদি আমরা এই স্বাধীন দেশের মাটিতে বসে নারী ও পুরুষের মধ্যে ভেদাভেদ করার চেষ্ট করি, তাহলে আমাদের মানসিকতা, আমাদের বিচার, ভাবনা সবই সংকুচিত হয়েই থেকে যাবে।
ভেদাভেদ না করার চেষ্টা
বহুদিন হল দেশ-স্বাধীন হয়েছে। সময়ও বদলেছে, রোজই আরও বদলাচ্ছে। কিন্তু কিছু কিছু জিনিস আজও পরাধীন রয়ে গেছে। যুগান্তব্যাপী মানসিকতা বদলানো কঠিন কাজ। কোনও কোনও পরিবারে মেয়ে না হলে বাড়ির সকলে দুঃখ পায় যে, পরিবারে একটাও মেয়ে নেই। আবার এমনও পরিবার আছে যেখানে মেয়ে নেই বলে সকলে আনন্দ প্রকাশ করে। এইসব মানুষই সমাজকে পুরোনো ধ্যান-ধারণার বশবর্তী করে রেখে দিতে চায়।
সমাজের যারা মাথা তারা মনে করেন সমাজ তথা প্রতিটা পরিবারের উচিত সন্তানকে ছোটো থাকতে শেখানো, ছেলে-মেয়ের মধ্যে পার্থক্য না করতে। ছোটো বেলায় ছেলেরা কান্নাকাটি করলে বোঝানো হয় কাঁদাটা মেয়েদের কাজ, ছেলেদের কাঁদা শোভা পায় না। সুতরাং এই ধরনের শিক্ষা পেয়েই ছেলেরা বড়ো হয়ে ওঠে। ওই ভাবেই তাদের মানসিকতাও গড়ে ওঠে। তারা শিখেই আসে বাড়ির কাজ মেয়েদের জন্য তাই বাড়ির কোনও কাজে তাদের যোগদান কম থাকে। সুতরাং বাড়িতে যদি এই ধরনের শিক্ষা দেওয়া বন্ধ হয় তবেই আমাদের সমাজে নারী-পুরুষের মধ্যে ভেদাভেদ করা বন্ধ হতে পারবে।