লক্ষ লক্ষ মানুষ কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যায় ভোগেন। দৈনিক একটি নির্দিষ্ট সময়ে মলত্যাগ করার অভ্যাস গড়ে ওঠে না। মলত্যাগের জন্য বহু সাধ্যসাধনা করতে হয়। কারণ যেটুকু বর্জ্য তারা ত্যাগ করতে পারেন, হয় পরিমাণে তা খুব অল্প অথবা খুব শক্ত। Constipation সমস্যার এটাই সূত্রপাত।
Constipation নিয়ে উদাসীনতা কতটা ক্ষতিকারক?
প্রশ্নটা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সমস্যাটা কখনও আসে, কখনও চলে যায়। মানে, সর্বদাই যাওয়া-আসার পর্বে থাকে সুতরাং এটাকে গুরুত্ব না দিলেও চলে। অথবা তারা ভেবে নেন, এই সমস্যার কোনও চিকিৎসা হয় না। আর যারা জানেন যে এর চিকিৎসা রয়েছে, তারা মনে করেন, এধরনের বিষয়ে কারও-র সঙ্গে কথা বলাটা অন্তত তাদের পক্ষে রুচিসম্মত নয়। যে-কোনও রোগের মতোই কোষ্ঠকাঠিন্যকেও চিহ্নিত করতে হয় এবং প্রথমদিকেই চিকিৎসা করাতে হয়। এতে ভবিষ্যতে অন্ত্রের ক্ষতি এড়ানো যায়। অন্যভাবে বললে, কোষ্ঠকাঠিন্য নিয়ে জীবনযাপন মোটেই স্বস্তির ব্যাপার নয়।
কিন্তু কোষ্ঠকাঠিন্য কেন হয়?
শরীরকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা – বিশেষত যারা বয়স্ক, তারা শারীরিক পরিশ্রম বিশেষ করেন না। তাদেরই কোষ্ঠকাঠিন্যের প্রবণতা বেশি। কিছু বিশেষজ্ঞ একথা বিশ্বাস করেন যে, শারীরিক পরিশ্রম বিপাক প্রক্রিয়াকে সক্রিয় রাখতে সাহায্য করে। এতে দেহের নানা প্রক্রিয়া আরও বেশি বার এবং আরও দ্রুত ঘটে।
গর্ভাবস্থা – এই পর্বে মহিলাদের হরমোনের পরিবর্তন হয়। এর ফলে একজন মহিলার কোষ্ঠকাঠিন্য বাড়তে পারে। আবার জরায়ু অন্ত্রের ওপর চাপ দিতে পারে, এতে খাবার যাওয়ার রাস্তা সরু হয়ে যায় এবং খাবার যেতে বেশি সময় লাগে।
Irritable Bowel Syndrome – যারা এই রোগের খপ্পরে পড়েছেন অন্যদের চেয়ে তাদের কোষ্ঠকাঠিন্য হয় ঘন ঘন।
মলাশয় ও মলদ্বারের সমস্যা – টিউমার থাকলে তা মলাশয় ও মলদ্বারে চাপ দিতে পারে অথবা যাতায়াতের পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। এতে কোষ্ঠকাঠিন্য হয়। আবার যদি টিস্যু ছিঁড়ে যায়, মলাশয় ও মলদ্বার যদি অস্বাভাবিক ভাবে সংকীর্ণ হয়ে যায়, তখন ওই অবস্থাকে বলা হয় কলোরেক্টালের কঠোরতা। এতেও কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে।
বেশি করে জোলাপ ব্যবহার করা – কেউ কেউ মনে করেন দিনে একবারই টয়লেট যাওয়া উচিত। না, এটা ঠিক নয়। এটাই যাতে হয় সেজন্য কেউ কেউ নিজে নিজেই জোলাপ ব্যবহার করেন। কোষ্ঠ সাফ করতে জোলাপ সাহায্য করতে পারে কিন্তু এটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যেতে পারে। যখন কেউ জোলাপের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়েন, তখন জোলাপে একবার কোষ্ঠ সাফ হওয়া বন্ধ হলে কোষ্ঠকাষ্ঠিন্যের ঝুঁকি থেকে যায়।
বয়স – যখন মানুষ বুড়ো হয়, তখন পরিপাক প্রক্রিয়া দুর্বল হয়ে পড়ে। তখন অন্ত্র কম কাজ করে। হজম নালিপথের পেশিগুলি তখন আর আগের মতো কাজ করে না।
রুটিনে পরিবর্তন – যখন কেউ বাইরে কাজে বা বেড়াতে যান, তখন স্বাভাবিক রুটিন বদল হয়ে যায়। হজম প্রক্রিয়ায় এর প্রভাব পড়তে পারে। অনেক সময় এর থেকেও কোষ্ঠকাঠিন্য হয়। তখন খাবার সময়, রাতে শোওয়া বা সকালে ওঠার সময়, টয়লেট যাওয়ার সময়গুলো বদলে যায়। এতে কোষ্ঠকাঠিন্যের ঝুঁকি বাড়ে।
কতগুলি রোগ ও অবস্থা – মলাশয়, মলদ্বার, কিংবা পায়ুর মধ্যে দিয়ে মলের যাতায়াতের গতি কমিয়ে দিতে পারে কিছু রোগ। তাতেও কোষ্ঠকাঠিন্য হয়। এই রোগগুলি হল–
১) স্নায়ুতন্ত্রের সমস্যা ২) এন্ডোক্রিন ও পরিপাকের অবস্থা ৩) সিস্টেমেটিক রোগ ৪) ক্যানসার
তাহলে কি খাবারে ফাইবার বা তন্তুর পরিমাণ বাড়াতে হবে?
কেউ কেউ ভাবেন তাদের শরীরটা যেন আবর্জনা ফেলার জায়গা। তারা যা খুশি খান এবং তাতে তাদের সমস্যা বাড়ে। লাগামছাড়া খাবারের অভ্যাস হল অন্যতম প্রধান কারণ, যা পেটে বায়ু জমতে সাহায্য করে। তাই স্বাস্থ্যরক্ষা করতে হলে খেতে হবে তন্তুসমৃদ্ধ খাবার। কোষ্ঠ ভালো ভাবে সাফ করানোর জন্য ফাইবার খাওয়া অবশ্যই দরকার। যাদের পেটে বায়ু জমছে তাদের প্রতিদিন অবশ্যই ফল ও সবজি খেতেই হবে। মাংস, দুগ্ধপণ্য খেতে পারেন অল্প পরিমাণে, তবে জাংক ফুড এড়িয়ে চলতে হবে। মাঝেমধ্যে মশলাদার ফাস্ট ফুড খাওয়া যেতে পারে কিন্তু সময় এসেছে যখন আমাদের বুঝতে হবে, যা কিছুই সুস্বাদু তাই স্বাস্থ্যকর নয়।
এক্ষেত্রে কি বেশি করে জল খাওয়া উচিত?
নিশ্চয়ই। সাদা, পরিচ্ছন্ন ও শুদ্ধ জল। যাদের হজমের সমস্যা রয়েছে, তাদের অ্যালকোহল, উত্তেজক পানীয়, অথবা খুব বেশি ক্যাফিন রয়েছে এমন পানীয় এড়িয়ে চলা উচিত। এতে সমস্যা আরও বাড়তে পারে। তার মানে এই নয় যে, দিনে পাঁচ বা সাত লিটার জল খেতে হবে। এক্ষেত্রে চিকিৎসক বলে দেবেন, দিনে কতটা জল খাওয়া দরকার। কিন্তু যাদের কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা রয়েছে তাদের অবশ্যই তরল খাওয়ার পরিমাণ বাড়াতে হবে। তাহলে ক্ষুদ্রান্ত্রের মধ্যে দিয়ে শরীরের বর্জ্য সহজে যেতে পারবে। সুতরাং, জলকে বলুন চিয়ার্স আর জল খেয়ে নিজেকে ঠান্ডা রাখুন।
মানসিক চাপও কি সমস্যা তৈরি করে?
মানুষের মস্তিষ্ক যে ভাবে সাড়া দেয়, তাতে ঝটকা লাগলে মানবদেহে পরিবর্তন হতে পারে। এর প্রতিক্রিয়ায় কোষ্ঠকাঠিন্যও হতে পারে। কারণ মানসিক চাপ বাড়লে বিশেষ ভাবে হজম প্রক্রিয়ায় তার প্রভাব পড়ে। তাই চাপের উৎসকে চিহ্নিত করা দরকার। অফিসের কাজের জন্য ঘন ঘন বাইরে যাওয়া কিংবা অন্য কোনও কারণে চাপ কিনা তা দেখতে হবে। যদি চাপের কারণে কোষ্ঠকাঠিন্য হয়, তাহলে সমস্যাটা মেটাতে চিকিৎসকের পরামর্শ লাগবে। আবার চাপের কারণকেও হিসেবে নিতে হবে। অতএব যদি দেখেন মানসিক চাপে আপনার অবস্থা বেশ কাহিল, তাহলে ভাগ্যের ভরসায় বসে না থেকে চিকিৎসকের সাহায্য নিন।
মলত্যাগের চাপ এড়িয়ে যাওয়া কতটা ক্ষতিকারক?
এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রশ্ন। আজকের দিনে লোকেরা এত বেশি ব্যস্ত থাকেন যে, তারা প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়াটাও স্থগিত রাখেন। কেউ কেউ চাপ এলে তা ঠেকিয়ে রাখেন কারণ সকলের সামনে শৗচাগারে যেতে চান না। দেরি করলেও চলতে পারে এমন ভাবনা কিংবা নিজের টয়লেট ছাড়া অন্যদের টয়লেটে যাব না, কারণ যাই হোক না কেন, চেপে রাখার বিষয়টি খুবই বাজে। যদি প্রকৃতির ডাক আপনি উপেক্ষা করতেই থাকেন, তাহলে, পরে কোনও সংকেতই আর অনুভব করতে পারবে না আপনার শরীর। অতএব আটকে রাখাটা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
মানসিক চাপ কাটিয়ে ফেলুন
আপনার স্বাস্থ্যের কি ক্ষতি করছে মানসিক চাপ? দিনের শেষে নিজেকে মনে হচ্ছে বিধদস্ত? চাপ কমানোর কয়েকটি উপায় হল–
১) এড়িয়ে চলুন – আশপাশের পরিবেশের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রাখুন। বিরক্ত করে এমন লোকজনকে এড়িয়ে চলুন। লোককে ‘না’ বলতে শিখুন।
২) যা করবেন – লোকের সঙ্গে কথা বলুন, লোককে ক্ষমা করুন, নিজের বিষয়ে ইতিবাচক কথা বলুন, ভুলথেকে শিখুন।
৩) বদলান – সবাইকে ভালো ভাবে বলুন তাদের ব্যবহার বদলাতে, যা ভাবছেন স্পষ্ট বলুন। নিজের সময় ভালো ভাবে কাজে লাগান।
৪) অভ্যস্ত হোন – নিজের অবস্থান কোথায় ঠিক করুন, বেশি ভাবনাচিন্তা বন্ধ করা অভ্যাস করুন। ইস্যুগুলি নতুন করে সাজান এবং সবকিছুকে বড়ো চালচিত্রে দেখুন।
কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে বাঁচুন
খাবারে রাখুন শাকসবজি ও ফল
১) আপেল – আপেলে বেশি তন্তু রয়েছে। একটা খোসা সহ মাঝারি মাপের আপেলে (প্রায় ১৮২ গ্রাম) থাকে ৪.৪ গ্রাম ফাইবার, যা সারা দিনে মোট যত ফাইবার দরকার তার ১৭ শতাংশ। কাঁচা চিবিয়ে খেতে পারেন, রস করে খেতে পারেন, স্যালাড বা সিদ্ধ খাবারে দিয়ে খেতে পারেন।
২) কিউয়ি – একটা কিউয়ি ফলে থাকে ২.৩ গ্রাম ফাইবার (ওজন প্রায় ৭৬ গ্রাম), এর মধ্যে থাকে সারা দিনে দেহে যত ফাইবার দরকার তার ৯ শতাংশ। ফ্রুট স্যালাডে দিতে পারেন অথবা ফ্রুট স্মুদিতে দিতে পারেন।
৩) নাশপাতি – ফাইবারে সমৃদ্ধ আরেকটা ফল হল নাশপাতি। মাঝারি সাইজের (ওজন ১৭৮ গ্রাম) নাশপাতিতে থাকে ৫.৫ গ্রাম ফাইবার। রোজ যত ফাইবার দরকার তার ২২ শতাংশ থাকে নাশপাতিতে। কাঁচা খান, চিজের সঙ্গে রান্না করে খান, স্যালাডে দিন কিংবা মিষ্টির পাতে কিংবা সিদ্ধ খাবারে দিন।
৪) পালং শাক ও অন্য সবজি – পালং শাক, ব্রাসেলসের কল, ব্রোকোলি ফাইবারে সমৃদ্ধ এবং এগুলোয় রয়েছে ভিটামিন সি, ভিটামিন কে ও ফোলেট। মলের ওজন বাড়ায় এই সব সবজি, ফলে তা বেরিয়ে যাওয়াও সহজ হয়।
৫) রাঙালু – মাঝারি সাইজের একটা রাঙালুতে (ওজন ১১৪ গ্রাম) থাকে ৩.৮ গ্রাম ফাইবার, যা রোজকার প্রয়োজনীয় ফাইবারের ১৫ শতাংশ। ঝলসে নিয়ে, ভাপে সেদ্ধ করে কিংবা চটকে নিয়ে রাঙালু খাওয়া যায়।