উৎসব-অনুষ্ঠান মানেই চাই মিষ্টি। এ যেন আনন্দ-আহ্লাদের এক অপরিহার্য রসদ। শুধু নিজে খেয়ে তৃপ্ত হওয়া-ই নয়, আত্মীয়-স্বজনদের খাইয়ে কিংবা উপহার দিয়েও মানসিক তৃপ্তি পাওয়া যায়, সম্পর্কের বাঁধন মজবুত করা যায়। কিন্তু, তৃপ্তিলাভের অন্যতম রসদ মিষ্টি যদি ভেজাল হয়, তাহলে আনন্দে কিছুটা হলেও ভাটা পড়বে। কারণ, ভেজাল মিষ্টি শরীর এবং মনের উপর কুপ্রভাব ফেলবেই।
বছরের নানারকম উৎসবের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মিষ্টি বিক্রি হয় সম্ভবত দীপাবলি উপলক্ষ্যে। মিষ্টির দোকানগুলিতে ক্রেতাদের ভিড় দেখেই মিষ্টির চাহিদার বিষয়টি বেশ বোঝা যায় এই সময়। আর ভিড় যত বাড়ে, মিষ্টির চাহিদা তত বাড়ে, তা চটজলদি যোগান দিয়ে বেশি মুনাফার আশায় অনেক মিষ্টি ব্যবসায়ী বিক্রি করেন ভেজাল মিষ্টি। এই প্রবণতা ক্রমশ বাড়ছে বিক্রেতাদের মধ্যে। গুণমান পরীক্ষাকারী সরকারি দফতর মাঝেমধ্যে অসৎ ব্যবসায়ীদের ধরপাকড় করলেও, তা সবসময় ফলপ্রসূ হয় না। আসলের পরিবর্তে ভেজাল মিষ্টি কিনে ঠকে যাওয়ার সম্ভাবনা তাই থেকে যায়।
মিষ্টির প্রধান উপকরণ ছানা থেকে শুরু করে রং– সবকিছুই ভেজাল বা নকল হয় চাহিদা বাড়লে। যে-সব মিষ্টির বিক্রি যত বেশি, সেইসব মিষ্টি ভেজালযুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা ততই বেশি। ক্রেতাদের ঠকানোর এই প্রবণতা অনেক বিক্রেতার মধ্যেই রয়েছে। তাই সতর্ক থাকতে হবে মিষ্টি কেনার সময়।
ভেজাল ছানা
১ কিলোগ্রাম দুধ থেকে মাত্র ২০০ গ্রাম ছানা তৈরি হয়। এতে ছানার ব্যবসায়ী এবং মিষ্টি বিক্রেতা বেশি লাভ করতে পারে না। তাই তারা ভেজাল ছানা দিয়ে বেশি অর্থ উপার্জনের পথ বেছে নেয়। এরজন্য আটা, ময়দা, রাঙাআলু এবং সুজি অল্প ছানার সঙ্গে মিশিয়ে মিষ্টি তৈরি করে বিক্রি করছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। তবে সতর্ক থাকলে আসল ছানায় তৈরি মিষ্টি এবং ভেজাল মিষ্টির তফাত বোঝা যাবেই।
প্রথমত, ভেজাল মিষ্টি নষ্ট হয়ে যাবে খুব তাড়াতাড়ি। দ্বিতীয়ত, আসল ছানার মিষ্টি থেকে শুধু ছানার গন্ধ পাওয়া যাবে। যদি মিষ্টির গন্ধ অন্যরকম হয়, তাহলে তখনই সেই মিষ্টি না কেনার সিদ্ধান্ত নিন। তৃতীয়ত, আসল ছানার মিষ্টি খুব ভারী হয় না। আটা, ময়দা, আলু কিংবা সুজি মেশানো মিষ্টি-ই ভারী হয়। অতএব, মিষ্টির কোয়ান্টিটির তুলনায় যদি বেশি ভারী মনে হয়, তাহলে সেই মিষ্টি না কেনা-ই ভালো।
আপাতদৃষ্টিতে আসল আর ভেজাল মিষ্টির তফাত যাতে না বোঝা যায়, তার জন্য কেমিক্যাল ব্যবহার করে অসাধু ব্যবসায়ীরা। সেক্ষেত্রে কোনটা খাঁটি ছানায় বানানো, তা বোঝবার জন্য গন্ধ নিয়ে দেখতে হবে। কারণ, খাঁটি ছানার একটা আলাদা গন্ধ হয়।
অল্প মিল্ক পাউডার, ময়দা আর বনস্পতি ঘি মিশিয়ে ছানার বিকল্প ভেজাল মিষ্টি তৈরি করে বিক্রি করেন কিছু আসাধু ব্যবসায়ী। তাছাড়া, বাজারে এখন সিন্থেটিক গুঁড়ো দুধও পাওয়া যায়। যার সঙ্গে অল্প ছানা এবং অন্যান্য সামগ্রী মিশিয়ে মিষ্টি তৈরি করা হয়।
সিন্থেটিক দুধের সঙ্গে ইউরিয়া মিশিয়ে হালকা অাঁচে ফুটিয়ে, ওর সঙ্গে কাপড় কাচা সাবান, সোডা এবং কিছুটা আসল দুধ যোগ করে ছানা তৈরি করেন অনেক মিষ্টির দোকানি। এই ছানা সবচেয়ে ক্ষতিকারক।
শারীরিক ক্ষতি
ভেজাল ছানা থেকে খাবারে বিষক্রিয়া হতে পারে। সিন্থেটিক দুধ, ওয়াশিং পাউডার, কেমিক্যাল-যুক্ত রং প্রভৃতি ব্যবহার করে তৈরি ভেজাল মিষ্টি, কুপ্রভাব ফেলতে পারে কিডনি এবং লিভারে। হতে পারে স্কিন ডিজিজ। শুধু তাই নয়, ভেজাল মিষ্টি খেলে স্কিন ক্যানসার, লিভার ক্যানসার প্রভৃতিতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যেতে পারে। অতএব, শারীরিক ক্ষতি এড়ানোর জন্য প্রথমে মিষ্টির ঘ্রাণ নিয়ে পরীক্ষা করুন এবং অল্প পরিমাণ মিষ্টি মুখে দিয়ে দেখুন। যদি ডিটারজেন্ট, কেমিক্যাল ইত্যাদির গন্ধ পান কিংবা মিষ্টিতে আসল ছানার টেস্ট না পান, তাহলে ওই মিষ্টি পরিবারের সকলের জন্য কিনে না আনাই ভালো। প্রয়োজন হলে একটু ক্ষতি স্বীকার করে একটি মিষ্টি জলে ফেলে দেখুন জলের রং দেখা যায় কিনা কিংবা জলটা নাড়া দিলে ফেনা উঠছে কিনা দেখে নিন। যদি জলে রং এবং ফেনা দেখা যায়, তাহলে সেই মিষ্টি না খাওয়াই ভালো।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা
ছানা দিয়ে তৈরি আসল মিষ্টি আর ভেজাল মিষ্টি চেনার জন্য কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা জরুরি। কেনার সময় যদি আসল আর ভেজালের তফাত বুঝতে না পারেন, তাহলে মিষ্টি বাড়ি নিয়ে এসে পরীক্ষা করুন। যদি মিষ্টির গুণগত মান ঠিক থাকে তাহলে খান, আর যদি ভেজাল সন্দেহ হয়, তাহলে দোকানে গিয়ে অভিযোগ জানিয়ে মিষ্টি ফেরত দিয়ে টাকা ফেরত নিন এবং ওই দোকান থেকে মিষ্টি কেনা বন্ধ করে দিন। কিন্তু, তার আগে আপনি জেনে নিন কীভাবে ভেজাল মিষ্টি ধরবেন।
> মিষ্টি ভেজাল কিনা তা বুঝবার জন্য একটু আয়োডিন ছড়িয়ে দিন মিষ্টির উপর। যদি মিষ্টি কালো হয়ে যায়, তাহলে সেই মিষ্টি ভেজাল ধরে নিতে হবে
> দুই আঙুলে মিষ্টি চেপে ধরে ডলে দেখুন, যদি আঙুলে মসৃণ না মনে হয়, অর্থাৎ দানা-দানা লাগে, তাহলে সেই মিষ্টি ভেজাল হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি
> যে-কোনও মিষ্টি খাওয়ার আগে যদি ভেজাল বলে সন্দেহ হয়, তাহলে প্রথমে অন্তত একটা মিষ্টি একটা সাদা টিস্যু পেপার-এ মুড়ে কিছুক্ষণ রাখুন। যদি দেখা যায় সাদা টিস্যু পেপার অন্য কোনও রং ধারণ করেছে, তাহলে বুঝতে হবে, মিষ্টিতে ভেজাল আছে
একটা মিষ্টিকে জলে দিয়ে একটু ফোটান, যদি দেখা যায় জলে ফেনা হচ্ছে এবং সেই ফেনা ক্রমশ বাড়ছে, তাহলেও জানবেন ওই মিষ্টিতে ওয়াশিং পাউডার জাতীয় উপকরণ যোগ করা হয়েছে