রান্নাঘরে অঞ্জনের টিফিন বানাতে বানাতে নমিতা টিভির পর্দায় মাঝে মাঝেই চোখ রাখছিল। কয়েকদিন ধরেই মিডিয়াগুলো ‘মি টু’ আন্দোলন নিয়ে পড়েছে। রোজই নতুন নতুন খবর উঠে আসছে। খবরটা নমিতা নিয়ম করেই দেখে। কোথায় কী হচ্ছে নয়তো জানবে কীভাবে?
অঞ্জন এসে শেল্ফ-এর সামনে দাঁড়াল। নমিতার ফ্ল্যাটে ওপেন কিচেনের ব্যবস্থা সুতরাং রান্না করতে করতে টিভি দেখাটাও নমিতার অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছিল। স্বামীকে দেখে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল।
‘সকাল সকাল এদের আবার শুরু হয়ে গেছে। দেশে বেকারত্বের সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে, চাষি আত্মহত্যা করছে, দেশের অবস্থা দিনে দিনে খারাপ হচ্ছে। আর এই মহিলাদের দ্যাখো, এদের আর কোনও কাজ নেই, মি টু-তে সমস্বরে গলা মেলাচ্ছে। আমার শুধু এদের জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে, যখন ঘটনাটা ঘটেছিল তখন কেন প্রতিবাদ করেনি, ব্যাপারটা গোপন করে গিয়েছিল? এখন চেঁচিয়ে কী লাভ? আসলে এরা চায় প্রচারের আলোয় থাকতে। এ হচ্ছে পুরুষদের বিরুদ্ধে চক্রান্ত। বন্ধ করো টিভি, খবরে আজকাল আর কিছুই দেখাবার নেই’, বিরক্ত বদনে নিজেই এগিয়ে গিয়ে টিভিটা বন্ধ করে দেয় অঞ্জন।
টিফিন কৗটোর ঢাকনা বন্ধ করতে করতে নমিতা উত্তর দেয়, ‘আচ্ছা এইসব মহিলারা মিথ্যা বানিয়ে বলছে আর তোমরা পুরুষরা সব ধোয়া তুলসীপাতা? আমাদের সমাজটা এইভাবেই মহিলাদের চুপ করিয়ে তাদের শালীনতায় মুড়ে রাখতে চায়। গলা তুলতে গেলেই, সেটা মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে সমাজ উঠেপড়ে লেগে যায়।’
‘আমি ঠিক এটা বলতে চাইনি। কিন্তু ৩০ বছরের পুরোনো কাদা ঘেঁটে লাভটা কী হবে বলতে পারো? সেক্সুয়াল অ্যাসল্ট বা হ্যারাসমেন্ট যখন ফেস করেছিল তখনই দরকার ছিল প্রতিবাদ করার’, অফিসের শার্ট-টা পরতে পরতে জবাব দেয় অঞ্জন।
অঞ্জনের মনোভাব বুঝতে পেরে রেগে যায় নমিতা, ‘তোমার এটা চিৎকার-চ্যাঁচামেচি মনে হচ্ছে কারণ তুমি সত্যিটা দেখতে চাইছ না। আসলে এটা শুধু পুরুষদের দোষ নয়, সমাজের বানানো নিয়মে অত্যাচার করার পরেও ওই মেয়েগুলোকেই আবার চুপ করে থাকার জন্য ভয় দেখানো হয়।
অফিসে গিয়ে দ্যাখো মেয়েরা যৗন শোষণের বিরুদ্ধে সরব হলেই তাদের চাকরি চলে যাচ্ছে আর যারা বাড়িতে রয়েছে তাদের এত সাহস কোথায়? ছোটো থেকে মেয়েদের শেখানো হয় লজ্জাই মেয়েদের ভূষণ অথচ ছেলেদের স্বাধীনতা ছুট দিয়ে রেখেছে সমাজ।
আমার তো খুব আনন্দ হচ্ছে এই দেখে যে ভারতবর্ষের মতো দেশে এই প্রথম পুরুষরা কিছুটা ভয় পেয়েছে। আগে হয়তো এমন কোনও অপরাধ সে করে এসেছে, যেটা এই আন্দোলনের ফলে সবার সামনে ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়ে সে মনে মনে ভীত হয়ে পড়ছে। সীতাকে আর অগ্নিপরীক্ষা দিতে হবে না, এবার রামের পালা’, গর্বের সঙ্গে বলে নমিতা।
‘আচ্ছা এবার বক্তৃতা দেওয়া বন্ধ করো… খেতে দেবে তো দাও নয়তো টিফিন নিয়ে আমি অফিস বেরিয়ে যাচ্ছি’, বিরক্ত মুখে বলে অঞ্জন।
ভাতের থালাটা অঞ্জনের সামনে নামিয়ে রাখতে রাখতে আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল নমিতা, ‘কী ব্যাপার বলো তো, তুমি এত রেগে যাচ্ছ কেন? তুমিও কি কারও সঙ্গে… ভয় পাচ্ছ নাকী যে তোমারও পুরোনো পাপ ধরা পড়ে যাবে?’
নমিতার কথা শুনে ভাত আটকে যায় অঞ্জনের গলায়। এক ঢোঁক জল খেয়ে গলাটা পরিষ্কার করে বলে, ‘কী… পাগলের মতো বলছ? বিনা কারণে আমাকে এসবের মধ্যে টেনে আনছ কেন? দোষ কেউ করেছে আর সন্দেহ আমার উপর। সকলেই জানে আমি কীরকম, সুতরাং নিজের সম্পর্কে আমি কিছুই বলতে চাই না।’
‘হুঁ, এটা ভুলো না যাদের চরিত্রের সত্যিটা আজ সকলের সামনে খুলে গেছে তাদের সম্পর্কেও কিন্তু মানুষের আগে অন্যরকম ধারণা ছিল… হঠাৎ করেই হয়তো জানতে পারলাম তুমিও কোনও মেয়ের সঙ্গে… আর আমি এটা তো শুধু উদাহরণ দিচ্ছি’, টিফিন বক্সটা অঞ্জনের হাতে দিতে দিতে নমিতা বলল।
অঞ্জন জ্বলে উঠল নমিতার কথা শুনে। ইচ্ছে করছিল টিফিনটা ছুড়ে মারে নমিতার মুখের উপর। আবিশ্বের পুরুষরা সব খারাপ আর মহিলারা সব সতীসাধবী! নিজেকে সংযত করল অঞ্জন। নমিতার সামনে প্রতিবাদ করা মানে নিজেকেই সন্দেহের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো। বরং সুর নরম করল অঞ্জন, ‘এখন নিজের স্বামীকেও ভরসা করছ না? আমাকে তোমার এতটাই নীচ চরিত্রের মনে হয় যে, তুমি আমাকে এসব কথা বলতে পারছ?’
নমিতার মনে হল একটু বেশি-ই বলা হয়ে গেছে অঞ্জনকে। ও যাতে মনে দুঃখ না পায় তাই গলায় যথা সম্ভব মাধুর্য নিয়ে এসে বলল, ‘আমি তো এমনি-ই তোমাকে এইসব বলছিলাম, আমি কি তোমাকে চিনি না? আচ্ছা এবার অফিসে বেরোও, নয়তো পরে বলবে আমার জন্য তোমার অফিস যেতে দেরি হয়ে গেল।’
‘হুঁ, আজ আবার একটা মিটিং আছে অফিসে’, বলে বেরিয়ে আসে অঞ্জন। অফিস যেতে যেতে মনের মধ্যে তোলপাড় হতে থাকে ওর। ভয় বাসা বেঁধেছে ওর মনে। মি টু নিয়ে যা আরম্ভ হয়েছে তাতে ওর নিজের কেলেঙ্কারি ফাঁশ হবার আশঙ্কা কিছুতেই উড়িয়ে দিতে পারছে না। শিউরে ওঠে অঞ্জন। নমিতা কিছুতেই ওর অন্যায় বরদাস্ত করবে না, শাস্তি পাওয়ার সব ব্যবস্থা করে তবে ছাড়বে। বাচ্চাদের চোখেও ওর সম্মান ধুলোয় মিশে যাবে। এতদিনের চেষ্টায় সমাজে যে মান-সম্মান অর্জন করেছে, তাও আর বজায় রাখা সম্ভব হয়ে উঠবে না।
মিটিং-এও ঠিকমতো মন দিতে পারল না অঞ্জন। রোজকার মতো সবাইকে বকে ধমকে কাজ করিয়ে নেওয়ার এনার্জি কিছুতেই জোগাতে পারল না। অফিসে কিছুই ভালো লাগছিল না। সন্দীপ এসে কেবিনে উঁকি মারল।
‘কী হল, আজ এত চুপচাপ যে? ঢুকলি যখন আমার ‘গুডমর্নিং’-এ সাড়া দিলি না, আবার এখন এভাবে বসে থাকা, কারও ওপর চ্যাঁচামেচি করছিস না… কী হল কী তোর? কোনও মহিলা তোকে আবার ফাঁসিয়ে দেয়নি তো?’ সন্দীপ এমন ভঙ্গিতে কথাগুলো বলল, কেবিনের বাইরে যারা বসে তাদের মধ্যে হাসির রোল উঠল।
কেবিনের বাইরে থেকে কারও গলা ভেসে এল, ‘ছাড় না সন্দীপ, বউয়ের সঙ্গে হয়তো ঝগড়া হয়েছে। ওকে ওর মতো থাকতে দে না।’ সন্দীপ বেরিয়ে আসে ঘর থেকে।
অফিসে দিনটা কোনওমতে কাটিয়ে অঞ্জন বাড়িতে ফিরে আসে। হাত-মুখ ধুয়ে বসতে বসতে খেয়াল করে নমিতা ফোনে ব্যস্ত রয়েছে। নমিতার কথাগুলো কানে ভেসে আসে, ‘দেখিস লোকটা যেন কোনওমতেই ছাড়া না পায়, নিজেকে কী ভাবে বলতো? খুব তো ভদ্র সেজে ঘুরত। নাতি, নাতনি সব রয়েছে অথচ দেখ নিজের মেয়ের বয়সি একটা মেয়েকে… আচ্ছা এখন আমি রাখছি, অঞ্জন অফিস থেকে ফিরেছে’, বলে নমিতা ফোন নামিয়ে রাখে।
‘কী হয়েছে?’ অঞ্জন জানতে চায়। ‘আমি তোমাকে ফোন করতেই যাচ্ছিলাম। জানো, পাড়ার সুজিতদার উপর কোনও মেয়ে নাকি হ্যারাসমেন্টের কেস দিয়েছে, অথচ সুজিতদাকে দেখে ভদ্র বলেই মনে হতো। ভদ্রলোকের বউয়ের বক্তব্য, মেয়েটি মিথ্যা আরোপ দিচ্ছে, সুজিতদাকে নাকি বদনাম করতে চাইছে। বউদি সবাইকে বলেছে মেয়েটি সুজিতদার কাছে চাকরি করত। কোনও কারণে মেয়েটিকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করায় সুজিতদার উপর রেগে যায় মেয়েটি এবং মিথ্যা বদনাম দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। আমার তো বউদির উপর রাগ হচ্ছে যে একজন অপরাধীকে বাঁচাবার চেষ্টা করছেন উনি। কিন্তু যতই চেষ্টা করুন না কেন সুজিতদাকে কিছুতেই বাঁচাতে পারবেন না। ওনার বউকেও জেলে পুরে দেওয়া উচিত’, রাগে নমিতার মুখ-চোখ লাল হয়ে ওঠে।
‘হতে তো পারে যে সুজিতদাই সত্যি কথা বলছেন আর মেয়েটি মিথ্যা…’
‘মিথ্যা…?’ অঞ্জনের কথার মাঝখানেই নমিতা ওকে থামিয়ে দেয়। ‘কেন কোনও মেয়ে শুধু শুধু নিজেকে বদনাম করবে? নিশ্চয়ই ওর সঙ্গে কিছু ঘটেছে বলেই না ও গলা তুলেছে। সাধারণত মেয়েরা প্রতিবাদ করে না বলেই পুরুষরা বেঁচে যায়। আর বউগুলোকে দ্যাখো, স্বামী দোষী জেনেও তাকে বাঁচাবার চেষ্টা করতে থাকে। সত্যি বলছি অঞ্জন, আমার স্বামী যদি এরকম করত, আমি ছাড়তাম না, জেলে পাঠিয়ে তবে বিশ্রাম নিতাম।’ নমিতার কথা শুনে ভিতরে ভিতরে শিউরে উঠল অঞ্জন।
‘একবার ভেবে দ্যাখো, আমাদেরও মেয়ে রয়েছে। কেউ যদি ওর সঙ্গে এরকম করত তাহলে? ছিঃ মেয়েরা জড়পদার্থ নাকি যে, তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যার যেরকম ভাবে ইচ্ছে তাকে ব্যবহার করবে? এটা সমাজের পক্ষে লজ্জাকর, অঞ্জন’, নমিতা কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠে।
কথা শেষ করে নমিতার দৃষ্টি পড়ে অঞ্জনের ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া মুখটার উপর। ‘একী, তোমার কী হল, মুখটা এত শুকনো লাগছে কেন? আমি জানি তোমারও ব্যাপারটা শুনে খুব খারাপ লাগছে,
যে-কোনও ভদ্রলোকেরই ঘটনাটা জেনে ঠিক এরকমই মনোভাব হবে। আসলে কারও চরিত্র সম্পর্কে হলফ করে কিছু বলা আজ আর সম্ভব নয়’, বলে নমিতা রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায়।
মনের মধ্যে ঝড় চলতে থাকে অঞ্জনের। আজ সুজিতদা পাড়ায় আলোচনার বস্তু হয়ে উঠেছেন, যে-কোনও দিন অঞ্জনের নামও আলোচনার বিষয় হয়ে উঠতে পারে। নিজের সন্তানদের কাছে মুখ দেখাবে কী করে? ঘেমে ওঠে অঞ্জন, চুপচাপ এসে শোবার ঘরে শুয়ে পড়ে।
রাতের খাওয়া-দাওয়া মিটিয়ে নমিতা আর বাচ্চারা তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লেও, হাজার চেষ্টা করেও অঞ্জন দুচোখের পাতা এক করতে পারল না। নানা চিন্তা এসে ওকে ঘিরে ধরছিল। ওর খালি মনে হচ্ছিল সকলে এমনকী বাড়ির প্রতিটা আসবাবপত্র পর্যন্ত ওকে উপহাস করছে, বলছে, ‘দেখছ তো অঞ্জন, এতদিন স্রোতে গা ভাসিয়ে চলে এসেছ আজ স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে কীরকম বোধ করছ? বাঁচতে তো তুমিও পারবে না। হ্যাঁ দেরি হয়েছে বটে কিন্তু সকলেই নিজের নিজের কর্মের ফল একদিন পাবেই, তুমিও বাদ যাবে না।’ ঘেমে নেয়ে বিছানাতেই উঠে বসে অঞ্জন। জোরে জোরে নিঃশ্বাস পড়তে থাকে। ভয় যেন সম্পূর্ণ গ্রাস করে ওকে কিন্তু কাকে বলবে এইসব কথা এবং কী-ই বা বলবে? ওর করা অপরাধের কথা যদি সবাই জানতে পেরে যায়, তাহলে এতদিনের সংসারটা ওর তছনছ হয়ে যাবে।
নিজের মনেই হাজারো প্রশ্ন উঠতে থাকে অঞ্জনের। আবার নিজেই নিজেকে স্ত্বান্না দেয়। মন বলে এরকম কিছুই ঘটবে না, বেকার কেন ও এত চিন্তা করছে? শ্রেয়া কখনওই নিজের মুখ খুলবে না, আর যদি খোলে ওকে মিথ্যা প্রমাণ করতে কতটুকুই বা পরিশ্রম হবে? ও প্রমাণ জোগাড় করার চেষ্টা করতে পারে কিন্তু কার সাহস হবে অঞ্জনের বিরুদ্ধে কিছু বলতে? ও বরং নিজেই শ্রেয়াকে দোষী প্রমাণিত করে দেবে। অঞ্জনের চোখের সামনে ৭-৮ বছর আগেকার ঘটনাগুলো ভেসে উঠতে থাকে। শ্রেয়ার উপর করা এক-একটা অত্যাচারের পাতা পরপর খুলে যেতে থাকে অঞ্জনের চোখের সামনে।
সাত-আট বছর আগে যে কোম্পানিতে ছিল অঞ্জন, সেখানেই শ্রেয়া অঞ্জনের অধীনে কাজ করত। তন্বী চেহারার মেয়েটির এক মাথা ঘন কালো চুল, ডাগর দুটো চোখ এবং ত্বকের গোলাপি আভা অঞ্জনের দুর্নিবার আকর্ষণের কারণ ছিল। শ্রেয়াকে দেখলেই ওকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করত অঞ্জন যা শ্রেয়ার কাছে অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠেছিল। ওর সামনে এলে শ্রেয়া কিছুতেই সহজ হতে পারত না, জামাকাপড় ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে উঠত যেন।
শ্রেয়া বুঝতে পারত, অঞ্জনের ওর প্রতি দুর্বলতার কারণ ওর শরীরটা ছাড়া আর কিছু নয়। আপ্রাণ চেষ্টা করত সময়ের মধ্যে সব কাজ গুছিয়ে ছুটি হলেই অফিস থেকে বেরিয়ে যেতে, কিন্তু রোজ সেটা সম্ভব হয়ে উঠত না। অন্য কোনও কাজের অছিলায় অঞ্জন মাঝেমধ্যেই ওকে নিজের কেবিনে ডেকে পাঠাত। ছুটির পরেও ওকে আটকে রাখত। কাজ করতে করতেও শ্রেয়া বেশ বুঝতে পারত ওকে ঠিক কী নজরে দেখছেন অঞ্জন স্যার। মাঝে মাঝে চোখ পড়ে যেত স্যারের চোখে কিন্তু তাতেও অঞ্জন বিন্দুমাত্র বিচলিত হতো না বরং বাধ্য হয়ে লজ্জায় শ্রেয়াকেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে হতো।
ধীরে ধীরে সাহস বাড়তে আরম্ভ করে অঞ্জনের। ছলছুতো করে শ্রেয়ার গায়ে হাত দিতেও শুরু করে দেয়। কখনও পিঠে, ঘাড়ে, বুকে অনাবশ্যক হাত দিয়ে ফেলে আবার অমায়িক একটা ‘সরি’ ছুড়ে দিতেও কসুর করত না।
শ্রেয়ার রক্তাক্ত মনে অশ্রু ঝরত শুধু, প্রতিবাদ করে উঠতে পারত না। মেয়ে হয়ে জন্মানো পাপ বলে মনে হতো। বাবার হঠাৎ মৃত্যুর পর মা আর ভাইয়ের দায়িত্ব না নেওয়া ছাড়া উপায় কিছু ছিল না আর অঞ্জন স্যার ওর বাড়ির অবস্থা পুরোটাই জানতেন এবং সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে মুহূর্ত সময় নষ্ট করেননি।
সেদিনও এমনি এমনি মিথ্যা কাজের বাহানায় অঞ্জন শ্রেয়াকে নিজের কেবিনে বসিয়ে রেখেছিল। অফিস অনেকক্ষণ ছুটি হয়ে গিয়েছিল। অঞ্জন ওকে বাড়ি ছেড়ে দেবে এই অজুহাতে শ্রেয়াকে আটকে রেখেছিল। শ্রেয়া তাড়াতাড়ি কাজ সেরে বাড়ি যাওয়ার চেষ্টা করছিল, হঠাৎ-ই অঞ্জন পিছন থেকে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে নিজের দিকে জোর করে টেনে নেয়। শ্রেয়ার সারা শরীরে, মুখে ত৫ চুম্বনের রেখা স্লঁকে দিতে থাকে।
শ্রেয়া নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। কোনওমতে মুখ সরিয়ে প্রতিবাদ করার চেষ্টা করে, ‘স্যার, এটা কী করছেন আপনি? ছাড়ুন আমাকে।’
‘শ্রেয়া, এই দিনটার জন্য কতদিন আমি অপেক্ষা করেছি। আজ কী করে তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেব বলো’, শ্রেয়ার চুলে মুখ ঘষতে ঘষতে বলে অঞ্জন।
হঠাৎ-ই কেবিনের দরজায় টোকা। অবাক হয়ে সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে দেয় শ্রেয়াকে। ‘কাম ইন’, বলাতে অফিসের পিওন এসে ঢোকে যাকে আগেই ছুটি দিয়ে দিয়েছিল অঞ্জন।
‘কী ব্যাপার, তুমি ফিরে এলে যে?’
‘না স্যার, আমার টিফিনের কৗটোটা নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছিলাম। সেটাই নিতে এসেছি’, কাঁচুমাচু ভাবে জবাব দেয় পিওন।
‘ঠিক আছে, নিয়ে নাও’, বিরক্তি সহকারে জবাব দেয় অঞ্জন।
শ্রেয়া কিন্তু মনে মনে ধন্যবাদ জানায় পিন্টুকে। হোক না অফিসের পিওন কিন্তু সবসময় সম্মান দিয়ে কথা বলে শ্রেয়া ওর সঙ্গে। ওর কেন জানি না মনে হয় কিছু একটা অঘটনের অাঁচ পেয়েই পিন্টুদা অফিসে ফিরে এসেছে। টিফিন কৗটোটা একটা বাহানা মাত্র। পিন্ঢুদার জন্য আজ ও বেঁচে গেল এই জঘন্য লোকটার হাত থেকে।
অঞ্জন কিন্তু মোটেই খুশি হল না। ওর এই ব্যর্থতার জন্য দায়ী করল পিন্টুকেই এবং সুযোগ বুঝে শ্রেয়াও অফিস ছেড়ে বেরিয়ে এল। অঞ্জন এখানেই থেমে থাকল না, সুযোগ খুঁজতে লগল শ্রেয়াকে নিজের জালে ফাঁসাবার।
সুযোগ এল খুব শিগগির। শহরের বাইরে কাজ পড়ল অঞ্জনের। তৎক্ষণাৎ ফোন করল শ্রেয়াকে, ‘শ্রেয়া কাল তৈরি হয়ে অফিসে এসো। দুদিনের জন্য আমার সঙ্গে তোমাকে অফিসের কাজে শহরের বাইরে যেতে হবে।’
‘কিন্তু স্যার, আমার পক্ষে যাওয়া…’, শ্রেয়ার না-যাওয়ার বাহানা না শুনেই ওকে থামিয়ে দেয় অঞ্জন, ‘শ্রেয়া তোমার ইচ্ছে, অনিচ্ছে জানতে চাইনি আমি। ইট্স মাই অর্ডার। বসের সঙ্গে তোমার যাওয়ার সুযোগ হচ্ছে নয়তো তোমার মতো মেয়েদের সকলে জুতোর তলায় রাখে।’
শ্রেয়া ভালো করেই জানত ওকে সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যই হচ্ছে ওর শরীরটাকে ভোগ করা। অঞ্জনের হাত থেকে ওর নিস্তার নেই। অফিসে থাকতে গেলে অঞ্জন স্যারের কথামতো চলতে হবে আর নয়তো চাকরি হারাতে হবে। এই সত্য বুঝতে পেরে গিয়েছিল শ্রেয়া। মুহূর্তে নিজের মনকে তৈরি করে নিল ও। পদত্যাগপত্র লিখে জমা করে বেরিয়ে এল অফিস ছেড়ে। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল। অনেকদিন ধরেই অন্য চাকরির সন্ধান করছিল কারণ অঞ্জনের সঙ্গে এক অফিসে চাকরি করতে পারবে না বেশ বুঝতে পারছিল শ্রেয়া। জানে কটা দিন একটু কষ্ট করতে হবে কিন্তু পার্থ আছে ওর পাশে। কটা দিন পরেই পার্থর সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। একদিক দিয়ে ভালোই হল বলে শ্রেয়ার মনে হল। এই অফিসের কেলেঙ্কারির কথা যদি বিয়ের পর পার্থ-র মা-বাবা জানতে পারতেন তাহলে কতটা লজ্জার সম্মুখীন হতে হতো সেটা ভেবে শ্রেয়া শিউরে ওঠে।
কয়েকদিন ঘোরাঘুরি করে একটা ভালো চাকরিও পেয়ে গেল শ্রেয়া। নতুন চাকরিতে জয়েন করার তিনমাস পরেই পার্থর সঙ্গে শ্রেয়ার বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের পর নিজের ফোনের নম্বর বদলে ফেলল ও, যাতে অঞ্জন কোনও ভাবেই ওকে কনট্যাক্ট করতে না পারে। অতীতের দুঃস্বপ্ন কাটিয়ে নতুন জীবনের সুখে নিজেকে ভাসিয়ে দিল শ্রেয়া। অঞ্জনের স্মৃতি মন থেকে মুছে ফেলতে বদ্ধপরিকর হল ও।
শ্রেয়া জানতে পারল না, একদিন যেখানে ও অঞ্জনের মুখোমুখি যাতে না হতে হয় তার জন্য পালিয়ে বেড়াত, সেখানে আজ অঞ্জন শ্রেয়ার ভয়ে ভীত হয়ে রয়েছে। সবসময় অঞ্জনের মনে হতো এই বুঝি শ্রেয়া এসে সকলের সামনে অঞ্জনের আসল চেহারার উপর থেকে পর্দাটা সরিয়ে দেবে। রাত্রে ভালো করে ঘুমোতেও পারত না। অজানা, অচেনা কেউ বাড়িতে এলেও ভয়ে কুঁকড়ে যেত অঞ্জন। কলিংবেল বাজলে বুক কেঁপে উঠত ওর, ভাবত ওই বুঝি শ্রেয়া ওর দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে ওর কুকীর্তির সাক্ষী হয়ে।
একদিন অফিস থেকে ফিরতেই নমিতা জানাল একটি লোক অঞ্জনের নামে একটা মুখবন্ধ খাম দিয়ে গিয়েছে।
‘কোথায় রেখেছ খামটা। কী থাকতে পারে ওতে?’ শঙ্কিত হয়ে অঞ্জন নমিতার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিল।
‘জানি না, হয়তো ফোটো বা ওই ধরনের কিছু হবে। দেখি খামটা খুলে’, বলে খামটা হাতে নিতেই অঞ্জন ছোঁ মেরে নমিতার হাত থেকে খামটা ছিনিয়ে নিল।
‘আমার চিঠি তুমি খুলছ কেন?’ নমিতা অঞ্জনের কান্ডকারখানা দেখে অবাক হয়ে গেল। তোমার কী হয়েছে বলো তো। আগে তোমার সব চিঠি আমি-ই তো খুলতাম, আজ হঠাৎ হল কী? তুমি তো এমন ভয় পাচ্ছ যেন মনে হচ্ছে এর মধ্যে তোমার গোপন কোনও তথ্য লুকোনো রয়েছে?’
নমিতার কথা শুনে চমকে ওঠে অঞ্জন। নমিতা কি ওকে সন্দেহ করতে শুরু করেছে? কাঁপা কাঁপা হাতে খামটা খুলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। খামটাতে অন্য কিছু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র রয়েছে যেটা ওরই বন্ধু পাঠিয়েছে।
অঞ্জনের ব্যবহারে নমিতা প্রায়শই আশ্চর্য হয়ে পড়ত। মাঝেমধ্যেই মনে হতো অঞ্জনের মাথার কোনও গোলমাল হল না তো? সত্যিটা নমিতা জানবেই বা কী করে? অতীতে করে আসা পাপের দংশনই যে অঞ্জনকে ভীত, ত্রস্ত করে তুলছে। অঞ্জনের সব সময় মনে হতো একবার শ্রেয়ার সঙ্গে দেখা করে ও ক্ষমা চেয়ে নিলেই সব ঠিক হয়ে যেতে পারত। অথবা পুরোনো দিনগুলো যদি ফেরত আনা যেত তাহলে নিজের চরিত্রটা শুধরে নেওয়ার একটা সুযোগ থাকত। কিন্তু অতীত-কে ফিরিয়ে আনা কি সম্ভব?
অঞ্জন সিদ্ধান্ত নেয়, যেভাবেই হোক শ্রেয়ার সঙ্গে দেখা করে ওকে ক্ষমা চাইতেই হবে। নয়তো সারাজীবন এই অশান্তিতে ওকে কাটাতে হবে যে, কবে ও ধরা পড়ে যাবে। চেষ্টা করে শ্রেয়ার ঠিকানাও জোগাড় করে ফেলে। যাবে যাবে করতে করতে একদিন হঠাৎই শ্রেয়াকে ও দেখে একটা থানায় ঢুকতে। দেখেই মনের মধ্যে পুরোনো ভয়টা আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ওর মনে হয় শ্রেয়া নিশ্চয়ই ওর বিরুদ্ধে রিপোর্ট লেখাতেই থানার দ্বারস্থ হয়েছে নয়তো শ্রেয়ার মতো মেয়ের থানায় কী কাজ থাকতে পারে?
থানার বাইরে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে অঞ্জন, শ্রেয়ার বাইরে বেরোবার জন্য কিন্তু কোনও লাভ হয় না। বাধ্য হয়ে ও ওখান থেকে চলে আসে। খালি মনের মধ্যে একটাই প্রশ্ন বারবার ঘুরেফিরে আসতে থাকে যে শ্রেয়া থানায় কেন গিয়েছিল?
এই ভাবেই কেটে যায় দু-তিন সপ্তাহ। এর মধ্যে অঞ্জন জানতে পারে শ্রেয়ার থানায় আসার কারণ। ওর ভাইয়ের বউ, শ্রেয়ার মা ও ভাইয়ের বিরুদ্ধে থানায় রিপোর্ট লিখিয়েছে মানসিক ও শারীরিক অত্যাচারের। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই শ্রেয়ার থানায় আসা।
একটু যেন স্বস্তি পায় অঞ্জন। শ্রেয়া পুলিশে জানালে এতদিনে নিশ্চয়ই পুলিশ বসে থাকত না, আইনি পদক্ষেপ অবশ্যই নিত। কিন্তু বলা যায় না। নমিতার কাছেই শুনছিল পাড়ার সুজিতদা আপাতত বাড়িতে ফিরেছে ঠিকই কিন্তু কোর্ট-কাছারি করতে হচ্ছে। নমিতা তো বেশ জোর গলায় বলল, যে-পাপ লোকটি করেছে তার সাজা অবশ্যই একদিন লোকটাকে পেতেই হবে। এটাই ওর ভরাডুবির কারণ হবে।
আজ অঞ্জন মনে করছে ও শ্রেয়ার হাত থেকে বেঁচে গেছে কিন্তু ভয়, আশঙ্কার খাঁড়াটা সারা জীবন ওর ঘাড়ের উপর ঝুলতে থাকবে। যে-কোনও মুহূর্তে ওটা লক্ষ্যে নেমে আসতে পারে। স্রোতের বিপরীতে থাকতে পারার জন্য মুহূর্তের আনন্দ বিষাদে বদলে যেতে পারে যদি শ্রেয়া ‘মি টু’ আন্দোলনে নিজেকে শামিল করে নেয়। এই সবই অঞ্জন ভালো করেই বুঝতে পারছিল এবং এই সত্যটাও ওর অজানা ছিল না যে, এখন থেকে সারাটা জীবন ওকে ভয়ে ভয়েই কাটাতে হবে। ভবিষ্যতে ওর ভাগ্যে কী আপেক্ষা করছে সেটা জানার আজ আর কোনও উপায় নেই। ঞ্জ