হাতকাটা গোপাল ঘরে বসে ভোজালিটা একটু ধার দিয়ে নিচ্ছিল। গোপাল জীবনে এমন কোনও বাজে কাজ করতে বাদ রাখেনি। এক সময়ে টাকার জন্য ওয়াগন ব্রেকারদের সাথে রাতের পর রাত কাজ করেছে। তারপর একটা রাজনৈতিক দলে ঢুকে সত্তর-একাত্তর সালে অনেক বোমাবাজি করেছে। তাদের হয়ে বোমা বেঁধেছে। কয়েক বছর আগে বোমা বাঁধতে গিয়ে ওর একটা হাত উড়ে যাওয়ায় সবাই ওকে হাতকাটা গোপাল হিসেবেই চেনে।

কিছুদিন বর্ষাতিয়ার দলেও কাজ করেছে। এখন নিজের দল

বানিয়ে কাজকর্ম চালায় তাই বর্ষাতিয়ার সাথে প্রায়ই গণ্ডগোল লেগেই থাকে। আজকাল অপরাধ জগতে বেশ নাম-ডাকও হয়েছে। তবে গর্ব করে বলে যে গোপাল বা তার দল কোনও মেয়ের দিকে ফিরেও তাকায়নি। আর ওর এই গুণটার জন্য পাড়ার লোকেরাও ওকে নিয়ে মাথা ঘামাত না।

হঠাৎ দরজা খোলার আওয়াজ হতেই ঘরের এককোণে ভোজালিটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। কারণ ওর দলের সকলকে বলা আছে, কেউ দরজায় আওয়াজ না দিয়ে ঘরে ঢুকবে না। দরজার দিকে তাকিয়ে দেখল ‘জাসসি’ ঘরে ঢুকছে। মুখে সেই ভুবন ভোলানো হাসি। জাসসি এখন অপরাধ জগতের ‘বিউটি কুইন’ নামেই পরিচিত। গোপাল জাসসি-র দিকে তাকিয়ে ভাবছে– মেয়েটা সুন্দরী এতে কোনও সন্দেহ নেই। শ্যাম্পু করা কালো রেশমের মতো চুল ঘরের আলোয় চকচক করছে। ওকে দেখে আর যাই হোক কুখ্যাত একটা চোরের দলের সদস্য বলে মনে হয় না।

–কিরে তুই এই অসময়ে? আমি-তো অন্য কেউ ভাবছিলাম।

–এসেছি একটা কাজে। বলেই হাতের ব্যাগটা টেবিলে রেখে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল।

ভুবন ভোলানো হাসি দিয়ে গোপালকে কাত করার চেষ্টা করল। এই হাসিটাই ওর একটা বড়ো সম্পদ। বলল– গোপাল, আমার ধারণা আমরা একজন আর একজনকে ভালোমতো বুঝতে পারি। সেটা বুঝতে পেরেছি বর্ষাতিয়ার দলে একসাথে কাজ করতে গিয়ে। আর এখন এটাও জেনে গেছি যে বর্ষাতিয়ার সাথে তোর

সাপে-নেউলের সম্পর্ক।

–তা তোর আসার উদ্দেশ্যটা কী বল। কী খাবি? ঠান্ডা না গরম?

–না থাক। আজ হাতে সময় নেই। তাছাড়া কেউ জানতে পারলে এতক্ষণে খবর পৗঁছে যাবে বর্ষাতিয়ার কাছে।

–তুই তো আজকাল বর্ষাতিয়ার খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিস। এমনকী শুনেছি তুই নাকি বর্ষাতিয়ার লাইফ পার্টনার হতে চলেছিস?

–সব বাজে কথা। আজকাল বর্ষাতিয়া রুমি-র সাথে খুব ঢলাঢলি করছে। অযোগ্য মেয়েটার প্রেমে মজে ওর পরামর্শে আমাকে দল থেকে বের করে দিয়েছে। এত খারাপ লাগছে তোকে কি বলব। আমার মাথায় এখন অপমানের আগুন দাউ-দাউ করে জ্বলছে। আর সে জন্যই তোর কাছে এসেছি।

–বলে ফ্যাল। তুই কি আমার দলে যোগ দিতে এসেছিস? তা যদি ভেবে থাকিস তাহলে সরি, আমি তোকে নিতে পারব না। আমার দলে আমি জেনেশুনেই কোনও মেয়েকে রাখি না। শালা, মেয়ে এলেই লাফরা শুরু হয়ে যাবে। আর তুই তো এমনিতেই মক্ষীরানি। তাই ঝগড়াটা বেশ ভালোই হবে। তুই তো সবাইকে খেলিয়ে বেড়াবি সিনেমার নায়িকাদের মতো।

মৃদু হেসে জাসসি জবাব দিল– বোকার মতো কথা বলিস না গোপাল। কোটি টাকা দিলেও আমি তোর দলে কাজ করব না। ধূর্ত শিয়ালকে বিশ্বাস করা যায় কিন্তু তোকে যায় না। যাক সে কথা। আমি এসেছি তোকে সাবধান করে দিতে।

মৃদ শিস দিতে দিতে গোপাল বলল– বল, কী বলতে এসেছিস।

–ভাবিস না হঠাৎ তোর প্রেমে পড়ে গিয়ে তোকে সব বলতে এসেছি। আমি এসেছি বর্ষাতিয়ার অবিচারের বদলা নিতে। তুই তো জানিস, দিল্লি থেকে অ্যান্টিক জিনিসের ব্যবসায়ী রামলাল আগরওয়াল এসেছে শহরে নিলামে একটা অ্যান্টিক দামি হরিণ বিক্রি করার জন্য, যেটার দাম এর মধ্যেই পঞ্চাশ লাখের ওপর উঠে গেছে। বড়ো অঙ্কের বিমা পলিসিও করিয়েছে জিনিসটার জন্য…।

–জানি, অ্যান্টিক হরিণটা সোনার তৈরি আর ওটার গায়ে নানা রকম দামি দামি রত্ন বসানো। সম্রাট আকবরের আমলের জিনিস ওটা। আগের আমলে মুখশুদ্ধি বা মশলা-দানি হিসেবে ব্যবহার করা হতো ওই হরিণটা। শুধু তাই নয়, ওই হরিণটার পেটের জায়গাটাতে যেখানে মশলা রাখা হতো সেখানে একটা দামি হিরাও রাখা আছে।

ধানাই-পানাই ছেড়ে তুই আমাকে কেন এসব শোনাচ্ছিস সেটা বল।

–বর্ষাতিয়া জেনে গেছে যে তুইও হরিণটার পেছনে লেগে আছিস।

–জেনেছে তো কি হয়েছে? বয়েই গেলো। তুই কি আমাকে সাবধান করতে এসেছিস? এটা হল বিজনেস। আমি শালা বর্ষাতিয়ার বাবার পয়সায় খাই না বুঝলি। গিয়ে বলে দিস তোর বসকে। আসল কথাটা বল।

–শোন তাহলে,  রামলাল আগরওয়াল যে-বাড়ির ফ্ল্যাটে উঠেছে, সেই বাড়ির ঠিক ওপরের ফ্ল্যাটে তুই তোর দলের আববাসকে ভাড়াতে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিস কারণ তুই আগেই ওই রেনডিয়ারটা হাতাতে চাস। বর্ষাতিয়ার ধারণা যে ওই রামলাল আগরওয়ালকে চোখে চোখে রাখার জন্যই তুই এটা করেছিস। তোকে সে সুযোগ দিতে চায় না বর্ষাতিয়া। আগামীকাল রাতেই বর্ষাতিয়া ওটা চুরি করতে চায়। এখন তোর উচিত, তার আগেই কাজটা সেরে ফেলা। বর্ষাতিয়া, আগরওয়ালের ফ্ল্যাটের নকল চাবি বানিয়ে ফেলেছে। ওর আয়রন সেফ খোলার পিন নম্বরও জোগাড় করে ফেলেছে। আমি সেগুলো চুরি করে নিয়ে এসেছি।

আমি জানি আমাকে ধরে ফেললে বর্ষাতিয়া আমাকে মেরে ফেলবে তাই আগামীকাল শহর ছেড়ে দেব ঠিক করেছি। তবে ভাবিস না আমি বিনা স্বার্থে এটা করছি। আমার বদলা নেওয়াও হবে আর আমার অর্ধেক ভাগ চাই আগামীকাল সকালে। তোকে আজ রাতের মধ্যেই কাজটা করতে হবে। হাতে সময় বেশি নেই। রামলাল আগরওয়াল এখন গ্র্যান্ড হোটেলে গেছে। সেখানে মদ খেয়ে নাচানাচি করছে। ফিরতেও অনেক রাত হবে। তাই আজই সবচেয়ে ভালো সুযোগ। দেরি করিস না। কাজটা চুপচাপ করে ফেল। আর আমি জানি একমাত্র তুই-ই পারবি এটা করতে। তুই যদি ওটা বিক্রির টাকা আমাকে না-ও দিস আমার দুঃখ নেই। আমি বর্ষাতিয়ার থেকে প্রতিশোধ নিতে পারলেই খুশি।

–আমাকে একটু ভাবতে দে জাসসি।

গোপাল কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। নীরবে ভোজালিটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। কিন্তু মনটা অন্য কোথাও পড়ে আছে। দেখেই বোঝা যায় কি একটা চিন্তা করছে। এমন সময় বাইরে থেকে হরবোলা মন্টুর আওয়াজ শোনা গেল। মন্টুকে এলাকার সবাই চেনে। মুখ দিয়ে নানা রকম আওয়াজ করে কিছু উপার্জন করে আর বাচ্চাদের আনন্দ দেয়। উঠে গিয়ে জানলার সামনে দাঁড়াল গোপাল। দেখল মন্টু ওর দিকে তাকিয়ে আছে। গোপাল বুঝল, ওকে কোনও জরুরি খবর দিতে এসেছে। মাঝে মাঝেই দেয়। কারণ, মন্টু হরবোলা ওর চর।

জাসসি কে উদ্দেশ্য করে বিরক্তির ভঙ্গিতে বলল– দেখলি তো কি রকম আওয়াজ শুরু করেছে। টাকা না দিলে যাবে না, এরকম ভ্যা ভ্যা করতে থাকবে। যাই, দুটো টাকা দিয়ে আসি।

ঘরের বাইরে সামনের গেট দিয়ে না বেরিয়ে পেছনের গেট দিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল। দেয়ালের ছায়ায় দাঁড়িয়ে রাস্তার অন্য পাড়ে তাকিয়ে দেখল বেশকিছু বাচ্চার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে মন্টু হরবোলা। ইশারায় কাছে ডাকল। পকেট থেকে একটা একশো টাকার নোট বের করে মন্টুর দিকে এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করল– কি গো মন্টুদা, কোনও খবর আছে নাকি?

পাঞ্জাবির ছেঁড়া পকেট থেকে ডান হাতটা বেরিয়ে এল মন্টুর। গোপালের হাত থেকে টাকাটা নেওয়ার সময় একটুকরো কাগজ গুঁজে দিল গোপালের হাতে।

–সাবধানে থাকবেন, গোপালদা, এই কাগজে সব লিখে দিয়েছি, পড়লেই বুঝতে পারবেন। তারপর গোপালের দেওয়া ক্র্যাচে ভর দিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলে গেল।

গোপাল আবার বাড়ির দরজার কাছে ফিরে এল। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কাগজটা ভালো করে পড়ে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে বড়ো হাইড্রেনে ফেলে দিল। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে দেখল জাসসি টিভিটা খুলেছে। গোপাল ঘরে ঢুকতেই জাসসি জিজ্ঞাসা করল– গোপাল, কী ঠিক করলি? হাতে কিন্তু তোর বেশি সময় নেই। আজ রাতের মধ্যেই কাজটা সারতে হবে।

গোপাল মাথাটা ঝাঁকাল। বলল– কাজটা হয়ে যাবে জাসসি। কাল সকালে খবর পেয়ে যাবি।

জাসসি একটু মুচকি হাসল, বলল– আমি জানতাম একমাত্র

তুই-ই পারবি, তাই তো তোর কাছেই এলাম। বলে ব্যাগ থেকে একটা চাবি আর এক টুকরো কাগজ বের করে টেবিলে রাখল। বলল– চাবিটা আগরওয়াল-এর ফ্ল্যাটের আর কাগজে লেখা আছে ঘরের ভেতরে যে সেফটা আছে, তার কোড নম্বর। আমি চলি রে। আমাকে এগিয়ে দেওয়ার দরকার নেই। কেউ দেখে ফেলতে পারে। সাবধানে থাকিস। বলেই বেরিয়ে গেল জাসসি। যাওয়ার সময় দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে গেল।

( দুই )

অনেকক্ষণ চুপচাপ দেয়ালের দিকে তাকিয়ে রইল গোপাল। কী যেন চিন্তা করছে। পরিস্থিতিটা বেশ মজার। মোবাইল থেকে  আববাসকে ফোন করল। অনেক কথা হল, কথার শেষে বলল– আববাস, আমি তোর ফ্ল্যাট-এ আসছি। দুজনের কথা হল ফোনে। তারপর চাবিটা আর কাগজে লেখা পিন কোডটা সঙ্গে নিল। রাস্তায় নেমে হাঁটতে শুরু করল অলোকনন্দা অ্যাপার্টমেন্টের উদ্দেশে। বাড়িটা খুব দূরে নয়। হেঁটে যেতে অল্প কয়েক মিনিট লাগল। বাড়ির গেটে পৌঁছে দেখল গার্ড গুমটির ভেতরে বসে বসে ঘুমোচ্ছে। নিঃশব্দে মূল গেটের কোনায় লাগানো ছোটো দরজার পাল্লাটা খুলে ঢুকে পড়ল গোপাল। খুব দ্রুত গতিতে আববাসের ফ্ল্যাটে গিয়ে পৌঁছোল। আববাস সেখানে অপেক্ষা করছিল গোপালের।

গোপাল– আববাস, আমি আগরওয়ালের ফ্ল্যাট-এ যাচ্ছি। তুই ওপরের জানালা থেকে নজর রাখ। কেউ এলে সিগন্যাল দিবি। সিঁড়ি দিয়ে নীচের ফ্ল্যাট-এ নেমে এসে দরজায় কান পেতে বোঝার চেষ্টা করল যে কেউ আছে কিনা। যখন বুঝল ভেতরে কেউ নেই তখন জাসসির চাবি দিয়ে দরজা খুলে ঘরে ঢুকল।

কুড়ি মিনিট পর ঘর থেকে বেরিয়ে, নিঃশব্দে দরজাটা লাগিয়ে, মৃদু শিস দিয়ে আববাসকে ডাকল। সিঁড়িতেই নেমে এল আববাস। তারপর ঘুমন্ত গার্ডের পাশ কাটিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল দুজনে। হন হন করে হাঁটতে হাঁটতে বলল– আববাস, শরবতের সাথে মনে হয় তোর ঘুমের ওষুধটা একটু বেশিই দিয়ে দিয়েছিস। তোর আর ওখানে থাকা চলবে না। বলেই নিজের ফ্ল্যাটের দিকে রওনা হল।

–ঘটনাটা কী গুরু? তুমি যখন আগরওয়ালের ফ্ল্যাটে ঢুকলে, তখন আমি দু-জন লোককে রাস্তার অন্যদিকে দাঁড়িয়ে এই ফ্ল্যাটের দিকে নজর রাখতে দেখেছি। মনে হল সাদা পোশাকে পুলিশের লোক। তুমি পিছনে লক্ষ্য করো, ওরা আমাদের ফলো করছে। হাসল গোপাল, কোনও উত্তর দিল না।

দশ মিনিট পর আববাসকে নিয়ে নিজের বাড়িতে ঢুকল গোপাল। বেরোনোর সময় ঘরের লাইট, ফ্যান ও টিভিটা অন করে গিয়েছিল। গোপাল বলল– আববাস, আজ বর্ষাতিয়ার প্রেমিকা জাসসি এসেছিল। আমাকে বেশ ভালো একটা গল্প শোনাল। বর্ষাতিয়া নাকি অন্য একটা মেয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে আর তাই জাসসিকে তাড়িয়ে দিয়েছে। জাসসি প্রতিশোধ নিতে চায়, তাই আগরওয়ালের ফ্ল্যাটের নকল চাবি আর আয়রন সেফের কোড নম্বর লেখা কাগজ চুরি করে এনেছে বর্ষাতিয়ার থেকে। সেগুলো আমার হাতে তুলে দিয়ে বলেছে আজই যেন ওই দামি হরিণটা চুরি করে সরিয়ে ফেলি। তাহলে বর্ষাতিয়া আর সেটা পাবে না আর জাসসি-র-ও প্রতিশোধ নেওয়া হবে।

 

জানিস, আমার গল্পটা শুনে খুব কাঁচা মনে হয়েছে। ওটা চুরি করতে হলে আমাকে দিয়ে কেন? জাসসি তো নিজেই চুরি করতে পারত। আপন মনে যখন এসব কথা ভাবছিলাম, তখন হরবোলা মন্টুদা আমাকে সংকেত দিল। আর তখন জাসসি আমার ঘরে বসেছিল। মন্টুদাকে ভিক্ষে দেওয়ার নাম করে নীচে নেমে গেলাম। মন্টুদা কাগজে লেখা একটা মেসেজ দিল। আমাকে সাবধান করে দেওয়ার জন্য। দুদিন আগে মন্টুদা বর্ষাতিয়া, আগরওয়াল আর জাসসি-কে মিটিং করতে দেখেছে। জানলার পাশের টেবিলে বসে কথা বলছিল ওরা। সন্দেহ হওয়ায় মন্টুদা কান পেতে ওদের কথা শুনেছে।

 

আমাকে ফাঁদে ফেলার পরিকল্পনা করছিল ওখানে বসে। জাসসি যখন বলেছিল ও টাকা চায় না, তখনই আমার সন্দেহ হয়েছিল। ও তো টাকার জন্য সব কিছু করতে পারে, তবে টাকার কথা বলাতে আমার সন্দেহটা বেড়ে গিয়েছিল। আর মন্টুদার খবরটা পেয়ে আরও নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম। ওরা জানত, আগরওয়ালের হরিণটার ওপর আমার নজর আছে। ওরা ঠিক করেছিল আমাকে চুরি করার সুযোগ করে দেবে আর পুলিশ ইন্সপেক্টর বদ্যিনাথ দত্ত-কেও জানিয়ে রাখবে। পুলিশ আমার ওপর নজর রাখবে। এভাবে পথের কাঁটা সরাতে চেয়েছে বর্ষাতিয়া। অর্থাৎ কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা আর কি!

–গুরু, আজকাল তুমি তো বেশ পোড় খাওয়া লোকের মতো কথা বলছ। তোমার দিমাকটাও আজকাল বেশ চলছে।

–তুই আর তেল লাগাস না তো! ওরা বুঝতে পারেনি যে আমি ওদের ফন্দিটা বুঝতে পেরেছি। ওরা হয়তো ভাবছে আমি ওদের ফাঁদে পা দিয়েছি। দেখবি একটু বাদেই হয়তো পুলিশ আসবে আমার কাছে। শুনলাম ওই দামি হরিণটা নাকি ইন্স্যুরেন্স করিয়ে রেখেছে মোটা টাকার। যাতে চুরি গেলে আগরওয়ালের কোনও ক্ষতি না হয়, বেশি টাকা পায়। এককথায় বলতে পারিস, ওরা চেয়েছিল যাতে সাপও মরে লাঠিও না ভাঙে। ওরা এখনও হাতকাটা গোপালকে চেনেনি। ওরা চলে ডালে ডালে আর আমি চলি পাতায় পাতায়। তুই খালি মজাটা দেখে যা। আমি যা যা বলব তাই করে যা।

আববাস জিজ্ঞাসা করল– হরিণটা কি তুমি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছ?

–পাগল হয়েছিস? এসব জেনেও সঙ্গে আনব? জায়গা মতো সেট করে এসেছি। তোকে বলব তবে এখন নয় পুলিশের চলে যাওয়ার পর।

আববাস একটু থেমে বলল– আচ্ছা, আমি বুঝতে পারছি না এতে রামলাল আগরওয়ালের কী স্বার্থ আছে?

এমন সময় দরজায় টোকা পড়ল– দরজা খোল। দরজা খোল, নয়তো দরজা ভেঙে ফেলব।

আববাস-এর দিকে তাকিয়ে চোখ মেরে গোপাল এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলে দিল। দেখল দরজার সামনে সাদা পোশাকে আরও তিনজন পুলিশ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইন্সপেক্টর বদ্যিনাথ দত্ত। বদ্যিনাথ দত্তকে চেনে না এই শহরে খুব কম লোকই আছে। বিশেষ করে বদ্যিনাথ দত্ত অপরাধ জগতের সবার কাছে এক বিভীষিকা। দরজাটা খুলে দিতেই ঝড়ের মতো ঘরে ঢুকে বলল– মালটা বের করে দে।

–কোন মালটা স্যার?

–ভেবেছিস আমি কোনও খবর রাখি না? রামলাল আগরওয়ালের চুরি যাওয়া দামি হরিণটা। আমি ওটা চাই। তোকে ওখান থেকে বেরোতে দেখেছি।

–স্যার, আমি তো আববাসের কাছে গিয়েছিলাম। বিশ্বাস করুন আমাকে। আপনি যখন এতই শিওর তাহলে খুঁজে দেখুন।

চারজন মিলে তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখল ঘরগুলো। জিনিসপত্রগুলো তছনছ করল, ওলট-পালট করে ফেলল। কিন্তু কোথাও সেই দামি হরিণটা খুঁজে পেল না। একঘন্ট৆া ধরে কঠোর পরিশ্রমের পর ঘর্মাক্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিল চারজনে। রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে ইন্সপেক্টর বদ্যিনাথ দত্ত হতাশার ভঙ্গিতে সহকারীদের দিকে তাকালেন।

গোপাল হাসিমুখে বলল– স্যার আমি তো আগেই বলেছিলাম যে আমি জিনিসটা নিইনি। প্রথমেই যদি আমার কথা বিশ্বাস করতেন তবে অকারণে আপনাদের এই কষ্টটা করতে হতো না। বরং যদি আমাকে সব ঘটনাটা খুলে বলতেন তাহলে হয়তো অনুমান করতে পারতাম যে ওটা কারা উড়িয়েছে।

ইন্সপেক্টর রেগে গিয়ে বললেন– চুপ কর শালা, আমি কি মজা করছি এতক্ষণ? তোর হিম্মত দেখে অবাক হচ্ছি। আমি চাইলে তোকে ধরে নিয়ে গিয়ে এনকাউন্টার করে দিতাম কিন্তু ওই জিনিসটা না পাওয়া অবধি তোকে মারতে পারব না। দেখ, পালাতে যাস না। পালাতে চেষ্টা করলে কিন্তু কুত্তার মতো মারব।

আমি যে সোর্স থেকে শুনেছি তাতে শিওর ছিলাম যে ওটা এখানেই পেয়ে যাব। আমার ইনফরমেশন ভুল হতে পারে না। দু’ঘণ্টা আগে তুই রামলাল আগরওয়ালের ফ্ল্যাটে গিয়েছিলি আর হরিণটা তুইই চুরি করেছিস।

গোপাল– স্যার, আমার মনে হয় আপনাকে কেউ ভুল বুঝিয়েছে বা ভুল ইনফরমেশন দিয়েছে। মনে হয় রামলাল আগরওয়াল থানায় রিপোর্ট করেছে আর বর্ষাতিয়া বলেছে যে আমিই ওটা লোপাট করেছি। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি আমি পালাব না। তবে আপনাকে কথা দিচ্ছি, আপনি নিশ্চিন্ত হয়ে গিয়ে ঘুমোন। আগামীকাল আমি বারোটা নাগাদ আপনার সাথে দেখা করব। হরিণটা কোথায়, কার কাছে আছে আপনি জেনে যাবেন।

কঠোর দৃষ্টিতে ইন্সপেক্টর গোপালের দিকে তাকালেন। রুক্ষকন্ঠে বললেন– চুপ কর শালা, তুই একটা মহা ধড়িবাজ, শয়তান। তুই ভাবছিস তোকে আমি চিনি না। আমার আগেই ভাবা উচিত ছিল যে তুই তো এত বোকা নয় যে হরিণটা নিজের কাছে রাখবি। আমি শহরের চারিদিকে পাহারা বসিয়ে দিচ্ছি যাতে তুই পালাতে না পারিস। যাই হোক, আমি আজ যাচ্ছি। কাল থানায় ১চ্টায় তোর জন্য অপেক্ষা করব। তুই তো জানিসই ওটা না পেলে বদ্যিনাথ দত্ত কী করতে পারে। তোর ছাল ছাড়িয়ে নেব, হতভাগা। মনে থাকে যেন।

–জানি স্যার, এনকাউন্টার। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন কাল আপনি ওটা পেয়ে যাবেন।

ইন্সপেক্টর বেরিয়ে যাওয়ার পর গোপাল আববাসকে বলল– দেখে নে তো আপদগুলো চলে গেছে কিনা?

–তুমি ঠিকই করেছ গুরু। আজ মালটা হাতছাড়া হয়ে যেত আর তুমিও ফেঁসে যেতে। বেফালতু শালা আমাকেও দুটো ডান্ডা মেরে গেল। তোমার ওটা পেলে যে কি ক্যালাত তা বুঝতে পারছ?

–তাই তো মালটা নিয়ে আসিনি। যা আজ গিয়ে শুয়ে পড়। কাল একটু কাজ আছে।

( তিন )

পরের দিন সকাল দশটায় গোপাল পৌঁছে গেল স্থানীয় ইনসিয়োরেন্স কোম্পানির অফিসে। অফিসে ঢুকেই বলল– ম্যানেজারের সাথে দেখা করতে চাই। পাঁচ মিনিট পর ডেকে পাঠালেন। ম্যানেজার বললেন– বলুন, আপনার কী বলার আছে?

গোপাল– আজ সকালে বিশাল একটা অঙ্কের চুরির ক্লেইম হয়তো আপনি পেয়েছেন। রামলাল আগরওয়ালের কাছ থেকে। কারণ কাল রাতেই আগরওয়াল-এর দামি হরিণটা চুরি হয়ে গেছে আর তাই গতকাল রাতেই আগরওয়াল থানায় ডায়ারি লিখিয়ে এসেছে। গলাটা একটু নীচু করে ফিস ফিস করে গোপাল বলল– জিনিসটা কোথায় আছে আমি জানি।

ম্যানেজার বিস্ময়ের চোখে তাকালেন, বললেন– আপনি জানেন? তাহলে সঙ্গে নিয়ে এলেই পারতেন। বসুন, আমি পুলিশকে খবর দিচ্ছি।

–ওসব এখনই করতে যাবেন না। পুলিশের সাথে আমার কথা হয়ে গেছে। আজই জেনে যাবেন।

–মশাই, যে করে হোক ওটা আমার চাই, নয়তো আমার কোম্পানির অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। আজই আমি একটা প্রেস রিলিজ পাঠিয়েছি তাতে লিখেছি ওই দামি হরিণটার সন্ধান যে দিতে পারবে, তাকে সাত লক্ষ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। বলেই ফাইল থেকে একটা কপি বের করে দেখালেন। বললেন – আপনি ওটা পাইয়ে দিলে আপনিও টাকাটা পেতে পারেন। তবে আগে নয়।

–ঠিক আছে, আপনি আমাকে চেক দিয়ে ব্যাংকে বলে দিন যাতে আপনার অনুমতির আগে যেন ওটা রিলিজ না করে। কারণ আপনি তো জানেনই আমরা কখন, কোথায় থাকি তার ঠিক নেই। তাছাড়া আমরা অ্যাডভান্স না নিয়ে কাজ করি না।

–ঠিক আছে, তাহলে এই নিন চেক। এতটা ভরসা তো আপনাকে করতেই হবে। তবে মনে রাখবেন চালাকি করতে গেলে কিন্তু একটা পয়সাও পাবেন না বরং জেল যেতে হবে।  বলেই একটা সাত লাখ টাকার চেক লিখে খামে ভরে দিয়ে দিলেন।

গোপাল যেতে যেতে দরজা থেকে আবার ফিরে এসে বলল– আর হ্যাঁ, বেশি চালাকি করবেন না, যদি জিনিসটা পাওয়ার পরও চেকটা ক্যাশ না হয় তবে আমরা কিন্তু কোর্টে কেস করি না। আমাদের হিসেবটা একটু অন্যরকম হয়। এই পৃথিবী থেকেই তাকে সরিয়ে দিই। বিশ্বাস না হয়, এই শহরে যে কাউকে হাত-কাটা গোপালের সম্পর্কে জেনে নেবেন। বলেই দ্রুতবেগে বেরিয়ে গেল।

গোপাল বেরিয়ে যেতেই ভদ্রলোক ব্যাংকে ফোন করে বলে দিলেন যে ওনার সাথে কথা না বলে যেন, চেকটার পেমেন্ট না করা হয়।

গোপাল একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে ফিরে এল নিজের বাড়িতে। দেখল বারোটা বাজতে আর বেশি দেরি নেই, তাই যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। ফোন করে পুলিশ ইন্সপেক্টর ও ইনসিয়োরেন্স কোম্পানির ম্যানেজারকে-কেও কিছু বলল। এরপর ফোন করল কয়েকজনকে।

ঠিক পৗনে বারোটার সময় জাসসি যে হোটেলে থাকে, সে লিফট দিয়ে উঠতে দেখা গেল ওই হোটেলের দারোয়ানকে। হাতে

রং-বেরঙের ফুল দিয়ে সাজানো একটা সুন্দর ফুলের তোড়া। জাসসির ফ্লোরে নেমে ঘরের সামনে গিয়েই কলিং বেলটা বাজাল দারোয়ান। জাসসি দরজা খুলে দিলে তোড়াটা তার হাতে দিল। বলল– কয়েক মিনিট আগে এক ভদ্রলোক তোড়াটা আপনাকে দিতে বলেছেন। না, তাঁর নাম, ঠিকানা কিংবা পরিচয় কিছুই জানাননি ভদ্রলোক। দারোয়ানকে দশটাকার একটা নোট বকশিশ দিয়ে দরজাটা ভেজিয়ে দিল জাসসি। আর ঠিক সেই সময় মোবাইলটা বেজে উঠতেই দৗড়ে গেল মোবাইলটা ধরতে। নম্বরটা অজানা। তাড়াহুড়োতে দরজাটা লক করতেই ভুলে গেল। ফোনটা তুলে নিতেই অন্য দিক থেকে কণ্ঠস্বর ভেসে এল– হ্যালো, জাসসি, আশাকরি ফুলের তোড়াটা তোর ভালো লেগেছে। পরের বার আমাকে ঠকাতে আসার আগে ভেবেচিন্তে আসিস। গুড লাক।

–গোপাল তুই কি বলছিস? এটুকু কথা বলার সাথে সাথেই ফোনটা কেটে গেল।

রাগে লাল হয়ে গেল ওর মুখটা। তোড়াটা ছুড়ে মারল মেঝেতে। মেঝেতে পড়েই তোড়াটার বাঁধন গেল খুলে। ফুলগুলো সব চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। আর মেঝেতে একটা ধাতব জিনিস পড়ার আওয়াজ হতেই চমকে উঠল জাসসি। সেটার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল। ছড়ানো ফুলগুলোর মধ্যে চকচক করছে মনিরত্ন খচিত একটা হরিণ। ওটা হাতে তুলে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অবাক হয়ে দেখতে লাগল জিনিসটা।

ওর বিস্ময়ের ঘোর কাটার আগেই ঝটকা দিয়ে খুলে গেল দরজা। সাদা পোশাকপরা পাঁচজন অফিসারকে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন ইন্সপেক্টর বৈদ্যনাথ দত্ত।

ইন্সপেক্টর বললেন– মিস জাসসি, আপনি যে রামলাল আগরওয়ালের দামি হরিণটা চুরি করেছেন তা হাতকাটা গোপাল আমাদের আগেই বলে দিয়েছে। আপনি আর বর্ষাতিয়া মিলে ওকে ফাঁসাতে চেয়েছিলেন।

–মিথ্যে কথা। এটার ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। এইমাত্র গোপালের পাঠানো ফুলের তোড়ার মধ্যে পেলাম। নিশ্চয়ই আমাকে ফাঁসানোর জন্য গোপালই একাজ করেছে।

–চোরাই মাল আপনার কাছে পাওয়া গেছে তাই আপনাকেই আমাদের অ্যারেস্ট করতে হবে। কে কী করেছে, সেটা তদন্ত করলেই বেরিয়ে যাবে। আপাতত আপনাকে আমাদের সাথে থানায় যেতে হবে। একটু থেমে ইন্সপেক্টর বললেন– আর একটা কথা, শুধু গোপাল নয়,  আপনার বস বর্ষাতিয়াও বলেছে, ওই হরিণটা আপনিই চুরি করেছেন।

( চার )

এই সুযোগে গোপাল পৌঁছে গেল ব্যাংকে। প্রায় এক ঘণ্টা বাদে ব্যাংক থেকে বেরিয়ে এল গোপাল। মুখে প্রশান্তির হাসি। হরিণটার সন্ধান দিতে পারার জন্য পুরস্কার হিসেবে চেকটা এনক্যাশ করার অনুমতি দিয়েছে ইনস্যুরেন্স কোম্পানি।

নিজের বাড়ির কাছে আসতেই দেখা হয়ে গেল ইন্সপেক্টর বৈদ্যনাথ দত্তর সাথে। কঠিন হাসি হেসে ইন্সপেক্টর বললেন– টাকাটা যত তাড়াতাড়ি পারিস খরচ করে ফেল গোপাল। তোকে খুব বেশিদিন আর বাইরে থাকতে দেব না। জেলে আমি তোকে ঢোকাবই। যত চালাকিই তুই করিস না কেন! আমি জানি যে ওই হরিণটা তুই-ই চুরি করেছিলিস। এখন শুধু সেটা প্রমাণ করা বাকি।

এটুকু বলেই রাগ দেখিয়ে ইন্সপেক্টর গট গট করে হেঁটে চলে গেলেন।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...