কলকাতা থেকে কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবির কোনও সরাসরি উড়ান নেই।তাই প্রথমে কলকাতা থেকে মুম্বই তারপর মুম্বই থেকে নাইরোবি। মুম্বই থেকে নাইরোবি পৌঁছোতে সময় লাগল প্রায় সাড়ে ছয় ঘন্টা। কেনিয়ার সময় তখন রাত আটটা পঁয়তাল্লিশ। ভারতীয় সময় থেকে আড়াই ঘন্টা পিছিয়ে কেনিয়ার ঘড়ির কাঁটা। নাইরোবি বিমানবন্দর মাঝারি আকারের, খুব একটা ভিড় নজরে এল না। লাগেজ উদ্ধার করে ইমিগ্রেশন ইত্যাদির ঝামেলা মিটিয়ে যখন এয়ারপোর্টের বাইরে এলাম তখন রাত সাড়ে ন’টা বেজে গেছে।
ইতিমধ্যে কেনিয়ার সময় অনুযায়ী ঘড়ির কাঁটা ঘুরিয়ে নিয়েছি। এর আগে এয়ারপোর্টের অনুমোদিত কাউন্টার থেকে ডলারের বিনিময়ে কিছু কেনিয়ান কারেন্সি শিলিং নিয়ে নিয়েছি।
রাত ১১টা নাগাদ আমরা হোটেলে পৌঁছোলাম। তারপর ঘরে মাল তোলা, রাতের ডিনার খাওয়া। ডিনার অবশ্য খুবই মামুলি পি-রাইস, পরোটা, একটা পাঁচ মিশেলি সবজি, চিকেনের ঝোল আর কাটা ফল। হোটেলের ঘর পাঁচ তলায়, বেশ ভালোই ব্যবস্থা। আমার রুম পার্টনার আমাদের টুর ম্যানেজার অল্প বয়সি ছেলে অভ্র। রাতে বেশ ঠান্ডা, কম্বল গায়ে দিয়ে শুতে হল।
পরের দিন সকালে আমাদের যাত্রা শুরু হবে সকাল ৮ টায়। তার আগে স্নান করে ব্রেকফাস্টের টেবিলে। ব্রেকফাস্টের অবশ্য এলাহি ব্যবস্থা– ফ্রুট জুস, কাটা ফল যেমন পাকা পেঁপে, তরমুজ, আনারস, এছাড়া দুধ কর্নফ্লেক্স, টোস্ট, মাখন, জ্যাম, ডিম, চিকেন সসেজ আর চা-কফি তো আছেই। ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা রওনা হব আম্বোসেলি ন্যাশনাল পার্কের উদ্দেশে। সেখান থেকেই আমাদের জঙ্গল ভ্রমণ শুরু হবে। আমাদের ২৫ জনের দল ৪টি টয়োটা গাড়িতে ভাগাভাগি করে চলেছি। এই গাড়িগুলি বেশ আরামদায়ক ও শক্তপোক্ত। সবচেয়ে সুবিধাজনক হল যে, এদের ছাদ উপরদিকে উঠে যায় আর দাঁড়িয়ে চমৎকার জঙ্গল সাফারি করা যায়। এই গাড়িগুলিই আমাদের আগামী সাত দিনের বাহন।
সকালে একটু ঠান্ডা রয়েছে, জুন-জুলাই মাস এখানে শীতকাল, একটা হালকা শীতবস্ত্র পরে নিতে হল। তবে বেলা যত বাড়বে তাপমাত্রাও তত বাড়বে। গাড়ি চলতে শুরু করল হাইওয়ে ধরে। নাইরোবি থেকে ২৪০ কিমি দূরত্বে অবস্থিত আম্বোসেলি ন্যাশনাল পার্ক। মাসাইদের ভাষা অনুযায়ী আম্বোসেলি শব্দের অর্থ নোনতা ধুলো। আম্বোসেলি জাতীয় উদ্যানের খ্যাতি প্রধানত হাতিদের জন্য। বিশাল এই হাতিদের দাঁত সবচেয়ে বড়ো বলে খ্যাতি আছে। এই অরণ্যের পশ্চাৎপটে সব সময়েই উপস্থিত মাউন্ট কিলিমাঞ্জারো। বরফের টুপি পরা এই শৃঙ্গ সমগ্র আফ্রিকার মধ্যে সর্বোচ্চ।
যাত্রা শুরুর ঘন্টাদুয়েক পরে একটু বিরতি– টয়লেট ব্রেক বা স্মোকিং ব্রেক। চায়ের দোকান ধারে কাছে চোখে পড়ে না, তাই
টি-ব্রেক বলা যাবে না। তবে এখানকার সুপার মার্কেট থেকে পানীয় জলের বোতল কিনে নেওয়ার পরামর্শ দিল আমাদের টুর ম্যানেজার। মার্কেটের সামনেই বিরাট এক কিউরিও শপ। কেনিয়ার হস্তশিল্প বিখ্যাত– পর্যটকেরা নানা স্যুভেনির কেনাকাটা করে। হস্তশিল্পের মধ্যে রয়েছে কাঠের নানা মূর্তি, হাতি, গণ্ডার, জিরাফ, জেব্রা প্রভৃতির ছোটো বড়ো মূর্তি, আফ্রিকান মানুষের মুখ, কাঠের মুখোশ, মেয়েদের সাজসজ্জার উপকরণ– বালা, চুড়ি, গলার হার এছাড়া পাথরের নানা খোদাই করা শিল্প।
সফরের শুরুতেই কেনাকাটা কিছু হল না, পরে অনেক সময় ও সুযোগ পাওয়া যাবে। আবার যাত্রা শুরু হল। পথের বৈচিত্র্য বিশেষ কিছু নেই। মাঝে মাঝে ছোটো ছোটো গ্রাম, কিছু ঘরবাড়ি, তারপর মাইলের পর মাইল পতিত জমি ছোটো ছোটো কাঁটা গাছ আর ঘাসের ময়দান। চাষের জমি কমই চোখে পড়ল, আরও ঘন্টা আড়াই চলার পর গাড়ি হাইওয়ে ছেড়ে কাঁচা রাস্তা ধরল। ড্রাইভার জানাল এই রাস্তায় আরও ২২ কিমি যেতে হবে।
হাইওয়ে বেশ মসৃণ ছিল। এবার ভয়ংকর খারাপ রাস্তা। উঁচু নীচু পাথরে ভর্তি রাস্তা, তারই মধ্যে গর্ত হয়ে জল জমে আছে আর কাদা তো আছেই। গাড়ি নাচতে নাচতে চলেছে আর এর সঙ্গে রয়েছে ভীষণ ধুলো। পাশ দিয়ে কোনও গাড়ি চলে গেলে অথবা সামনে কোনও গাড়ি চললে যেন ধুলোর ঝড় চলছে বলে মনে হবে। গাড়ির জানলা বন্ধ তাই একটা দমবন্ধ অবস্থা। এছাড়া বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গরমও অনেক বেড়ে গেছে।
আমাদের আজকের গন্তব্য কিবো সাফারি ক্যাম্প যা আম্বোসেলি জাতীয় উদ্যানের কিমানা গেট থেকে মাত্র ২ কিমি দূরে। জঙ্গল শুরু হয়ে গেছে, বড়ো বড়ো ঘাসের জঙ্গল। মাঝে মাঝে ইতস্তত ছড়িয়ে কাঁটাগাছ। ইতিমধ্যে আমাদের বন্যপ্রাণী দর্শনেরও বউনি হয়ে গেল– এক পাল হরিণ ছুটে চলে গেল, তার একটু পরেই একটি অস্ট্রিচ পাখি চকিতে একবার দেখা দিয়েই ঘাসের জঙ্গলে হারিয়ে গেল। সব কষ্টের শেষ হয়, আমরা অবশেষে ধূলিধুসরিত অবস্থায় কিবো সাফারি ক্যাম্পের গেটে উপস্থিত।
আম্বোসেলি ন্যাশনাল পার্কের পূর্বতন নাম ছিল মাসাই আম্বোসেলি গেম রিজার্ভ। এর অবস্থিতি কাজিয়াডো কাউন্টির মধ্যে। কেনিয়া-তানজানিয়া সীমান্ত ঘেঁষে এই পার্ক ৩৯২ বর্গ কিমি এলাকা জুড়ে। স্থানীয় মানুষ সাধারণত মাসাই, যদিও আফ্রিকার অন্যান্য এলাকার মানুষও এখানে বসতি স্থাপন করেছে পর্যটনকেন্দ্রিক অর্থনীতির সুবাদে। এছাড়া কিলিমাঞ্জারোর বরফগলা জল সৃষ্টি করেছে বেশ কয়েকটি লেক ও জলার। এই জলার আশপাশে চলছে চাষাবাদ। তবে বর্ষা ছাড়া অন্য সময়ে লেকের জল অনেকটাই শুকিয়ে যায়।
আয়তনে ছোটো হলেও আম্বোসেলি কেনিয়ার দ্বিতীয় জনপ্রিয় ন্যাশনাল পার্ক, মাসাইমারার পরেই। ১৯৭৪ সালে এই পার্ক জাতীয় উদ্যানের তকমা পায়। এই জনপ্রিয়তার কারণ অবশ্যই আছে। এখানে বিচরণ করছে অসংখ্য প্রজাতির জীবজন্তু। বিশাল হাতি ছাড়াও আছে বিপুল সংখ্যক জংলি মোষ, ওয়াইল্ড বিস্ট, জিরাফ, জেব্রা, অ্যান্টিলোপ আর অবশ্যই সিংহ, হায়না, লেপার্ড। এর সঙ্গে রয়েছে অসংখ্য প্রজাতির পাখি। শুধু উপস্থিতিই নয় এই জন্তু জানোয়ারের দেখা পাওয়া যায় সহজেই।
কিবো সাফারি ক্যাম্পের বিশাল গেট দিয়ে আমরা ভেতরে প্রবেশ করলাম। প্রথমেই রিসেপশন সেন্টার। সেখানে আমাদের সবাইকে পাসপোর্ট জমা দিতে বলল। অতিথিদের নাম নথিভুক্ত করা হবে পাসপোর্ট দেখার পরেই। ক্যাম্পের এক মহিলা কর্মচারী একে একে সকলের হাতে তুলে দিল ফলের রস ভর্তি গেলাস– ‘ওয়েলকাম
ড্রিংক’। ইতিমধ্যে গাড়ি থেকে সকলের মালপত্র নামিয়ে রাখা হয়েছে। এবার কটেজ বন্টনের পালা। এখানে সব বাসস্থানই টেন্টের মধ্যে।
বিশাল এলাকাজুড়ে এই সাফারি ক্যাম্প, ABCD চিহ্নিত নানা গলিপথ। একটি মেয়ে আমার মালপত্র বহন করে পথ দেখিয়ে চলল। জঙ্গলের প্রাকৃতিক পরিবেশ অটুট রেখে তার মাঝে কিছু অঞ্চল পরিষ্কার করে রাস্তা ও টেন্টগুলো স্থাপিত হয়েছে। পৌঁছে গেলাম আমার নির্ধারিত টেন্টের সামনে। বাঁশের খুঁটি দিয়ে বারান্দা, সামনে উঠোন, বিরাট ডবল বেড ঘর। টেন্টের মাথায় খড়ের ছাউনি তবে তার নীচে ওয়াটারপ্রুফ টালি রয়েছে। বারান্দায় চেয়ার টেবিল পাতা। ঘরের মধ্যে দুটো খাট বিছানা ছাড়া চেয়ার, রাইটিং টেবিল, টেবিল ল্যাম্প ইত্যাদি। স্নানঘর, টয়লেট, সাজঘর সবেরই ব্যবস্থা আছে। মোটের ওপর স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্যবস্থা। সোলার বিদ্যুতে আলো জ্বলে এমনকী মোবাইল আর ক্যামেরা ব্যাটারি চার্জের সকেটও রয়েছে বেশ কয়েকটা ঘরে। দরজা জানলা সব টেন্টের মতো চেন টেনে বন্ধ-খোলা করা যায়।
ঘর গুছিয়ে এবার কিবো ক্যাম্পটা একটু ঘুরে ফিরে দেখতে বেরোই। বেলা এখন দেড়টা, মধ্যাহ্নভোজ সেরে বেলা তিনটে নাগাদ আমরা ন্যাশনাল পার্কে গেম ড্রাইভে যাব। রিসেপশন ছাউনির বাইরে বাঁ-পাশেই বিশাল ডাইনিং হল। তার বিপরীতে রাস্তার অপর পারে বার ও রেস্তোরাঁ। বিভিন্ন লেনে টেন্ট তথা কটেজগুলি। কটেজের ফাঁকে ফাঁকে ঝোপজঙ্গল। রিসেপশন ছাউনির মধ্যেই অবশ্য কিউরিও শপ আছে আগে লক্ষ্য করিনি।
দুপুরে খাওয়ার মেনু বহু বিচিত্র। প্রথমে দু ধরনের স্যুপ, পি-রাইস, পরোটা, বেকড্ বিনস, আলু সিদ্ধ, চিকেন ও বিফের আলাদা আলাদা পদ। এছাড়া রয়েছে পাকা পেঁপে, আনারস, মুসম্বি ধরনের লেবু, তরমুজ ইত্যাদি ফলের টুকরো ও দু-তিন রকমের কেক। সবই ব্যুফে ব্যবস্থায়। লাঞ্চ সেরে আর বিশ্রামের সময় পাওয়া গেল না, আমরা প্রস্তুত হলাম আম্বোসেলির জঙ্গলে প্রথম গেম ড্রাইভের জন্য।
আমাদের গাড়ির ড্রাইভার কাম গাইড হল ক্রিস্টোফার সংক্ষেপে ক্রিস। বিরাট লম্বা চওড়া চেহারা জাতিতে মাসাই, মাথা কামানো মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। সুন্দর ইংরেজি বলতে পারে– বেশ একটা ব্যক্তিত্ব আছে। আমাদের দলের চারটি গাড়ি ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে মিনিট দশেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম আম্বোসেলি ন্যাশনাল পার্কের প্রবশদ্বারের সামনে।
আফ্রিকা তথা কেনিয়ার ন্যাশনাল পার্ক সম্পর্কে দু-এক কথা বলে নেওয়া প্রয়োজন। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্যই জাতীয় উদ্যানের সৃষ্টি অর্থাৎ এই সব অরণ্যে মানুষের বসবাস, গবাদি পশু চরানো, অথবা শিকার করা নিষিদ্ধ। কেনিয়ার প্রথম জাতীয় উদ্যান প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪৬ সালে– নাইরোবি ন্যাশনাল পার্ক। এর পরে আরও ২চ্টি ন্যাশনাল পার্ক কেনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার সময় মানুষের বসতি সরানো ও পোচিং নিয়ে অনেক অশান্তি হয়েছে। বর্তমানে তা অনেকটাই শান্ত।
পার্কের গেটে কয়েকটি কিউরিওর দোকান, এছাড়া স্থানীয় মহিলারা হস্তশিল্পের পশরা সঙ্গে বয়ে এনে গাড়ির কাছে চলে এসেছে বিক্রির আশায়। এদের কাছে বেশ দরদাম চলে। ফলে দোকানের চেয়ে অনেক সস্তায় হ্যান্ডিক্র্যাফট্ কেনা যায়। অনেকেই কেনাকাটা করছে। যাইহোক একটু পরেই আমরা জঙ্গলে প্রবেশ করলাম। ক্রিস জানাল এই জঙ্গলে পায়ে হাঁটা নিষিদ্ধ তাই কোনও অবস্থাতেই যেন কেউ গাড়ি থেকে না নামে। গাড়ির হুড এখন তুলে দেওয়া হয়েছে। এখন বসে বা দাঁড়িয়ে অরণ্যদর্শন ও ছবি তোলা যাবে।
অরণ্যের পথে গাড়ি চলল, পথের দুপাশে তৃণভূমি ছোটো বড়ো ঘাসের জঙ্গল কখনও দূর্বা ঘাস, কখনও বা বড়ো বড়ো সাবাই ঘাস আবার কখনও ছোটো ছোটো ঝোপ। এর মাঝখানে মাঝে মাঝে অ্যাকাশিয়া গাছ মাথা উঁচু করে রয়েছে। একে বলে সাভানা অঞ্চল– মাইলের পর মাইল এই ধরনের প্রকৃতি। আকাশ মোটামুটি পরিষ্কার, হালকা রোদ তবে গরম খুব একটা কষ্ট দিচ্ছে না। গাড়ি এগিয়ে চলেছে এই অরণ্যভূমির মধ্যে দিয়ে। আমাদের বন্যপ্রাণী দেখার এখনও বউনি হয়নি।
গাড়ি খুব ধীরে ধীরে চালাতে চালাতে ক্রিস বলছে এই অরণ্যে প্রায় সমস্ত জীবজন্তু দেখা যায়। এই অরণ্যে ‘বিগ ফাইভ’ বলা হয় সিংহ, হাতি, লেপার্ড, বুনো মোষ আর গন্ডারকে। এরা সবাই এই অরণ্যে বিচরণ করে। এছাড়া চিতা, নানা ধরনের হরিণ, জিরাফ, জেব্রা, ওয়াইল্ড বিস্ট, বাঁদর, বেবুন, ওয়াটার বাক, হিপোপটেমাস, হায়না, শেয়াল প্রভৃতি তো আছেই আর আছে অসংখ্য প্রজাতির পাখি।
আমাদের প্রথম দর্শন হল একপাল হরিণের সঙ্গে। ক্রিস বলল, এগুলির নাম থমসন গ্যাজেল। এদের পা-গুলি সরু লম্বা, খুব জোরে ছুটতে পারে, কেনিয়ায় এদের সংখ্যা প্রায় চার লক্ষ। হরিণের ছবি তুলে আমরা এগিয়ে চলি। আবার একপাল ওয়াইল্ড বিস্ট। এরা অনেকটা গরুর মতো দেখতে, গায়ে বিশেষত গলা ও পিঠের দিকে লম্বা লম্বা দাগ, মাথায় শিং। আফ্রিকার জঙ্গলে এরাই বোধহয় সংখ্যাগরিষ্ঠ, সব সময় দল বেঁধে চলাফেরা করে। খাবারের সন্ধানে এরা তানজানিয়া থেকে কেনিয়ার জঙ্গলে হাজারে হাজারে আসে গ্রেট মাইগ্রেশনের সময়।
হঠাৎ একদল জেব্রা কোথা থেকে এসে পড়ল পথের একেবারে মাঝখানে। সবাই হই হই করে উঠল জেব্রা জেব্রা। ক্যামেরা তুলতে তুলতেই তারা উধাও। তবে জেব্রার কোনও অভাব নেই। একটু এগিয়ে আর-একদল জেব্রার রাস্তার পাশেই জটলা। এবার আর ছবি তুলতে অসুবিধা হল না। জেব্রার গায়ের চামড়া চকচকে। গায়ের ডোরাকাটা দাগের জন্যই এরা সূর্যের তাপ সহ্য করতে পারে। এছাড়া এই সাদা কালো দাগ জেব্রাকে লুকিয়ে থাকতে সাহায্য করে। প্রতিটি জেব্রার ডোরা কাটা দাগ অন্যটির থেকে আলাদা, মানুষের আঙুলের ছাপের মতো। এখন এই জেব্রা আর ওয়াইল্ড বিস্টের দলই আমাদের চোখের সামনে।
আফ্রিকার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট কিলিমাঞ্জারো এখন অস্পষ্ট ভাবে ফুটে উঠছে। ভোরে আর বিকেলে কিলিমাঞ্জারো নাকি স্পষ্ট ভাবে আবির্ভূত হয়, অন্য সময়ে থাকে ছায়াচ্ছন্ন। এক এক দল জন্তু দেখা যাচ্ছে আর গাড়ির মধ্যে উল্লাসের ঝড় উঠছে। একটু পরেই চিৎকার ওমা এটা জিরাফ মনে হচ্ছে। আমি কিন্তু মোটেই দেখতে পেলাম না তাই বললাম, কোথায় কোথায়? উত্তর এল ওই যে শুধু মাথাটা দেখা যাচ্ছে। সত্যিই তো একটা কাঁটাগাছের পিছনে জিরাফের সারা শরীর ঢাকা হলেও গাছের ওপর দিয়ে মাথাটা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এভাবে তো ছবি তোলা যাবে না, একটু এগিয়েই অবশ্য চার-পাঁচটা জিরাফের দেখা পাওয়া গেল। একজন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে বাকিরা গাছের মগডাল থেকে পাতা খাচ্ছে। প্রায় ৫ মিটার উঁচু হয় পূর্ণ বয়স্ক জিরাফ। এদের পায়ের এত জোর যে, এক লাথিতে সিংহকেও কাবু করে দিতে পারে।
ঘাসবনের মধ্যে গোটাদুয়েক অস্ট্রিচ ছুটে চলে গেল। গাড়িতে খুব একটা আলোড়ন সৃষ্টি হল না। তবে আমি চটপট ওদের ক্যামেরাবন্দি করলাম। এবার দেখা দিল এক পাল হাতি। কি বিশাল তাদের চেহারা আর প্রত্যেকেরই রয়েছে গজদন্ত। আফ্রিকার হাতি আর ভারতের বা এশিয়ার হাতির মধ্যে প্রধান তফাত হল, এদের গায়ের রং আর কানের মাপ। স্থলচরদের মধ্যে আফ্রিকার হাতি পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো। হাতির দল কিন্তু কাছে এল না, ধীরে ধীরে আরও দূরে চলে গেল। হাতিদেরও ফটাফট কিছু ছবি উঠে গেল। যতই বেলা গড়াচ্ছে ততই হাতির সংখ্যা যেন বেড়ে যাচ্ছে। যেদিকেই তাকাই সেদিকেই হাতির পাল, সারি সারি ওয়াইল্ড বিস্ট, জেব্রার পাল আর নানা ধরনের হরিণ তো সবসময়েই ছুটোছুটি করছে।
আমাদের বিস্ময়ের প্রথম আবেগ কেটে গেছে। উল্লাসের তরঙ্গ একটু স্তিমিত। এখন সকলের দৃষ্টি নতুন কিছু জন্তুজানোয়ার খুঁজে বেড়াচ্ছে জঙ্গলের মধ্যে। বুক সমান সাভানা তৃণভূমির প্রতিটি পদক্ষেপে রয়েছে বিপদ। এই ঘাসের জঙ্গলেই দেহের রং মিলিয়ে কোথাও আত্মগোপন করে রয়েছে আফ্রিকার মহারাজ সিংহ। ওত পেতে বসে আছে শিকারের অপেক্ষায়। কিন্তু আমরা এখনও তার দেখা পেলাম না। আবার হাতি এবার সঙ্গে মিষ্টি দুটো বাচ্চা, মা-র পায়ের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে বার বার।
একটু দূরেই একটা ছোটো ডোবার মধ্যে গায়ের অর্ধেক ডুবিয়ে বসে আছে দুটি বিশাল কেপ বাফেলো অর্থাৎ বন্য মহিষ। এরা এই জঙ্গলের অন্যতম শক্তিশালী প্রাণী। মাথায় বাঁকা সিং, সিংহরাও সমঝে চলে কেপ বাফেলোকে। গোল গোল চোখ করে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। কিন্তু কোনও আক্রমণাত্মক উদ্যোগ দেখাল না। ক্রিস জানাল এরা কোনও বিশেষ কারণ না থাকলে শান্তই থাকে। একটু পরেই ক্রিস পরিচয় করিয়ে দিল সেক্রেটারি বার্ডের সঙ্গে। বিশাল এই পাখি কিন্তু উড়তে পারে না, গটগট করে হেঁটে গেল যেন গুরুত্বপূর্ণ মিটিং-এ যাচ্ছে। পাখির গায়ের রং সাদা, চোখের চারপাশটা লাল, মাথায় সামান্য ঝুঁটি ও পিছনে পুচ্ছ। এরই নাম সেক্রেটারি বার্ড।
দেখা হল গোটাদুয়েক দাঁতাল শুয়োরের সঙ্গে যার পোশাকি নাম ওয়ার্ট হগ। বিশাল এক জোড়া দাঁত আছে আত্মরক্ষার জন্য।
ছোটো-খাটো বাঁদর আগেও দেখেছি এবার গাছের ডালে বেশ বড়ো কয়েকটা বেবুন। একজন তো গাছ থেকে লাফিয়ে নেমে আমাদের গাড়ির অনেকটা কাছে চলে এল। হঠাৎই দেখা হয়ে গেল আমরা এতক্ষণ যাকে খুঁজছি সেই সিংহের সঙ্গে। তবে খালি চোখে খুব পরিষ্কার নয়, ক্যামেরার জুম লেন্সে অনেকটা কাছে চলে এসে পরিষ্কার দেখা গেল। দুটি সিংহী আর একটা বাচ্চা একটা গাছের নীচে শুয়ে রয়েছে। কাছাকাছি রয়েছে বেশ কয়েকটা জেব্রা ও ওয়াইল্ড বিস্ট। তাদের মধ্যে কোনও চঞ্চলতা চোখে পড়ল না। বোঝা গেল সিংহীদের এখন আর কোনও খিদে নেই। এখনই হয়তো ভোজন সমা৫ করেছে। সিংহীদের নড়নচড়নেরও কোনও লক্ষণ নেই। দিনের মধ্যে ১৬ থেকে ২০ ঘন্টা সিংহরা ঘুমোয়। অধিকাংশ শিকার করে সিংহীরা কিন্তু শিকারের সিংহভাগ সিংহের পেটে যায়। তবে দলের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব এই সিংহের।
সূর্য পশ্চিম দিকে হেলে পড়ছে। মাউন্ট কিলিমাঞ্জারো এখন কিছুটা পরিষ্কার। মাথায় বরফের মুকুট দেখা যাচ্ছে তবে এখনও ছবি তোলার পক্ষে আদর্শ নয়। আরও এক ধরনের হরিণ দেখা গেল। এদের নাম ওয়াটার বাক হলেও এরা জলচর নয়, জলে বা জলাভূমিতে থাকতেও পছন্দ করে না। এদের চেহারা বেশ বড়োসড়ো আর শক্তিশালী। শুধুমাত্র পুরুষ ওয়াটার বাকের প্যাঁচানো শিং থাকে।
এবার আমরা পৌঁছে গেছি আম্বোসেলির অরণ্যের এক কিনারে। সেখানে আছে আম্বোসেলি লেক। অনেকটা জায়গা জুড়ে লেক হলেও তার অধিকাংশই শুকনো। একমাত্র বর্ষায় লেকটি জলে পুরো ভরে যায়। অরণ্যের এই দিকে অল্প সংখ্যক ট্যুরিস্টই আসে। গাড়ির অল্প সংখ্যাই তার প্রমাণ। লেকে অনেক পাখির মেলা বসেছে তার মধ্যে
ফ্লেমিংগোরই আধিক্য। সাদা ও লাল রঙের এই পাখিগুলি নাচতে নাচতে ছুটে বেড়াচ্ছে। লম্বা গলা, লাল ঠোঁট, লাল বড়ো বড়ো চোখ সব মিলিয়ে রাজকীয় সৗন্দর্যের অধিকারী এরা। সাধারণত এরা একাকী থাকে না, কলোনি করে থাকে। দুরকমের ফ্লেমিংগো আছে এখানে, লেসার ফ্লেমিংগোরই সংখ্যাধিক্য। দৃষ্টিনন্দন এই পাখি যখন একসঙ্গে হাঁটাচলা করে বা ওড়ে তখন সত্যিই এক অপূর্ব দৃশ্যের সৃষ্টি করে। এছাড়া রয়েছে মারাবু স্টক– এরা দেখতে সুন্দর নয়, মাথায় আর গলায় পালক থাকে না। এরা জীবিত বা মৃত সব পশুপাখিই খায়। এ ছাড়া রয়েছে ক্যাটেল ইগ্রেট। এরা জলাজমিতে কলোনি করে বসবাস করে। আর ছোটো বড়ো পেলিক্যান। ক্রিস, লেকের ধারে বেশিক্ষণ সময় দিল না, এবার আমাদের ফিরতে হবে। সন্ধ্যার পর ন্যাশনাল পার্কে থাকা নিষিদ্ধ, আমরা অনেকটা দূরে চলে এসেছি।
সূর্য অস্ত যাচ্ছে। মায়াবী আলোয় ভাসছে আম্বোসেলি। ফেরার পথে আরো অনেক জীবজন্তু পাখি ইত্যাদি দেখা হল। জলার এক প্রান্তে দেখা মিলল ক্রাউন্ড ক্রেন। নানা রঙে রঙিন সারস পরিবারের এই পাখির মাথায় সোনালি পালকের মুকট। তার নীচে কালো কপাল, সাদা গাল, গলায় লাল ঝালর। পিঠ কালো আর পেটটা সাদা সোনালি মেশানো। সরু লম্বা লম্বা পা নিয়ে দুটি ক্রেন যেন সিনেমার পোজ দিচ্ছে। তারই কাছাকাছি দুটি রঙচঙে হাঁস। ক্রিসকে প্রশ্ন করায় ও জবাব দিল না, বোধহয় এখন ফেরার তাড়া। কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি ফেরা হল না কারণ একটু এগিয়ে জলার মধ্যে অনেকগুলো হিপোপটেমাস। জলের মধ্যে সবুজ শ্যাওলার মধ্যে দুতিনটে দলে ভাগ হয়ে জলের সমান্তরাল ভেসে বেড়াচ্ছে। বিশাল এই প্রাণীগুলি আপাত শান্ত মনে হলেও মাঝে মাঝে হিংস্র হয়ে ওঠে। হিপোর পিঠে রয়েছে বেশ কয়েকটা ছোটো ছোটো বক জাতীয় পাখি, তারা পোকা খুঁটে খাচ্ছে। হিপোগুলি মাঝে মাঝে হাঁ করছে। তাদের বিশাল মুখগহ্বর দেখা যাচ্ছে।
অবেলায় দেখা হয়ে গেল টোপির সঙ্গে। এরা এক ধরনের অ্যান্টিলোপ, বেশ বড়ো এদের আকার। বেলা পড়ে আসছে। হাতিরা দলে দলে পথ পার হয়ে ফিরে চলেছে তাদের আস্তানার দিকে। একেকটা দলে আট দশটা করে হাতি, কোনও দলে তিনটে-চারটে করেও আছে। বড়োদের পিছনে চলছে বাচ্চা হাতিরা। ক্রিস এবার গাড়ির গতি বাড়াল। একটু পরেই আমরা পৌঁছে গেলাম পার্কের গেটে তখন সন্ধে নেমে এসেছে।
এলাহি রাতের ডিনার সেরে কটেজের বারান্দায় সোফায় বসে ধূমপান করছি আর সারা দিনের ছবিগুলো মনের মধ্যে সাজিয়ে রাখছি। আকাশে জ্বলজ্বল করছে তারা। এত পরিষ্কার আকাশ তো সচরাচর আমরা দেখতে পাই না। চারদিকে নিকশ অন্ধকার শুধু ক্যাম্পের রাস্তার আলোগুলি টিমটিম করে জ্বলছে।
পরের দিন ভোর ছ’টায় এক কাপ চা খেয়ে আমরা আবার আম্বোসেলি ন্যাশনাল পার্কে গেম ড্রাইভে বেরিয়েছি। কনকনে ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে, জুলাই-আগস্ট মাস এখানে শীতকাল। সূর্য উঠছে, মাউন্ট কিলিমাঞ্জারো উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে। টিলার নীচ থেকে সূর্য বেরিয়ে আসছে। অরণ্যের পশুপাখি সব বেরিয়ে পড়ছে। একটা ন্যাড়া গাছের ডালে অনেকগুলি শকুনের স্যিলুয়েট। রংচঙে স্টারলিং পাখি নেচে বেড়াচ্ছে। জিরাফ, ওয়াইল্ড বিস্ট, হরিণের পাল ঘাস পাতা খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। হায়নার দলও ইতস্তত খাবারের সন্ধানে ঘুরছে।
ক্রিস রেডিও টেলিফোনে কোনও বার্তা পেল, তারপরই ঊধর্বশ্বাসে ছুটল এক বিশেষ দিকে। দূর থেকেই দেখি রাস্তার ধারে গাড়ির জমায়েত। একটু দূরে ঘাসের মাঠে অনেক জন্তুর জমায়েত সেখানে যেন একটা ঝটাপটি হচ্ছে, প্রচুর ধুলো উড়ছে আকাশে। আরও কাছে এগোয় গাড়ি। দেখি এক অবিশ্বাস্য দৃশ্য, শ’খানেক কি তারও বেশি ওয়াইল্ড বিস্ট ঘিরে রয়েছে একটা সিংহকে। একাকী সিংহটি কাউকে আক্রমণ করতে ভরসা পাচ্ছে না। এই চক্রব্যুহ থেকে বেরিয়ে যাবার পথ খুঁজছে। আশ্চর্য! পশুরাজের এই অবস্থা। সামান্য ওয়াইল্ড বিস্ট বিরাট সংখ্যায় জোট বেঁধে প্রতিহত করেছে সিংহকে। সিংহটি চক্রব্যুহ থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমাদের গাড়ির একেবারে সামনে দিয়ে রাস্তা পেরিয়ে চলে যাচ্ছে ওপারের ঘাসবনের দিকে। চারদিক নিস্তব্ধ শুধুমাত্র ক্যামেরার শাটারের কটকট ধবনি। সবাই যেন নিশ্বাস বন্ধ করে ছিল এখন সকলে একসঙ্গে কথা বলতে শুরু করল। না আর কিছু দেখার নেই। ক্রিস গাড়ির মুখ ঘুরিয়ে ফেরার পথ ধরল। ব্রেকফাস্ট সেরেই আমাদের নতুন গন্তব্যের দিকে পাড়ি দিতে হবে।
প্রয়োজনীয় তথ্য
- নাইরোবি পৌঁছোনোর সহজ উপায় কলকাতা থেকে মুম্বই আর মুম্বই থেকে সরাসরি কেনিয়া এয়ার ওয়েজের বিমানে নাইরোবি। মুম্বই থেকে ইথিওপিয়ান এয়ারওয়েজের বিমানও নাইরোবি যায়, তবে সরাসরি নয় ইথিওপিয়ার রাজধানী আদিস আবাবা হয়ে।
- কেনিয়া সফরের আগে হলুদ জ্বরের প্রতিষেধক ও পোলিওর প্রতিষেধক নেওয়া বাধ্যতামূলক।
- কেনিয়া ভ্রমণ, প্যাকেজ টুরেই করা সুবিধাজনক, সব ব্যবস্থাই ভ্রমণ সংস্থা করে দেয়।
- নিজের ব্যবস্থায় গেলে কেনিয়ার প্রচুর ট্রাভেল এজেন্সি জঙ্গল সাফারির ব্যবস্থা করে। টুর নির্বাচন করে নিজেকে নির্বাচন করতে হবে।
- সেরা সময় জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর।
- কেনিয়ার ভিসা (ই-ভিসা) অনলাইনে পাওয়া যায়।
- কেনিয়ার মুদ্রা কেনিয়ান শিলিং ১ ডলার ১০৩ কেনিয়ান শিলিং।
- কেনিয়ার সময় ভারতের সময় থেকে আড়াই ঘন্টা পিছিয়ে।
- শুধু কেনিয়া ভ্রমণে খরচ পড়বে আনুমানিক ১ লক্ষ ৪০ হাজার থেকে ১ লক্ষ ৮০ হাজার টাকার মতো ৭ থেকে ৯ দিনের জন্য।