ঘরে ঢুকতেই দেব আশ্চর্য হয়ে গেল। নয়না আর রাজেন কিছু একটা আলোচনায় এতটাই মশগুল যে দেবের উপস্থিতি টেরই পেল না। দেব-ও এই দৃশ্য চোখের সামনে দেখবে একেবারেই ভাবেনি। দুজনের মুখোমুখি বসে কথা বলা সত্যি করেই এক অভাবনীয় দৃশ্য।
‘বাবাঃ কী এত আলোচনা চলছে? সারা বাড়িতে একটা পিন পড়লেও শোনা যাবে মনে হচ্ছে। এত কী গোপন কথোপকথন?’ দেব খানিক অপেক্ষা করে জিজ্ঞেস করল। দুইজনেই চমকে মাথা তুলল। দুজনকেই খুব চিন্তিত মনে হচ্ছিল।
‘সব ঠিকঠাক তো?’ দেব আবার প্রশ্ন করল।
‘হ্যাঁ রে ভাই, বাড়িতে তো সবকিছু
ঠিক-ঠাকই আছে…’
‘তাহলে তোদের এত চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন?’ রাজেনকে থামিয়ে দেব জিজ্ঞেস করল।
‘সেটা ঝুমার জন্য ভাই।’ নয়না উত্তর দেয়, ‘তাও বলতে পারিস প্রায় বিনা কারণে… বুঝতেই পারছি না কী করে ওকে সাহায্য করব।’
ঝুমা নয়নার সব থেকে কাছের বান্ধবী এবং রাজেনেরও যে ঝুমার প্রতি একটা বিশেষ দুর্বলতা রয়েছে এটাও দেবের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে অনেকবারই ধরা পড়ে গেছে।
‘খুলেই বল পুরোটা, আরাম করে সোফায় গা এলিয়ে বসল দেব, ‘এমনও হতে পারে যে আমি তোদের কিছুটা সাহায্য করতে পারব।’
রাজেনই মুখ খোলে, ‘আরে আগে তো সবই ঠিকঠাক ছিল, অলোকের দাদু খুন হওয়ার পর থেকেই যে দিদির কি হল, বিয়ে করতে কিছুতেই রাজি হচ্ছে না… দিদি… মানে ঝুমার দিদি সীমাদি।’
রাজেনের কথা শেষ হওয়ার আগেই নয়না বিরক্তি ভরা কণ্ঠে বলে ওঠে, ‘খুনের সঙ্গে ঝুমা বেচারির কি লেনদেন? যাক গে, ঝুমার জন্য ভাই কিছু তো করতেই পারে, তারপর দেবের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘তুই তো জানিস, ঝুমাও রাজেনের সঙ্গেই এমবিএ-র জন্য প্রবেশিকা পরীক্ষা দিয়েছে আর ও শিওর যে ভালো কোথাও ও চান্স পেয়েই যাবে। কিন্তু ওর বাড়ির লোকেরা চাইছে পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোবার আগেই ওর বিয়ে দিয়ে দিতে। শ্বশুরবাড়ি যদি রাজি হয় তাহলে ওখান থেকেই ও পড়াশোনা চালাতে পারে। টাকাটা কোনও ব্যাপার নয়… ঝুমার বাবা-ই মেয়ের পড়ার সব খরচ দেবেন বলেছেন।’
‘বিয়ে কার সঙ্গে ঠিক হয়েছে?’ দেব জানতে চায়।
‘ঝুমা কাউকে বিয়ে করতে চায় কিনা ওরা জানতে চেয়েছে। এমনকী ছেলেটি যদি ছাত্র হয় তাহলেও ওদের আপত্তি নেই। পাত্রেরও পড়াশোনার সব খরচ দিতে রাজি ঝুমার বাবা। আর যদি ঝুমার নিজের পছন্দ কিছু না থাকে তাহলে ওরাই উপযুক্ত পাত্রের সন্ধান করবে ঝুমার জন্য।’
‘তার মানে কোনও ভাবে ঝুমার তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিতে চান ওনারা, কিন্তু কেন?’ দেব আশ্চর্য হয়।
দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ে নয়না, ‘কারণ হল ঝুমার দিদি সীমাদি এবং ওর অদ্ভুত আচরণ। ঝুমাদের বাড়ির কাছেই অলোকের বাড়ি। ছোটো থেকেই সীমাদি আর অলোকের বন্ধুত্ব এবং পরে সেটা ভালোবাসায় পরিণত হয়। কারও বাড়িতেই বিয়ে নিয়ে আপত্তি ওঠেনি সুতরাং বিয়ের দিনও স্থির হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ-ই সীমাদি জানিয়ে দেয় ও অলোককে বিয়ে করবে না এমনকী অন্য কোনও ছেলেকেও বিয়ে করতে রাজি নয়। কারণ জিজ্ঞেস করলে জানায় ওর নাকি একটু সময় দরকার। মনস্থির করতে বাড়ির লোকেরা ওকে দুবছর সময় দিয়েছে, কিন্তু এখন সীমাদি আরও সময় চাইছে। বাড়ির লোকেরা পড়েছে মুশকিলে। ওদের ধারণা সীমাকে চাকরি করতে দিয়ে ওরা ভুল করেছে। এই একই ভুল ওরা ঝুমার বেলায় করতে চায় না।’
‘সীমার বিয়ে না করার কারণটা কী?’ জানতে চায় দেব।
‘এটাই তো কিছুতেই বলছে না ও। কারণ জানতে পারলে তো ঝুমাও সবাইকে নিজের দিকটা বোঝাতে পারত। পড়াশোনা শেষ করে ও বিয়ে করতে প্রস্তুত কিন্তু এখন এমবিএ-র জন্য পড়াশোনা আর বিয়ে দুটো একসঙ্গে করাটা একেবারেই অসম্ভব ওর পক্ষে।’
‘হ্যাঁ, এটা তো হল… কিন্তু খুনের ব্যাপারটা কী বলছিলি রাজেন?’
দেব, পুলিশকে নানা তথ্য দিয়ে সাহায্য করে এমনকী অনেক বড়ো মার্ডারের ঘটনায় পুলিশকে আসামী ধরিয়ে দিতেও যে দেবের অনেক অবদান আছে, ভাইয়ের এই গোপন পরিচয়টা রাজেনের অজানা ছিল না। তাই চিত্রটা পরিষ্কার করে তুলে ধরার জন্য দেবকে বলল রাজেন, ‘সীমা আর অলোকের বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ার প্রায় আড়াই মাস পরে হঠাৎ-ই অলোকের দাদু খুন হন। খুনের কারণ এবং খুনির পরিচয় আজ পর্যন্ত অজানা।’
‘কিন্তু খুনের সঙ্গে সীমার বিয়েতে রাজি না হওয়ার কী সম্পর্ক, বিরক্ত হয়ে নয়না জানতে চায়।
‘হতেও পারে, সীমা আর অলোক নামটা খুব পরিচিত লাগছে, খানিকটা ভেবে দেব আবার বলে, ‘আচ্ছা এরা কি শকুন্তলা পার্কের কাছে একই পাড়ায় থাকে?’
‘হ্যাঁ, তো, নয়না বলে, ‘তুই জানলি কী করে?’
‘তুই আর রাজেন আমার থেকে এতটা ছোটো তবুও আমাকে তুই তোকারি করিস, গুরুত্ব দিতে চাস না আমাকে। সবাই কি আর তোদের মতো? সীমা আর অলোক কলেজে আমার দু’বছরের জুনিয়র ছিল। কলেজে থাকতে আমার নির্দেশনায় ওরা নাটকে অভিনয় করেছে। অখিল ভারতীয় নাটক প্রতিযোগিতা-তে আমার একটা নাটক একবার চান্স পেয়েছিল। সেটা মঞ্চস্থ করতে আমাকে অন্য শহরে যেতে হয়েছিল। সেই গ্রুপে ওরাও ছিল এবং তখন ওদের সঙ্গে আমার ভালো বন্ধুত্ব হয়ে যায়। মনে আছে অলোককে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম সীমাকে ও বিয়ে করবে কিনা এবং তাতে ও সিরিয়াসলি জানিয়েছিল যে ও সীমাকে বিয়ে করবে।’
‘হ্যাঁ, অলোক নয়, সীমাদি বিয়ে করবে না বলেছে। মধ্যে অলোক-ও কাজ নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল, তাই বিয়ের কথা চাপা পড়ে গিয়েছিল কিন্তু এখন অলোক সীমার বাড়িতে জানিয়েছে যে ও বিয়ের জন্য প্রস্তুত। ভাই তুই যখন ওদের দুজনকেই চিনিস তাহলে অলোকের সঙ্গে একটা কথা বল না, আশার আলো দেখে নয়না।
‘সীমা যেখানে বিয়ে করবে না বলছে সেখানে অলোকের সঙ্গে কথা বলে কী হবে? বরং সীমার সঙ্গে দেখা করার একটা ব্যবস্থা করে দে।’
‘ঠিক আছে তুই যবে বলবি। বিয়ে ছাড়া আর কিছুতে ওর না নেই, নয়না বলে, ‘মানে কারও সঙ্গে দেখা করতে ওর কোনও অসুবিধা নেই। কাল বরং সন্ধেবেলায় আমি ঝুমাদের বাড়ি চলে যাব আর পরে তুই আমাকে ওখানে নিতে আসিস।’
‘তাহলে কাল অফিস থেকে বেরোবার আগে তোকে ফোন করে দেব যাতে তুই সীমার সঙ্গে কথা বলার একটা সুযোগ করে দিতে পারিস।’
পরের দিন দেব যখন নয়নাকে নিতে ওখানে পৌঁছোল তখন ড্রইংরুমে বসে সীমা, ঝুমার সঙ্গে নয়নার জোর আড্ডা চলছে।
দরজা খুলে দেব-কে দেখে সীমা আশ্চর্য হয়ে গেল, ‘স্যার আপনি?’
‘আরে সীমা যে, তুমি এখানে?’ দেবও আশ্চর্য হওয়ার ভান করে। তারপর নয়না আর ঝুমার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আরে সীমা আমার নাটকের পাত্রী। আমি যেহেতু নাটকের ডিরেক্টর এবং সিনিয়র, স্বাভাবিক ভাবে তাই ও-ও আমাকে ‘স্যার-ই সম্বোধন করে। ঝুমা তুই তো কখনও আমাকে বলিসনি যে তোর দিদি অখিল ভারতীয় নাটক প্রতিযোগিতার বিজেতা?’
‘নয়নাও কখনও আপনার সম্পর্কে কিছু বলেনি। এখনকার মেয়েগুলোর অন্যদের সম্বন্ধে কিছু বলার সময় কোথায়?’ সীমা কপট রাগ দেখায়, ‘স্যার ভালোই হয়েছে আপনার সঙ্গে দেখা হওয়াতে। আপনার মতামতের একটু দরকার ছিল। একটা দিন আমাকে একটু সময় দিতে পারবেন?’
‘একটা দিন কেন? আজ-ই এক্ষুনি কথা হতে পারে তবে এক কাপ চায়ের বদলে, বলে দেব মুচকি হাসে।
‘চা না খাইয়ে এমনিতেও আপনাকে ছাড়তাম না, বলে ঝুমা উঠে দাঁড়ায়, ‘দিদি তুই দেবদাকে নিয়ে ও-ঘরে বসে নিশ্চিন্তে কথা বল, আমি চা করে নিয়ে আসছি। মা-বাবার ফিরতে এখনও অনেক দেরি।’
সীমার ঘরে এসে বসতেই দেব জিজ্ঞেস করল, ‘অলোকের কী খবর? অনেকদিন ওর সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই।’
লম্বা নিঃশ্বাস টেনে সীমা উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ পাড়াতেই রয়েছে তবে দেখাসাক্ষাৎ হয় না বললেই চলে।’
‘কেন? ব্যস্ততার কারণে নাকি ঝগড়া হয়েছে?’
‘কোনওটাই নয় স্যার। আমারই হয়তো ভুল বোঝার কারণে এমনটা হয়েছে, একটু চুপ থাকে সীমা, তারপর আবার বলে, ‘ওই ব্যাপারেই আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই। আপনার সম্পর্কে কাগজে প্রায়শই লেখা দেখতে পাই। অনেকবার দেখা করার কথাও ভেবেছি কিন্তু কী করে সেটা বুঝতে পারিনি। আমার মনে হয় অলোক নিজের দাদুকে খুন করেছে।’
দেব মনে মনে চমকে ওঠে, তবে কি এটাই কারণ অলোককে বিয়ে না করার? কিন্তু মুখে গাম্ভীর্য বজায় রেখেই জিজ্ঞেস করে, ‘সন্দেহ করার কারণ?’
‘যে রাতে অলোকের দাদু খুন হন আমি একটা নেমন্তন্ন বাড়ি থেকে রাত করে বাড়ি ফিরেছিলাম। আমি অলোককে ওদের বাড়ির ছাদ থেকে লাফিয়ে গাছ ধরে পালাতে দেখেছি। কিন্তু অলোক বলছে ও তখন ওদের উলটো দিকের রাস্তার ওপারে বন্ধুর বিয়ের প্যান্ডেল-এ ব্যস্ত ছিল। ওখানেই ও দাদুর মৃত্যুর খবরটা পায়।’
‘কিন্তু তোমার মনে হয় যাকে তুমি পালাতে দেখেছ সে অলোক?’
‘হ্যাঁ স্যার। খুনের কারণ এখনও বোঝা যাচ্ছে না। বাড়ি থেকেও কিছু চুরি হয়নি আবার অলোকের দাদুর সঙ্গে কারও শত্রুতাও ছিল না।’
‘ওনার মৃত্যুতে কারও ব্যক্তিগত লাভের সম্ভাবনা আছে কি?’
‘একমাত্র অলোকেরই লাভ হতে পারে যতদূর আমি জানি। এমনিতে সকলেই জানে যে অলোককেই ওর দাদু নিজের সমস্ত সম্পত্তি লিখে দিয়ে গেছেন।’
‘সীমা তুমি যা কিছু জানো বা যা সন্দেহ করছ সব আমাকে পরিষ্কার করে খুলে বলো। কথা দিচ্ছি আমি যতটা পারব তোমাকে সাহায্য করব।’
‘মায়ের একদম ইচ্ছে ছিল না যে আমি কলেজে লেকচারারের কাজ করি। কারণ মায়ের মনে হয়েছিল লেকচারার হলে যেহেতু অলোক ওর দাদুর টিভি, ফ্রিজের শোরুমে বসে আর দাদুর ব্যাবসাটার দেখাশোনা করে সেহেতু আমি অলোককে বিয়ে করতে রাজি হব না। অলোক নিজেও টিভি ফ্রিজের ব্যাবসাটা চালাতে চাইছিল না। ওর ইচ্ছে ছিল বিদেশি কম্পিউটারের এজেন্সি নেওয়ার। বাবার সঙ্গেও আলোচনা হয়েছিল যে এজেন্সি নেওয়ার জন্য কোনওরকম আইনি বাধ্যবাধকতা পেরোতে হবে কিনা। পরে খবরাখবর নিয়ে জানা যায় এজেন্সি নেওয়ার জন্য আইনি কোনও জটিলতা নেই। আমার মা-ও নিশ্চিত হন যে লেকচারার মেয়ে কম্পিউটার বিক্রেতা-কে বিয়ে করতে রাজি হবে।
কিন্তু বেঁকে বসেন অলোকের দাদু। যদিও শোরুম অলোকের নামেই লিখে দিয়েছিলেন উনি কিন্তু ব্যাবসার চাবিকাঠি ওনার হাতেই ছিল। ওনার বক্তব্য ছিল টিভি, ফ্রিজের মতো কম্পিউটার, দৈনন্দিন প্রয়োজনীয়তার মধ্যে পড়ে না সুতরাং তার চাহিদাও সীমিত। তাই উনি জীবিত থাকতে অলোককে টিভি, ফ্রিজ বিক্রি করেই খুশি থাকতে হবে, ওনার মৃত্যুর পরই নতুন চিন্তাভাবনা করার স্বাধীনতা পেতে পারে অলোক।
দাদুর জন্যই অলোকের আইবিএম-এর এজেন্সি নেওয়ার স্বপ্ন ভেঙে গুঁড়িয়ে যায়। এই লোভেই ও ওর বাবা, দাদার মতো চাটার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট হতে চায়নি। ও কিছু না কিছু করে নিজের হাতখরচা ঠিকই চালিয়ে নিত, শোরুমের একটা টাকাও নিত না। দাদু মারা যাওয়ার আগেই ও আমাকে বলেছিল, কেরিয়ার তৈরি না করে ও কিছুতেই বিয়ে করবে না।’
‘অলোকের সঙ্গে কথা বলার পর তুমি কী ডিসাইড করলে?’ দেব প্রশ্ন করে।
‘আমারও স্যার, অলোকের সিদ্ধান্তই সঠিক মনে হয়েছিল। মনে মনে ভেবেই রেখেছিলাম, বিয়েটা যেমন করেই হোক পিছোতে হবে। কিন্তু বাড়িতে কিছু জানাবার আগেই অলোক আমাদের বাড়ি এল। ওকে খুব চিন্তামুক্ত দেখাচ্ছিল সেদিন। বাড়িতে আমাকে কিছু বলতে মানা করল, বলল কয়েকদিনেই সব ঠিক হয়ে যাবে। কয়েকদিন পরেই আমাদের বন্ধু রঞ্জনের বিয়ে ছিল। আমরা বিয়েতে খুব মজা করেছিলাম। রাত্রে বন্ধুদের পীড়াপীড়িতে অলোক ওখানেই থেকে যায় আর আমি বাড়ির সকলের সঙ্গে নিজের বাড়ি ফিরে আসি।
অলোকের বাড়িটা আমাদের বাড়ির ঠিক পিছন দিকটায়। ওদের বাড়িতে একটা জাম গাছ আছে যেটা আমাদের ছাদের কিছুটা নিয়েও ডালপালা বিস্তার করেছে। আমি তখন ছাদের ঘরটায় থাকতাম। ওদের ছাদটাও অলোক আর ওর দাদুর ঘরের লাগোয়া ছিল। অনেকদিনই এমন হয়েছে যে ওর দাদু ঘুমিয়ে পড়ার পর অলোক জাম গাছের ডাল ধরে আমাদের ছাদে চলে এসেছে।’
দেব কথার মাঝেই সীমাকে থামিয়ে দেয়, ‘চলে এসেছে… মানে এখন আর আসে না?’
‘দাদুর খুন হওয়ার পর বাবা আমাকে একলা আর উপরের ঘরে শুতে দেয় না। হ্যাঁ স্যার যা বলছিলাম, সেদিন রাত্রে গাছের পাতার আওয়াজ হওয়াতে আমি ভেবেছিলাম বুঝি অলোক এসেছে। আমি বাইরে বেরিয়ে আসি। গাছের ডাল তখনও নড়ছিল কিন্তু ছাদে কেউ ছিল না। আমি কার্নিশ থেকে নীচে তাকিয়ে দেখি গাছ থেকে নেমে কেউ পালিয়ে যাচ্ছে। আর ঠিক তক্ষুনি দাদুর ঘর থেকে ওদের বাড়ির পুরোনো চাকর রমাদার আওয়াজ পাই যে দাদামশাইয়ের কিছু একটা হয়ে গেছে। আমি দৗড়ে নীচে এসে সবাইকে জাগিয়ে রমাদার চ্যাঁচাবার কথাটা বলি। সবাই যখন অলোকদের বাড়ি পৌঁছোই, দাদুর ঘরে গিয়ে দেখি ওনার মুখের উপর বালিশ চাপা দিয়ে কেউ ওনাকে খুন করেছে।
আমি কাউকেই বলতে পারিনি যে আমি স্বচক্ষে খুনিকে গাছ ধরে নীচে নেমে যেতে দেখেছি। মুখ দেখতে পাইনি ঠিকই কিন্তু খুনির পোশাক স্পষ্ট দেখেছিলাম রাস্তার আলোয়। অলোক বিয়েবাড়িতে সিল্কের যে কুর্তা-পাজামা পরেছিল একদম সেরকমই। বাবা আমার ছোটো ভাইকে পাঠায় অলোককে বিয়ে বাড়ি থেকে ডেকে আনার জন্য। কিন্তু আমি নিশ্চিত ছিলাম বিয়েবাড়িতে ভাই অলোককে পাবে না অথচ কিছুক্ষণ পরেই ভাই অলোককে নিয়ে আসে। আমি ভালো করে লক্ষ্য করি কিন্তু গাছে চড়া বা নামার কোনও দাগ অলোকের জামাকাপড়ে ছিল না। ও-ও সবার মতো হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল দাদুর ঘরে ঢুকে।’
‘তাহলে তোমার কেন সন্দেহ হচ্ছে যে অলোকই খুনটা করেছে?’
‘কারণ পরের দিনই পুলিশ এসে গাছের নীচে জুতোর দাগ দেখতে পায়। জুতোর দাগ দেখেই সনাক্ত করে যোধপুরী জুতোর ছাপ ওগুলি। ওই একই জুতো অলোকের পায়েতেও ছিল। অপরাধীর পালাবার তাড়া থাকাতে জুতোর পুরো ছাপ যেহেতু মাটিতে পড়েনি তাই জুতোর সঠিক সাইজ পুলিশ ধরতে পারেনি। অলোককে ওরা সন্দেহ করছিল কিন্তু ওই সময় ও যে বিয়েবাড়িতেই ছিল, বন্ধুদের সঙ্গে তোলা ছবি দিয়ে ও প্রমাণ করে দেখিয়ে দিয়েছে। পুলিশ ওকে ছেড়ে দিয়েছে ঠিকই কিন্তু আমার মন বলছে ওটা অলোকই ছিল কারণ গাছ বেয়ে উপরে চড়া বা নীচে নামার রাস্তাটা ওই জানত আর দ্বিতীয়ত দাদুর মৃত্যুতে ওই সবথেকে লাভবান হল।’
‘দাদুর শ্রাদ্ধশান্তির কাজ মিটে যাওয়ার পরপরই অলোক এজেন্সি নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছিল। যেন বাড়িতে কিছুই হয়নি। আর যদি বিয়েবাড়ির ছবির কথাই বলেন, তাহলে সেই ছবি যখন খুশি তোলা হয়ে থাকতে পারে। খাবার খাওয়ার সময় থেকে বিয়েতে বসা পর্যন্ত কে আর সমানে ছবি তুলতে থাকে? ফোটোগ্রাফার-রাও তো খাবে। আর বিয়ের হল লাগোয়া খাবার জায়গা করা হয়েছিল বিয়েবাড়ির ঠিক উলটো রাস্তাতেই অলোকদের বাড়ি। লুকিয়ে একবার বেরিয়ে গিয়ে একটা বৃদ্ধ মানুষকে মুখে বালিশ দিয়ে মারতে কত আর সময় লেগে থাকবে?’
‘অলোকের সঙ্গে এটা নিয়ে কথা বলেছ?’
‘না স্যার, এই প্রথম আপনাকে সব খুলে বললাম।’
‘বিয়েটা কী বলে আটকালে?’
‘দাদুর মৃত্যুর পর সঙ্গে সঙ্গে বিয়ে সম্ভবও ছিল না। অলোকও খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। বাড়িতে বাবার পরামর্শ নিতে প্রায়শই আসত কিন্তু আমি একা দেখা করাটা এড়িয়ে চলতাম। এরপর মা যখন বিয়ের জন্য তাড়া দেওয়া আরম্ভ করল, আমি পরিষ্কার বলে দিলাম যে বিয়ের জন্য আমার একটু সময় দরকার। তাছাড়া অলোকের ব্যস্ততা দেখে ওর বাড়ির সকলেও বিয়েটা পিছিয়ে দেওয়া যখন মনস্থ করল, তখন আমার বাড়ি থেকেও সকলে এটা মেনে নিল।’
‘অলোকের সঙ্গে দেখা করো না, এটা নিয়ে ও কিছু বলে না তোমাকে? দেব জানতে চায়। সীমা হেসে ফেলে বলে, ‘স্যার ওকে এটা বুঝিয়েছি যে মা আমাদের বেশি মেলামেশা করতে দেখলেই বিয়ের জন্য তাড়া দেবে। আপনিই বলুন স্যার যাকে আমি অপরাধী মনে করে সন্দেহ করি, তাকে আমি কী করে বিয়ে করব?’
‘না, না, সেটা কখনওই সম্ভব নয়। তুমি বরং দাদুর নাম আর মৃত্যুর তারিখটা বলো। আমি এই কেসটার ফাইলটা দেখি। আর সীমা, তুমি বিয়ের জন্য রাজি হয়ে যাও। বিয়ের গোছগাছ কমপ্লিট হতে হতে আশা করা যায় খুনি ধরা পড়বে। অলোক যদি অপরাধী হয় তাহলে বিয়ে এমনিই ভেঙে যাবে। আর অপরাধী যদি অন্য কেউ হয়ে থাকে তাহলে তোমার রাজি না হওয়ার বা বাড়ির লোকেদের মিথ্যা চিন্তা করাবার কি কোনও দরকার আছে?’
‘সেটা ঠিকই বলেছেন স্যার।’
রাস্তায় আসতে আসতে দেব নয়না-কে জানাল যে ও সীমাকে বিয়ে করতে রাজি করিয়েছে। সুতরাং ঝুমার আর কোনও সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
পরের দিন কমিশনারের সঙ্গে কথা বলে দেব কেসটার ফাইল বার করিয়ে নিল। যা তথ্য পাওয়া গেছে তাতে প্রায় কিছুই প্রমাণ হওয়া সম্ভব না। স্পেশাল পারমিশন নিয়ে পুলিশকে সাহায্য করার অছিলায় কেসটার দায়িত্বভার ও নিজের উপর নিয়ে নিল।
কেসটা নিয়ে আবার নতুন করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে শুনে অলোকের বাড়ির লোকেরা যেমন আশ্চর্য হল, তেমনি খুশিও হল। সবথেকে খুশি মনে হল অলোককে।
‘আমি ইচ্ছে করেই নিজেকে ব্যস্ত রাখি কারণ স্যার, সময় থাকলেই খালি মনে হয় দাদুকে কে খুন করে থাকতে পারে?’
‘এবং কেন খুন করেছে?’ দেব বাকিটা জুড়ে দেয়।
‘স্যার, দাদুর গলায় মোটা সোনার চেন, হাতের আঙুলে চারটে মোটা মোটা সোনার আংটি দামি পাথর বসানো, হাতে সোনার ঘড়ি, পাঞ্জাবিতে সোনার বোতাম লাগানো ছিল এছাড়াও আমার ল্যাপটপ, আইপ্যাড সবই টেবিলের উপর রাখা ছিল। আমার মনে হয় ওই সময় রমাদা দাদুর জন্য দুধ নিয়ে উপরে উঠছিল, ওরই পায়ের আওয়াজ পেয়ে চোর আর চুরি করার সময় পায়নি, পালিয়েছে। মধ্যিখান থেকে দাদুর প্রাণটা চলে গেল, অলোক বলে।
‘গাছে চড়া-নামার রাস্তাটা তো আর নতুন লোকের পক্ষে জানাটা সম্ভব নয়?’ সন্দেহ উঁকি মারে দেবের কথায়।
‘সেটাই তো সবথেকে আশ্চর্যের ব্যাপার। চেনাশোনার মধ্যেই কেউ খুনটা করেছে। গাছের নীচে মাটিতে জুতোর ছাপ দেখে পুলিশ প্রথমে আমাকেই সন্দেহ করেছিল। কিন্তু সেদিন আমার একটা বন্ধুর বিয়ে ছিল। ওখানে যত ছবি তোলা হয়েছে এবং প্রত্যেকটা ভিডিও ফ্রেমে আমার ছবি থাকাতে বা আমার উপস্থিতির কারণে আমি বেঁচে যাই।’
‘আমি ওই অ্যালবাম এবং ভিডিও দেখতে পারি?’
‘নিশ্চয়ই স্যার। আমি বন্ধুর বাড়ি থেকে অ্যালবাম আর ভিডিও ক্যাসেট-টা নিয়ে এসে আপনাকে ফোন করে দেব।’
প্রায় ঘন্টা দেড়েক বাদে অলোক দেব-কে ফোন করল, ‘স্যার অ্যালবামটা নিয়ে এসেছি কিন্তু ভিডিও ক্যাসেট-টা বারবার চালাবার জন্য জায়গায় জায়গায় ঘষে গেছে। তাই ওরা ওটা কোথাও রেখে দিয়েছে, এখন আর খুঁজে পাচ্ছে না। আমি অবশ্য ওদের খুঁজতে বলে দিয়েছি।’
‘ভালো করেছ। তুমি অ্যালবামটা আমার অফিসে পাঠিয়ে দাও।’
‘ঠিক আছে স্যার। আর কোনও দরকার হলে আমাকে ফোন করে দেবেন, আমি পৌঁছে যাব।’
অ্যালবাম দেখা শেষ করে দেব সীমাকে ফোন করল, ‘সীমা, সেদিন রাতে তুমি যাকে পালাতে দেখেছিলে তার কুর্তা-পাজামার রং কী ছিল বলতে পারবে?’
‘না স্যার… আলো খুবই কম ছিল। মেটেরিয়ালের শাইন আর কুর্তার লম্বাটা শুধু চোখে পড়েছিল।’
‘আচ্ছা ওই বিয়েতে অলোক ছাড়াও তো অনেকেই নিশ্চই কুর্তা-পাজামা পরেছিল। তাহলে যাকে পালাতে দেখেছিলে সেটা অলোক না হয়ে অন্য কেউ-ও তো হতে পারে।’
‘কুর্তা-পাজামা তো অনেকেই পরেছিল কারণ এখন এটাই ফ্যাশন কিন্তু ওটা অলোক-ই ছিল এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। কারণ পালাবার রাস্তাটা একমাত্র ওরই জানা এবং দাদু মারা যাওয়ায় ওরই লাভ হয়েছে সবথেকে বেশি।’
দেব তর্ক বাড়াল না কারণ সীমার কথাতে একটা জোর ছিল। কিন্তু দেবের মন সেটা মেনে নিতে পারছিল না। ছবিগুলো আবার ভালো করে দেখল। কী মনে হতে অলোককে ফোন করে ওর অফিসে আসতে বলল।
‘সব ছবিগুলোতে যে বর আর তোমরা যারা একসঙ্গে রয়েছ, সবাই তো কলেজ ফ্রেন্ড্স, তাই না অলোক?’ দেব জিজ্ঞেস করে।
‘হ্যাঁ স্যার, শুধু একজন ছাড়া। যে ছেলেটি আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে সে শুধু কলেজের বন্ধু নয়।’
‘ও-ও হ্যাঁ। ও তো প্রায় প্রতিটা ছবিতেই তোমার গায়ের সঙ্গে ঘেঁসে দাঁড়িয়ে আছে দেখছি।’
‘ও আমার বিজনেস পার্টনার স্যার, ওর নাম সৌম্য। আমেরিকা থেকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে এসেছে। আপনি নিশ্চই জানেন, আইবিএম-এর ডিলারশিপ নিতে গেলে কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ হওয়াটা মাস্ট। এছাড়াও ইলেক্ট্রনিক প্রোডাক্ট বিক্রি করার অভিজ্ঞতা এবং একই সঙ্গে এয়ারকন্ডিশনড্ শোরুম থাকাটাও জরুরি। আমরা দুজনে মিলে এই সব শর্তসাপেক্ষে জোনাল ডিস্ট্রিবিউটরশিপটা নিয়েছি।’
‘সৌম্যর সঙ্গে কতদিনের পরিচয়?’
‘ছোটো থেকে স্যার। আমাদের বাড়িতে একটা বড়ো জাম গাছ আছে। আমরা ছোটোবেলায় ওই গাছে চড়ে বসে থাকতাম। ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতাম। ওই গাছের মতোই বড়ো বড়ো স্বপ্ন। সৌম্য তো আমেরিকা চলে গেল। আমি দাদু আর সীমার জন্য যেতে পারলাম না কারণ ওদের না দেখে থাকতে পারতাম না। কিন্তু সৌম্য ছোটোবেলার বন্ধুত্ব আর স্বপ্ন কোনওটাই ভোলেনি। ফেরত এসে আমাকে দিয়ে এই বড়ো কাজটা করিয়েই নিল।’
‘অলোক এই কেসটা সল্ভ করতে হয়তো ছবিতে থাকা তোমার সব বন্ধুদেরকেই ডেকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতে হতে পারে, দেব বলে।
‘আপনি বললেই আমি সবাইকে ডেকে আনব। কিন্ত আমার মনে হয় সবথেকে আগে আপনি সীমার সঙ্গে কথা বলুন। হয়তো ও এই কেস সম্পর্কে কিছু আলোকপাত করতে পারে।’
‘কেমন করে?’
‘ঠিক বলতে পারব না স্যার, তবে কেন জানি না আমার মনে হচ্ছে ও কিছু একটা জানে। দাদুর মৃত্যুর পর থেকেই ও কেমন জানি চুপচাপ হয়ে গেছে। আগের সীমাকে আর খুঁজে পাই না।’
‘দাদুকে খুব ভালোবাসত নাকি সীমা?’
‘সে তো সকলেই দাদুকে ভালোবাসত কারণ মানুষটাই তো ভালোবাসার যোগ্য ছিলেন।’
‘দাদুর মৃত্যুর খবর পেয়ে তোমার সঙ্গে কতজন বন্ধু এসেছিল?’
‘কেউ আসেনি কারণ সীমার ভাইয়ের মুখে খবরটা শুনতেই আমি কাউকে কিছু না বলেই ওর স্কুটারে চেপে বাড়ি চলে আসি।’
‘তোমাকে খুঁজতে তোমার পিছনে পিছনে কেউ আসেনি?’
‘না স্যার, অলোক মাথা নাড়ায়। ‘আমার খুব ভালো করে মনে আছে সেদিন রাতে ডাক্তার আর পুলিশ ছাড়া আমাদের সঙ্গে সীমার বাড়ির সকলে ছিলেন। সকালবেলায় ওরাই সকলকে খবর দেন।’
পরের দিন দুপুরবেলা সীমা আর দেবকে একসঙ্গে শোরুমে আসতে দেখে অলোক অবাক হয়ে গেল, ‘সব ঠিক আছে?’
‘আপাতত তো সব ঠিক আছে, গা ঝাড়া দেয় দেব, ‘তুমি বলেছিলে সীমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে, তাই ওকে এখানে নিয়ে এসেছি। তোমার বিজনেস পার্টনার আসেনি?’
‘হ্যাঁ এসেছে, ওর নিজের কেবিনে রয়েছে।’
‘বেশ, তাহলে চলো ওর কেবিনে গিয়েই বসা যাক।’
অলোক ওদের দুজনকে নিয়ে সৌম্যর কেবিনে পৌঁছোল। দেবের সঙ্গে সৌম্যর পরিচয় করিয়ে দিল।
‘কী খাবেন, ঠান্ডা না গরম?’ আন্তরিকতার সঙ্গে সৌম্য জিজ্ঞেস করল।
‘সে-সব পরে হবে। এখন শুধু অলোকের দাদুর খুনের ব্যাপারে কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দিন, ঠান্ডা গলায় দেব বলে। মুহূর্তে রক্তশূন্য হয়ে যায় সৌম্যর মুখ। তোতলাতে তোতলাতে কোনওরকমে বলে, ‘আমি… আমি এই সম্পর্কে কী বলব? আমি তো সীমার মুখ থেকে পরের দিন খুনের খবরটা জানতে পারি।’
‘সেটাই তো আমার প্রশ্ন সৌম্য। সারা বিয়েবাড়িতে আপনি সমানে অলোকের সঙ্গে সঙ্গে ছিলেন অথচ অলোক সীমার ভাইয়ের সঙ্গে বাইকে উঠে চলে এল আর আপনি জানতেই পারলেন না?’
সৌম্য হকচকিয়ে গেল। অলোকই উত্তর দিল, ‘আসলে স্যার ওই সময় বিয়ের নিয়ম হিসেবে আংটি খেলা চলছিল। বন্ধুরা সকলে মিলে বরপক্ষকে সাপোর্ট করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল।’
‘হ্যাঁ ঠিক তাই, আমিই সবাইকে ওখানে আটকে রেখেছিলাম যাতে আমরা আমাদের বন্ধুকে জেতাতে পারি’, সৌম্য নিঃশ্বাস ছেড়ে উত্তর দেয়।
‘কিন্তু আপনি নিজে তো ওই সময় ওখানে ছিলেন না…’
‘কী বলছেন আপনি?’ সৌম্য উত্তেজিত হয়ে দেবের কথার মধ্যেই বলে ওঠে, ‘আমি তন্ময়ের পাশে বসে ওর পিঠ চাপড়ে ওকে উৎসাহিত করছিলাম।’
‘তাহলে আপনাকে এই ছবিতে কেন দেখা যাচ্ছে না?’ দেব সৌম্যর দিকে অ্যালবামটা এগিয়ে দেয়। ‘এই ছবিটাতে আপনি নেই এবং এর পরের কোনও ছবিতেই আপনাকে দেখা যাচ্ছে না। না… না… আপনাকে শুধু শুধু কষ্ট করতে হবে না, আমিই বলে দিচ্ছি আপনি কোথায় ছিলেন?’
‘আমি বাথরুমে গিয়েছিলাম। খাওয়া-দাওয়াটা একটু বেশিই হয়ে গিয়েছিল, সৌম্যর স্বরে বিরক্তি ঝরে পড়ে।
‘না, ওই সময় আপনি অলোকের দাদুর ঘরে ছিলেন, দেব শান্ত কণ্ঠে বলে, ‘আপনি হয়তো ভেবেছিলেন দাদুকে খুন করে আপনি আবার বিয়েবাড়িতে ফিরে আসবেন কিন্তু তাড়াহুড়োতে গাছ থেকে নামতে গিয়ে নিশ্চয়ই আপনার জামাকাপড় খারাপ হয়ে গিয়ে থাকবে তাই বিয়েবাড়িতে ফিরে যাওয়াটা আপনি উচিত মনে করেননি।’
‘আপনি যা বলছেন তার কোনও প্রমাণ দেখাতে পারবেন?’ চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় সৗমেন।
‘দয়া করে আপনি একটু উঠে দাঁড়িয়ে দেয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়ান। আর অলোক তুমিও সৌম্যর পাশে ওই একই ভাবে দাঁড়াও, এই বলে দেব সীমার দিকে তাকায়, ‘আচ্ছা এবার তুমি এই দুজনকে ভালো করে দ্যাখো। দুজনেরই শরীরের গঠন কাঁধের ব্যাপ্তি প্রায় একইরকম। অন্ধকারে ঢিলেঢালা জামাকাপড়ে কে অলোক আর কে সৌম্য বোঝাটা সত্যি মুশকিল।’
‘আপনি ঠিক বলেছেন স্যার, উত্তেজনায় সীমার স্বর কেঁপে যায়, ‘আমার আগে কেন এটা মনে হল না যে সৌম্যও অলোকের মতন একই রঙের পোশাক পরেছিল এবং অলোকের থেকেও ওর কাছে দাদুকে খুন করার আরও বড়ো কারণ রয়েছে। ও-তো আইবিএম-এর এজেন্সি নেওয়ার জন্য নিজের সবকিছু ইনভেস্ট করে ফেলেছিল। এমনকী আমেরিকার চাকরি ছেড়ে, গ্রিন কার্ডও ফেরত দিয়ে ও ইন্ডিয়ায় চলে আসে। দাদু বেঁচে থাকলে ডিস্ট্রিবিউটারশিপ-টা কিছুতেই নেওয়া হতো না কারণ অলোককে তো পাওয়া যেত না…’
অলোক হঠাৎ-ই জিজ্ঞেস করে, ‘এসব তুমি কী বলছ সীমা? আগে তো কখনও বলোনি যে, তুমি দাদুর খুনিকে পালাতে দেখেছ?’
‘কী করে বলত, ওর তো পুরো সন্দেহটাই তোমার উপর গিয়ে পড়েছিল আর বেচারি বিয়ে পিছোতে বাধ্য হয়েছিল। ওর সঙ্গে হঠাৎ-ই আমার দেখা হয়ে যায় আর আসল সত্যটা বেরিয়ে আসে… উঁহু, পালাবার চেষ্টা কোরো না সৌম্য কারণ পুলিশ শোরুমের বাইরে অপেক্ষা করছে। আমি চাই না তোমার কর্মচারীদের সামনে তোমাকে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাওয়া হোক, সুতরাং চুপচাপ আমার সঙ্গে বাইরে চলো। আর প্রমাণ, সে তো পুলিশ দাদুর ঘরের দরজা, খাট ইত্যাদি থেকে যে আঙুলের ছাপ সংগ্রহ করেছে তার সঙ্গে তোমার আঙুলের ছাপ যে ম্যাচ করবে সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। এমনিতে সীমা খুনের কারণ কিছুটা বললেও বাকিটা পরিষ্কার করে বন্ধুকে বলো যে কেন এমনটা করলে,’ দেব বলে।
‘হ্যাঁ সৌম্য, তুই আমাকে ভরসা দিয়েছিলি যে লাভের পুরো টাকাটা তুই দাদুর হাতে তুলে দিয়ে দাদুকে রাজি করিয়ে নিবি আর নয়তো আর একটা শোরুম নেওয়ার ব্যবস্থা করবি, তাহলে তুই কেন এমনটা করলি?’ ব্যথিত কণ্ঠে বলে অলোক।
‘এছাড়া আমার আর কী বা করার ছিল? দাদু কিছু শুনতে বা শোরুমের জিনিস ছোটো শোরুমে শিফ্ট করত কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। আর বড়ো শোরুম নেওয়ার মতো আমার আর্থিক অবস্থা ছিল না। তুই যখন আমায় জানালি যে দাদু তোর নামে শোরুম-টা লিখে দিয়েছেন, আমি আমার চাকরি আর গ্রিন কার্ড ছেড়ে দিয়ে নিজের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা না করেই এখানে চলে এসেছিলাম। দাদু খুব ভালো করেই জানতেন কম্পিউটার বিক্রি করলে অনেক বেশি লাভ তবুও নিজের এই পুরোনো ব্যাবসা ছাড়তে রাজি ছিলেন না। ওনার এই জেদের জন্য আমি কেন সাফারার হতে যাব?’ তিক্ততা ঝরে পড়ে সৌম্যর কথায়।
‘ভালোই হল, সবকিছু ছবির মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। তোমার জন্য একটা কাজ করতে পারি। জেলে বসে যাতে আরও কয়করকমের ব্যবসার ব্লু প্রিন্ট তৈরি করতে পারো, তার ব্যবস্থা করে দিতে পারি।’ দেবের পরিহাসে ওই মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যেও অলোক আর সীমা না হেসে পারে না।