স্নিগ্ধ কোমল ভোরের আলোয় হোটেলের পিছনের ফাঁকা জায়গাটায় গিয়ে উপস্থিত হলাম। ধীরে ধীরে আর একটা নতুন দিন শুরু হচ্ছে। পাখির ডাকে মুখরিত চারপাশ। বিদায়ি শীতের রেশ ছেড়ে প্রকৃতি এখন ঋতুরাজের আবাহনে মত্ত। বসন্ত প্রেমের ঋতু, কারও কারও কাছে বিরহের ঋতু, আবির রং-এ রঙিন হওয়া দোল উৎসবের ঋতু। শহরে বসন্তের আগমন প্রত্যাগমন বড়োই ম্রিয়মান। কিন্তু শহর থেকে বহু দূরে এহেন গ্রাম্য পরিবেশে প্রকৃতির রূপ-রস-গন্ধ-বর্ণের নির্যাস রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুভব করা যায়।
ফাঁকা জায়গাটির তিন দিকে শাল, শিশু, বাবলা প্রভৃতি গাছের সমাহার আর তার মাঝে মাঝে রামধনু থেকে চুরি করা গাঢ় কমলা রঙের ফুলে মোড়া পলাশ গাছ। এর আগে বসন্তের এই কিংশুকের আবেশে মুগ্ধ হওয়ার সৗভাগ্য আমার হয়নি। গাছগুলি প্রায় পাতা বিহীন, ফুলের ভারে যেন নুইয়ে পড়ছে। হাতের নাগাল থেকে উঁচু ডাল পর্যন্ত গাছগুলি ফুলের আতিশয্যে দিশাহারা। মনে হল পুব আকাশের রক্তিম আভা মর্তে নেমে এসেছে। শিশির ভেজা ঘাসের ওপর পলাশের সেজ বিছানো। গাঢ় সবুজ রঙের মাঝে যেন আগুনের ফুলকারি নকশা। অঞ্জলি ভরে তুলে নিলাম পলাশ ফুল।
কোনও একটা ম্যাগাজিনের পাতা ওলটাতে ওলটাতে হঠাৎ চোখে পড়েছিল নামটা। পুরুলিয়া জেলার আসানসোলের কাছে, প্রায় ৩২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি ছোট্ট আদিবাসী গ্রাম বড়ন্তি। কলকাতা থেকে বড়ন্তির দূরত্ব ২৩৬ কিলোমিটার। পাঞ্চেত পাহাড় এবং বিহারীনাথ পাহাড়ের মাঝে অবস্থিত সাঁতুড়ি ব্লক। ছোটো ছোটো পাহাড়, টিলা, নদী, জঙ্গল এবং তার সাথে আদিম গ্রাম্য পরিবেশ মন ছুঁয়ে যায়।
বড়ন্তি পাহাড়ের কোল ঘেঁসে বড়ন্তি গ্রাম। সামনে মুরাডি পাহাড়ের পাশ দিয়ে বয়ে চলা বড়ন্তি নদীর ওপর বাঁধ দিয়ে তৈরি রামচন্দ্রপুর জলধারা প্রকল্প। লেকটির পোশাকি নাম রামচন্দ্রপুর জলধারা। গ্রামে ঢোকার মাটির রাস্তাটি লেকের পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে পাহাড়ে গিয়ে মিশেছে। গ্রামে ঢোকার পথে চোখে পড়ে শাল, সেগুন, শিশু, বাবলা, নিম, শ্যাওড়া, আকাশমণি এবং অবশ্যই পলাশ গাছ।
প্রথমবার যখন বড়ন্তি আসি সেটা জুন মাস। গ্রাম্য পথের দুপাশ তখন গাঢ় সবুজ গাছগাছালিতে ছেয়ে আছে। এক যুবকের কাছে জেনেছিলাম, বড়ন্তির আসল সৗন্দর্য বসন্তের আগমনের সঙ্গে বিকশিত হয়। চারদিক ভরে থাকে আগুন রঙা পলাশে। তাই বহু ব্যস্ততাকে পেছনে রেখে দু-তিন দিনের ছুটি নিয়ে রঙ্গিনী পলাশের রঙে রঙিন হতে চলে এলাম বড়ন্তি।
আমাদের হোটেল থেকে দু-পা এগিয়েই গ্রামের বসতি শুরু। এই সকালে দলে দলে গ্রাম্য যুবা, পুরুষ, মহিলারা গরু, ছাগলের পাল চরাতে বেরিয়েছে। মাঠের সামনের দিকটায় পাকা রাস্তা। দূর থেকে চোখে পড়ল আদিবাসী বালিকারা রাস্তার ওপর প্রায় উপুড় হয়ে কি যেন খেলা করছে। কাছে গিয়ে দেখি, ওরা পলাশ ফুল দিয়ে রাস্তার ওপর নিজেদের নাম লেখার খেলায় ব্যস্ত।
‘এত ফুল কোথা থেকে পেলি?’
একজন বলল, ‘গাছ থিক্যা পাড়লাম গো।’
‘কোথায় থাকিস তোরা?’
‘ইতো সামনের গেরামটায়।’
দু’জনের বয়স ছয়-সাত বছর হবে। অন্য দু’জন একেবারেই ছোটো। দলের মধ্যে সবচেয়ে বড়ো মেয়েটি অনর্গল বলে চলে নাম, ঠিকানা, কোন স্কুলে পড়ে, বাড়িতে কে কে আছে ইত্যাদি। তার মাঝেই কৌতূহলী হয়ে জেনে নেয়, আমরা কোন হোটেলে উঠেছি। গ্রাম্য সরলতায় আবদার করে বসে– দিদি তোমার সঙ্গে ছবি তুলব। ছবি পর্ব শেষ করে সামনের দিকে এগোতে লাগলাম।
পেছন থেকে ছোটো মেয়েটি বলে উঠল– ‘তুমি পলাশ ফুল নিবে?’ উত্তরের অপেক্ষা না করেই দেখি বড়ো মেয়ে দুটির মধ্যে একজন তরতরিয়ে রাস্তার পাশে একটি গাছে উঠে পড়েছে। দাঁড়িয়ে পড়লাম। মেয়েটি একগুচ্ছ পলাশের ডাল নিয়ে এল। গ্রাম্য আদিবাসী বালিকাদের সারল্য ও ভালোবাসায় ভরা এই উপহার যেন– সারা জীবনের প্রাপ্ত উপহারগুলির মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ।
গ্রামটিতে বেশ কয়েকটি ঘরের বাস। মাটির রাস্তার দুপাশে সযত্নে তৈরি আড়ম্বরহীন দৈন্য মাটির বসতি। চোখে পড়ল একটি বড়ো পাতকুয়ো। মেয়েরা জল তোলায় ব্যস্ত। আরও কিছুটা হাঁটার পর নজরে এল প্রাথমিক বিদ্যালয়। জিজ্ঞেস করে জানলাম, এরপর পড়াশোনা করতে হলে যেতে হয় মুরাডিতে। বড়ন্তি থেকে মুরাডির দূরত্ব ৬ কিলোমিটার। বাঁদিকের ঘরগুলির পেছন থেকেই বড়ন্তি পাহাড় শুরু।
পাহাড়ে ওঠার রাস্তা খুঁজছি! গ্রামের এক যুবতি বধূ বলল, ‘আমরা রোজ সকালে কাঠ আনতে পাহাড়ে উঠি। কাল সকালে আমাদের সাথে যেও। না হলে পথ হারিয়ে যাবে। তাছাড়া জঙ্গলে অনেক জন্তু-জানোয়ার আছে। এখন বেলা হয়ে গেছে, পাহাড়ে চড়তে কষ্ট হবে।’বাহ্ এ তো মেঘ না চাইতেই জল। খুব ভালো, তবে কালই হবে পাহাড় অভিযান।
হোটেলে ফিরে স্নান খাওয়া সেরে নিলাম। বেলা একটু পড়লে লেকের ধারে যাব ঠিক হল। দিঘির টলটলে কালো জলে সূর্যাস্তের দৃশ্য বড়োই মনোরম। আগের বার অবশ্য জমির ওপর আল বরাবর হেঁটেই লেকে পৌঁছেছিলাম। হোটেলের দুটি পোষ্য সারমেয় রাস্তা চিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। সেই অদ্ভুত আনুগত্য এখনও ভুলতে পারিনি। গ্রীষ্মে লেকের জল কম থাকে। সামনে বেশ অনেকটা ডাঙা এবং জলজ আগাছা ভেসে ওঠে। রাস্তার ঢাল বেয়ে নেমে পড়েছিলাম স্নানের আনন্দ নিতে।
বিকেলে বসন্তের সৗন্দর্য উপভোগ করতে, রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে লেকের সামনে পৌঁছোলাম। এখন অবশ্য লেকে জল বেশি, থইথই জল কয়েক ফুট উঁচু রাস্তার ঢালের নীচ পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে। বাঁদিকের গাছগুলির ডালের ফাঁকফোকরে সূর্য লুকোচুরি খেলছে। এইসময় বড়ন্তিতে পর্যটক বেশি থাকেন। প্রায় প্রত্যেকেই সূর্যাস্তের দৃশ্য উপভোগের উদ্দেশ্যে লেকের পাশের রাস্তা বরাবর মৃদুমন্দ গতিতে হেঁটে বেড়াচ্ছেন।
একজন বয়স্ক ভদ্রমহিলা হাঁটতে হাঁটতে উচ্চস্বরে রবীন্দ্রসংগীত গাইছেন। সূর্য দিন আহ্নিক শেষ করে দিঘির ওপাশের পাহাড়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। পশ্চিম আকাশের রং ধীরে ধীরে পালটে গেল। মনে হল আগুনের একটা গোল বল যেন পাহাড় থেকে গড়িয়ে দিঘির জলে টুপ করে ডুবে গেল।
পরদিন সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম ভাঙল। ট্রেকিং করে পাহাড়ে উঠব, একি কম রোমাঞ্চের! তৈরি হয়ে নিলাম। সেই ছোট্ট মেয়েটি ডাকতে এল। কতটা ওপরে উঠতে পারব জানি না। পাহাড়টা বেশ খাড়াই। একজনের বাড়ির উঠান পেরিয়ে জঙ্গলে ঢুকলাম। সঙ্গী যুবতি বধূটি বলল, পুরো শীতকাল ধরে ওরা কাঠ সংগ্রহ করে। সারা বছরের জন্য মজুত করে, বিশেষ করে বর্ষাকালের জন্য।
পায়ের নীচে শুকনো পাতার পুরু স্তর। পাতার মর্মর শব্দ কানে বাজছে। ধারে কাছে কোনও প্রাণী থাকলে এই শব্দে নিশ্চিত পালাবে বা সতর্ক হয়ে যাবে। ধীরে পা ফেলার চেষ্টা করলাম যাতে শব্দ না হয়। না, বৃথাই চেষ্টা। জঙ্গলটি বেশ ঘন। তবে বেশিরভাগ গাছেই সব পুরোনো পাতা ঝরে গিয়ে নতুন কচি পাতা এসেছে। একটা লম্বা ঢ্যাঙা গাছে বড়ো বড়ো হলুদ ফুল ফুটে আছে। বেশ সুন্দর দেখতে।
একটানা অনেকটা উঠে হাঁফ ধরে গেল। দাঁড়িয়ে বিশ্রাম নিচ্ছি, হঠাৎ যুবতিটি বলে উঠল, ওপরে ডান দিকে হরিণের দল। আমাদের চোখ ওই পর্যন্ত পৌঁছোল না। ঝোপ-ঝাড়, গাছের ডালে আটকে গেল। তাছাড়া ওই দিকটা বেশ ঘন জঙ্গল, আলো কম। কই, কোথায়…? প্রশ্ন করলাম। ওই যে ওই দিকে, আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে, এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়েছে, মেয়েটি বলল। অনেক কষ্টে নজরে এল স্বাস্থ্যবান হরিণগুলি। অনেকগুলি একসাথে রয়েছে। ওরা খাবারের সন্ধানে নীচে নামছিল। আর একটু ওপরে উঠতে গেলাম, হরিণগুলি ঝোপের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।
এই অরণ্যে বুনো খরগোশ, বুনো শূকরও আছে। মাঝে মাঝে দেখা মেলে নেকড়ে বা হায়নারও। সামনে আর একেবারেই রাস্তা নেই। ডাল, পাতা, ঝোপ সরিয়ে রাস্তা তৈরি করে ওপরে উঠতে হচ্ছে। এখান থেকে পাহাড় আরও খাড়া হয়ে গেছে। আর ওপরে উঠলে নামতে বড়োই কষ্ট হবে। আর এগোনো ঠিক হবে না। একটা পাথরের ওপর বসলাম। এই জায়গাটা কিছুটা ফাঁকা, দূরে দেখা যাচ্ছে মুরাডি পাহাড়, বড়ন্তি নদী এবং বিশাল লেক। আরও দূরে দিগন্তরেখা, এত ওপর থেকে গ্রাম, পাহাড়, দিঘি, নদী, জঙ্গল এবং অবশ্যই পলাশ বন অপূর্ব, অনবদ্য, অবর্ণনীয়, নয়নাভিরাম দৃষ্টিসুখ দিচ্ছে। বেশ খানিকক্ষণ এই প্রাকৃতিক শোভার পরশ নিয়ে ধীরে ধীরে নীচে নেমে এলাম।
হোটেলে ফিরে এলাম। আশপাশের গ্রাম এবং এই শান্ত-নির্জন পরিবেশের স্বাদ নেওয়ার উদ্দেশ্যে একটি গাড়ি ঠিক করে ফেললাম। ধুলো উড়িয়ে গ্রামের মধ্যে দিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলল। শালের জঙ্গলের ভিতর দিয়ে গাড়ি এসে থামল একটি গ্রামের মুখে। গ্রামটির নাম রামজীবনপুর। এখানে সব ঘরই সাঁওতালদের। সম্ভবত রামচন্দ্র মহাশয় এখনও বনবাস থেকে ফেরেননি। তাই রাম বাদে জীবনপুর নামটি প্রচলিত।
ধুলোভরা পথে হাঁটতে লাগলাম। ছোটো বাচ্চাগুলো রাস্তার ওপর খেলা করছে। পরিষ্কার ঝকঝকে মাটির বাড়ি দুপাশে। দেয়ালে রঙিন কারুকার্য করা একটি বাড়িতে ঢুকলাম। নিত্য প্রয়োজনীয় সামান্য কয়েকটা জিনিস, কিন্তু কি গোছানো সংসার। পঁচিশ-তিরিশ বছরের এক সাঁওতাল বধূ। আমাদের হঠাৎ আগমনে একটু আড়ষ্ট বোধ করছে মনে হল।
‘তোমার কয়টি সন্তান?’ একজন প্রশ্ন করল।
‘একটা বটে।’
‘কত বড়ো?’
‘ছয় ক্লাসে পড়ে’ – মেয়েটি উত্তর দিল।
‘একটি কেন? আর নেওনি?’ – আবারও প্রশ্ন ধেয়ে আসে।
মেয়েটি উত্তর দেয়– ‘না একটাই ভালো।’একটু থেমে বলল, ‘অ্যাত্তা পয়সা কুথায় পাবো, একটাকে তবু মানুষ করা সহজ বটে।’
অখ্যাত অজ পাড়াগাঁয়ের এক সাঁওতাল রমণী, হয়তো সারা জীবনে স্কুলের চৌকাঠ মাড়ানোর সুযোগ পায়নি, সভ্যজগৎ ও উন্নত সংস্কৃতি থেকে মাইলের পর মাইল দূরে, শহর বলতে যার ধারণা মুরাডি পর্যন্ত সীমিত, এরকম একজন পেছনের সারির মহিলার কাছে এমন বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর শুনে আমি থমকে গেলাম। আমি নিশ্চিত নই আমার পাড়ার সবকটা বাড়ি ঘুরলেও এমন ভাবনার প্রকাশ বা সমর্থন পাব কিনা!
কেউ উঠানে বসে বড়ো কড়াইতে ধান সেদ্ধ করছে, কেউবা দাওয়ায় বসে হুঁকো টানছে, কেউ গেরস্থলির নিত্য কর্মে ব্যস্ত। পুরুষ ও মহিলাদের বিভিন্ন দৈনিক কাজ দেখতে দেখতে এগিয়ে চললাম। কিন্তু এই ব্যস্ততার মাঝেও আথিতেয়তার বিন্দুমাত্র অভাব নজরে পড়ল না। কখনও চা, জল খাওয়ার অনুরোধ, আবার কখনও তাড়াহুড়োয় গাছ থেকে পাড়া কুল হাতে গুঁজে দেওয়া, সবকিছুই মনে গেঁথে রইল।
আমাদের দেরি দেখে ড্রাইভার গ্রামের ভেতরে গাড়ি নিয়ে চলে এলেন। বললেন ‘চলুন, এরপর অন্ধকার নেমে এলে আর কিছুই দেখা হবে না।’জীবনপুর গ্রাম ছেড়ে এগিয়ে গেলাম ছোট্ট বড়ন্তি ড্যামটির দিকে। হাঁ করে রাস্তার দুপাশে তাকিয়ে আছি। মুগ্ধ হয়ে দেখছি, চারিদিকে শুধু লাল আর লাল পলাশ। ড্রাইভার দাদা বললেন, ‘আপনাদের এবার পলাশের বনে নিয়ে যাব। আহা!
‘পিন্দারে পলাশের বন
পালাবো পালাবো মন।’
সূর্য দিগন্তের কাছাকাছি চলে এসেছে। যেখানে নামলাম সেখানে অন্য গাছ বিশেষ একটা নেই। কেবলই কিংশুকের মাহাত্ম্য দিকে দিকে। গাছগুলি ফুলে ঠাসা। প্রকৃতি যেন গেরুয়া আবিরে আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে। পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ, ওপর-নীচ যেদিকেই তাকাই শুধুই পলাশ আর পলাশ। গাছগুলি একটু নাড়া দিলেই ঝুপঝুপ করে ফুলের বৃষ্টি হচ্ছে। মনে হল স্বর্গের অমরাবতী-বাটিকা। দেবতারা বুঝি পুষ্প বৃষ্টি করছেন। সূর্যদেব বন পলাশে গা ঢাকা দিলেন। এই গোধূলি বেলায় এক আশ্চর্য অনুভবে প্রাণ মন ভরে গেল। ফিরে চললাম বড়ন্তি লেকের দিকে।
মেঠো পথ ধরে অন্ধকার নেমে এল। হোটেলে ফিরে দেখলাম সামনের গ্রামের বাচ্চা মেয়েগুলো আমাদের জন্য পলাশ ফুলের মালা গেঁথে রেখে গেছে। এই হোটেলের ভিতরটা বেশ সাজানো-গোছানো। পুরো ক্যাম্পাস জুড়ে বিভিন্ন বৈদ্যুতিক আলো লাগানো আছে। গ্রামেও বিদ্যুৎ আছে। কিন্তু বাকি পুরো অঞ্চলটি ঘুটঘুটে অন্ধকার।
ঘড়ি দেখলাম– প্রায় আটটা বাজে। হঠাৎ মাদলের শব্দ কানে এল। খুব কাছেই কোথাও বাজাচ্ছে। খানিক বেজে থামল… আবার বেজে উঠল। দোতলার বারান্দায় এসে দেখার চেষ্টা করলাম, কিন্তু মিশমিশে অন্ধকারে কিছুই দেখা গেল না। এক নাগাড়ে বেজে চলেছে। এবার থাকতে না পেরে প্রায় দৗড়ে গেটের বাইরে বেরোলাম। কিছুই বুঝতে পারছি না। আমাদের পাশের ঘরের দুজনও বেরিয়ে এসেছেন। প্রত্যেকেই কৗতুহলী।
গ্রামের সামনের রাস্তায় ঝাপসা আলো। ঠাহর করলাম কয়েকজন সাঁওতাল মেয়ে নাচের সাজে বেশ পরিপাটি করে সেজেছে। এবং আমরা কিছু জিজ্ঞাসা করবার আগেই অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল। মাদলের শব্দও ধীরে ধীরে মৃদু হচ্ছে।
বাইরে হালকা ঠান্ডা, হিম পড়ছে, কিন্তু রুম থেকে সোয়েটার আনতে গেলে দেরি হয়ে যাবে। মোবাইলটাও আনতে ভুলে গেছি। মাদলের শব্দ লক্ষ্য করে আমরা কজন অন্ধকারেই হাঁটতে লাগলাম। নিজের গা পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছি না। মনে হল কে যেন দৗড়ে এসে হাতটা ধরল। নরম ছোটো দুটি হাত!
‘কে রে– কেয়েল?’
‘হ্যাঁ দিদি। সেই ছোট্ট মেয়েটি।
অন্ধকারে দেখতে পাওয়াটা একটা অভ্যাসের ব্যাপার। ওর কাছেই জানলাম পলাশবাড়িতে আজ সাঁওতাল নাচের আয়োজন হয়েছে। ওরা ওখানেই যাচ্ছে। ‘চলো তোমাদের নিয়ে যাচ্ছি – বাচ্চা মেয়েটি বলল।
সাঁওতাল গান এবং মাদলের তালে তালে নাচের অদ্ভূত ছন্দ এসবই উপরি পাওনা। একটু আগে পর্যন্ত জানতাম না যে এমন সাঁওতালি নাচ চাক্ষুষ করব। এ যেন ষোলোকলা পূর্ণ হল। মন ও শরীর নেচে উঠল তালে তালে। কোয়েলের কাছে নাচের কয়েকটা স্টেপও শিখে নিলাম। নিকষ কালো আকাশে অসংখ্য তারার সাথে আমরাও সাক্ষী হয়ে রইলাম এই অপূর্ব সুন্দর মুহূর্তের।
ফাগুনের আগুনে, বসন্তের শিহরণে, পাহাড়ের নির্জনতায়, নিস্তরঙ্গ দিঘির পড়ন্ত সৗন্দর্যে, গ্রাম্য আথিতেয়তায়, সাঁওতাল বালিকাদের সারল্যে আর ভালোবাসায় দুটো দিন সত্যিই উৎসবের মতো কেটে গেল। এই নির্মল আনন্দ নিয়ে কাল কোলাহলময় রুটিন জীবনে ফিরে যাওয়ার পালা।
বড়ন্তি থেকে বেশ কয়েকটি জায়গা ঘুরে দেখা যায়। গাড়ি ভাড়া করে যাওয়া যায় প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত গড়পঞ্চকোটে। নির্জন, গাঢ় সবুজের মাঝে পঞ্চকোট পাহাড়ে কাটানো যায় কিছুক্ষণ। বর্গীদের আক্রমণে ধবংস হয়ে যাওয়া কাশীপুর রাজার তৈরি দুর্গের ধবংসাবশেষ এবং মন্দির দর্শন করে চলে যাওয়া যায় পাঞ্চেৎ ড্যাম দেখতে। যাওয়া যায় প্রায় ২১ কিলোমিটার দূরের জয়চণ্ডী পাহাড়ে। এখানেই সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত ছবি হীরক রাজার দেশের কয়েকটি দৃশ্য চিত্রায়িত হয়েছিল। এছাড়া যাওয়া যায় মাইথন জলাধার এবং কল্যাণেশ্বরী মন্দিরে (দূরত্ব প্রায় ৩৮ কিলোমিটার)। বড়ন্তি থেকে বিহারিনাথ পাহাড়ের দূরত্ব প্রায় ২৫ কিলোমিটার এবং শুশুনিয়া পাহাড় ৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
তবে আর দেরি কেন? এই বসন্তেই পাড়ি দেওয়া যাক লাল মাটি আর পলাশের দেশে।
কীভাবে যাবেন – হাওড়া থেকে ট্রেনে আসানসোল। আসানসোল থেকে আদ্রা লাইন ধরে ট্রেনে বার্নপুর, দামোদর, মধুকুণ্ডা হয়ে পরবর্তী স্টেশন মুরাডি। মুরাডিতে নেমে গাড়ি করে বড়ন্তি (দূরত্ব ৬ কিমি)। আসানসোল থেকে সরাসরি গাড়ি করেও মুরাডি যাওয়া যায়। দূরত্ব প্রায় ৪৫ কিলোমিটার, কম বেশি এক ঘন্টায় পৌঁছে যাওয়া সম্ভব। তবে মুরাডিতে গাড়ির ব্যবস্থা সুবিধাজনক নয়। তাই হোটেলে আগে থেকে বললে ওনারাই গাড়ি পাঠিয়ে দেন।
কোথায় থাকবেন – বড়ন্তিতে থাকার অনেক হোটেল আছে।
কখন যাবেন – বছরের যে কোনও সময় বড়ন্তি যাওয়া যেতে পারে। তবে বসন্তে বড়ন্তির রূপ ও সৗন্দর্য আরও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে।