কালিম্পং জায়গাটা একদিকে সিকিমের , অন্যদিকে দার্জিলিং ও শিলিগুড়ি যাওয়ার ত্রিবিধ পথের সন্ধি। এর ফলে ব্রিটিশ আমলের আগে থেকেই ব্যাবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এর ভৌগোলিক গুরুত্ব ছিল যথেষ্ট। দার্জিলিং থেকে ৫৩ কিলোমিটার দূরের শহরটা এখন জেলায় উত্তীর্ণ। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে অন্তর্ভুক্তির আগে কালিম্পং,ভুটান রাজ্যের অধীনে ছিল। বেশ কিছু পুরোনো বৌদ্ধ মনেস্ট্রি রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। নাথুলা ও জিলেপ-লা পাস থেকে দূরত্ব বেশি নয়। জুলুক থেকে চার ঘণ্টা। সিল্ক রুট ঘুরতে চাইলে কালিম্পং থেকেই শুরু করা যায়।
একসময় ভারত ও তিব্বতের মধ্যে রেশম ছাড়াও অন্যান্য পণ্যেরও বাণিজ্যিক আদান-প্রদান হতো।এখন পর্যটকের কাছে অন্যতম ব্যস্ত শৈলশহর। তবে গাড়ি স্ট্যান্ড এলাকাটা যেমন নোংরা তেমন ঘিঞ্জি। মূল শহর থেকে একটু বাইরে না এলে পাহাড়ের সৗন্দর্যের কণামাত্র ধরা পড়ে না। দার্জিলিং যাওয়ার প্ল্যান থাকলেও, দুটো দিন কালিম্পং-এ কাটাতে মন্দ লাগে না। একটা গাড়ি ভাড়া করে দিনে দিনে দেখে ফেলা যায় কালিম্পং-এর দ্রষ্টব্য।
হনুমান টক
কলিম্পং-এর হনুমান টক, বস্তুত রামধুরা অঞ্চলেই। ঠিক মন্দির নয়, একটা টিলার মাথায় হনুমানের বিশাল কমলা রঙের মূর্তি। সিঁড়ি দিয়ে বা ঢাল বেয়ে ওঠা যায়। পুজো দেওয়ার ঝক্বি নেই। কেউ চাইলে দক্ষিণা দিতে পারে। আসলে এই হনুমান টকও একটা ভিউ পয়েন্ট। এখান থেকেও নীচের দিকে তিস্তা আর উত্তর-পূর্বে কাঞ্চনজঙ্ঘা চোখে পড়ে।
দেওরালি আর্মি ক্যাম্প
আদৌ কোনও দ্রষ্টব্য হিসাবে কোথাও উল্লিখিত নয়। কিন্তু বার্মিক এলাকায় সাইট সিইং করতে গিয়ে যা দেখলাম, তার তুলনায় এই সেনা ছাউনিকে বেশি মনে ধরল। গাছের গুঁড়িগুলোর গায়ে সাদা চুনকাম যেন তাদের গায়ে ইউনিফর্মের মতো শোভিত। সেনা সর্বত্র সেরা জায়গাটা বেছে নেয় আর সেটা তদারকি করে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে। তাই অবিন্যস্ত, নোংরা অঞ্চলেও স্থায়ী ক্যান্টনমেন্ট হোক বা অস্থায়ী শিবির, মিলিটারি অধিকৃত জায়গাগুলো মনোরম লাগে। এই অভিজ্ঞতা ভুটান, সিকিম, শিলিগুড়ি এমনকী আমাদের ব্যারাকপুর, কাশীপুরেও। গাড়ি অবশ্য দেওরালি থামল না। এগিয়ে চললাম ডেলোর দিকে।
ডেলো
কালিম্পং জেলার সবচেয়ে সুন্দর জায়গা নিঃসন্দেহে ডেলো পাহাড়ের মাথায় রিসর্ট ও তার ৮ একর জোড়া বাগান। রাজ্য সরকারের পর্যটন দফতরের এই আবাসনে বুকিং পাওয়া সহজ নয়। উচ্চতা ৫৬০০ ফুট। ডেলোতে ওঠার মুখে সায়েন্স সেন্টার যা সোমবার বন্ধ থাকে বলে দেখা গেল না। ২০ টাকার টিকিট কেটে প্রবেশ করলাম। বাগানে দাঁড়িয়ে পাইন বনও দেখতে দারুণ লাগে। প্যারাগ্লাইডিং-এর ব্যবস্থা আছে। কিন্তু মূল্য অস্বাভাবিক লাগাতে রোদ ঝলমলে অনুকূল পরিবেশেও ইচ্ছা সংবরণ করতে হল। ১০-২০ মিনিটের উড়ানের জন্য ৩০০ টাকা যা কিনা সেদিন ছাড় দিয়ে ২৫০০ টাকায় দেওয়া হচ্ছিল। টিকিট কাউন্টারে কম্পিউটারে ছবি দেখিয়ে বুঝিয়ে দিল কী ভাবে পাইলটকে পেছনে নিয়ে উঠতে হবে। আর হাওয়ার মর্জিমাফিক অবতরণ ডেলোতেও হতে পারে অথবা কিছু দূরে একটা স্কুলের মাঠেও হতে পারে যেখান থেকে গাড়ি করে নিয়ে আসা হবে।
আমরা বরং দু চোখ ভরে আবার কাঞ্চনজঙঘাই দেখলাম। শুধু তাকেই নয়, চোখে পড়ল নাথুলার তুষার চূড়াগুলোও। ঠিক কতটা কাঞ্চনজঙঘা, আর কোনটা অন্য পাহাড় খালি চোখে দেখে ঠাওর করা যাচ্ছিল না। একমাত্র ইয়ুমথাং ও জিরো ছাড়া দার্জিলিং, গ্যাংটক বা পেলিং থেকে এতটা লম্বা তুষারশৃঙ্গের সারি আগে দেখিনি। খানিকক্ষণ ঘুরেফিরে বসে যখন ফিরছি, তখন পর্যটকদের সমাগম বাড়তে শুরু করেছে।
রক গার্ডেন ও বুদ্ধ মূর্তি
ডেলোর কাছেই ছোটো পাথুরে বাগানের মাঝখানে বুদ্ধমূর্তি। ভেতরে ঢুকিনি, বাইরে থেকে ছবি তুলে আবার গাড়িতে উঠে পড়লাম।
শেরপা ভিউ পয়েন্ট
এখান থেকে উত্তর ও দক্ষিণে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। কাঞ্চনজঙ্ঘা ছাড়াও রেলি নদী ও উপত্যকা এবং লোলেগাঁও অঞ্চল চোখে পড়ে। জায়গাটা ভালো ভাবে রক্ষণাবেক্ষণ হয় না, তবে সম্ভব হলে দেখে নিন। আমরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ি দেখতে চাই শুনে সেদিকেই ছুটল গাড়ি। রাস্তায় পড়ল পাইন ভিউ নার্সারি।
টেগোর হাউস
ঠাকুর বললে অবাঙালিরা উত্তর ও মধ্য ভারতের ঠাকুর সম্প্রদায়কে বোঝে। ইংরেজদের বিকৃত উচ্চারণের ‘টেগোর’ দিয়েই সবাই রবি ঠাকুরকে চেনে। কী আর করা যাবে? রবীন্দ্রনাথের বাড়ি বলে একটা ভূতুড়ে জায়গায় গাড়ি এসে দাঁড়াল। রাস্তা থেকে অনেকটা নীচে কর্দমাক্ত পথ বেয়ে নেমে গিয়ে যার সামনে হাজির হলাম সেটাকে হানাবাড়ি বলাই যেত, যদি না দু-একজন মানুষকে ভেতরে ঢুকতে বেরোতে দেখতাম। ওদের কাউকেই তো ঠাকুরবাড়ির বংশধর বলে মনে হল না। নেটে পড়ে ফেসবুকে বন্ধুদের পোস্ট দেখে রবি ঠাকুরের ব্যবহৃত আসবাব, পড়ার টেবিল, বইপত্রের যে ছবিটা মনে নিয়ে এসেছিলাম, তার সঙ্গে মেলাতেই পারলাম না। ড্রাইভার ভুল করেছে ভেবে উঠে আসছিলাম। দেখা হল এক অবাঙালি মহিলার সঙ্গে। আমাদের উদ্দেশ্য জেনে নিজেকে কেয়ারটেকার পরিচয় দিয়ে ফের পাকড়াও করে নিয়ে এলেন বাড়িটার কাছে।
যে-দিকটা পেছন দিক ভাবছিলাম, সে দিকেই আসলে বাড়ির সদর দরজা, যার পাশে শ্বেত পাথরের ফলকে লেখা, এই বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন যিনি আকাশবাণীতে কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন। ভেতরে ধূলিধূসরিত ঘরে দরজার ওপর রঙিন কাচ দেখে খুব কষ্ট করে বাকি ছবিটা কল্পনা করতে হল। বড়ো দুটো ঘরে ফায়ার প্লেস রয়েছে। মহিলা খুব উৎসাহ নিয়ে বাংলা হিন্দি মিশিয়ে তার ও ওই বাড়িটার সমস্যা বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন। ভাঙাচোরা বাড়িটির পাশে একটা পলিটেকনিক কলেজ নির্মাণের কাজ চলেছে।
পরে শিলিগুড়িতে এই ভ্রমণকাহিনি লিখতে বসে দেখলাম পথে ফেলে আসা পাইন ভিউ নার্সারির পাশেই আছে ১৯৪৩ সালে তৈরি রবীন্দ্রনাথের পুত্রবধূ প্রতিমাদেবীর সুরম্য বাড়ি। আর সেটিতেই রবি ঠাকুরের বেশ কিছু স্মৃতিচিহ্ন সযত্নে রক্ষিত আছে। আমাদের সারথি কেন সেখানে না থেমে সোজা এই পরিত্যক্ত বাড়িটার সামনে হাজির করেছিল কে জানে?
ডার্পিন মনেস্ট্রি
ডার্পিন পাহাড়ের ওপর এই বিহার তৈরি হয় ১৯৭২ সালে। আসল নাম ‘জাং দোগ পালরি মনেস্ট্রি’ । তিব্বত থেকে দালাই লামার আনা বেশ কিছু দুষ্প্রাপ্য পুঁথিপত্র সংরক্ষিত আছে এখানে। এখান থেকেও কাঞ্চনজঙঘার পটভূমিতে কালিম্পং-এর দৃশ্য চোখে পড়ে। নীচের দিকে তিস্তা ছাড়াও রিয়াং নদী, আর এক পাশে পেশোক চা বাগান। স্বীকার না করে উপায় নেই, সিঙ্কোনা রোপনের চেয়ে চা বাগান অনেক সুন্দর যা বহুবার দেখেও পুরোনো হয় না।
তবে কালিম্পং-এর সবচেয়ে পুরোনো বিহার ১৬৯২ সালে নির্মিত থোংসা গোম্পা ড্রাইভারকে বলে রাখিনি বলে দেখা হয়নি। এর কাছাকাছি ‘মঙ্গলধাম’ নামে কৃষ্ণমন্দিরেও ভক্ত ও পর্যটক সমাগম হয়ে থাকে। এছাড়াও দর্শনীয় জিলেপ-লা ভিউ পয়েন্ট, আর্মি গল্ফ কোর্স, মরগান হাউস, নেচার ইন্টারপ্রিটেশন সেন্টার, পাইনভিউ নার্সারি ইত্যাদি যেগুলো সময় ও পরিকল্পনার অভাবে আমাদের দেখা হয়নি। যারা বার্মিক অঞ্চল বেড়াতে চান, তাদের উদ্দেশ্যে বলি, একটা গোটা দিন কালিম্পং-এর জন্য বরাদ্দ রাখলে ও গাড়ির সঙ্গে সেই মতো কথা বলে রাখলে ঠকবেন না।
গাড়ি যখন আমাদের বাস বা গাড়ি স্ট্যান্ডে ছেড়ে দিল, তখন দুপুর ১টায়। কিছু শুকনো খাবার কিনে সোজা শিলিগুড়ি রওনা হওয়াই স্থির করলাম।
প্রয়োজনীয় তথ্য
শিয়ালদা, হাওড়া ও কলকাতা স্টেশন থেকে পছন্দসই ট্রেন ধরে নিউ জলপাইগুড়ি চলে আসুন। স্টেশন চত্ত্বর থেকেই কালিম্পং যাওয়ার গাড়ি ভাড়া পেয়ে যাবেন। শিলিগুড়ি থেকে যাত্রা করলে পানি টাঙ্কির মোড়ে এসে গাড়ি ধরতে পারেন। হোমস্টেগুলোর নিজস্ব গাড়ি পরিষেবা আছে। তবে কালিম্পং পৗঁছোনোর পর গাড়ি নিলে সাশ্রয় হয়। সিলেরি গাঁও যেতে হলে বড়ো চাকার মহিন্দ্রা জিপ, ল্যান্ডরোভার, টাটা সুমো বা বোলেরো – যেটা পাওয়া যাবে ভাড়া নিতে হবে। ছোটো চাকার গাড়ি যেতে চাইবে না।
মন চাইলে ও সময় থাকলে একাধিক জায়গায় ভাগাভাগি করে থাকতে পারেন। লাভা-লোলেগাঁও-রিশপ, নেওরা ভ্যালি ও সিল্করুট ভ্রমণের জন্য ইন্টারনেট থেকেও সাহায্য পেতে পারেন। একাধিক টুর অপারেটরের হদিশ ইন্টারনেট থেকে পেয়ে যাবেন।
সঙ্গে রাখুন রোজকার ওষুধ ছাড়াও জ্বর, পেটের অসুখ, হজম, অ্যালার্জি বা ঠান্ডা লাগার ওষুধ-পত্র সঙ্গে রাখুন। বার্মিকের মানুষ জ্বর-জ্বালায় সিংকোনা গাছের ছাল জলে ফুটিয়ে সেই জল পান করে। কোনও ওষুধের দোকান দেখিনি। বর্ষাকাল না হলেও ছাতা সঙ্গে রাখা ভালো।