চিড়চিড়ে গরম। কোনওরকমে বাজারের থলে সামলে হাঁটছেন মধুশ্রী। সঙ্গে ছাতা নেই, ভুলে গেছেন আনতে। হাত দিয়ে ঘাম মুছতে হচ্ছে বারবার। বাজারের থলেটা খুব ভারী ছিল না কিন্তু জুন মাসের অসহ্য গরমে রোদের মধ্যে ছাতা ছাড়া হাঁটতে খুব কষ্ট হচ্ছিল মধুশ্রীর। অটোরিক্সা স্ট্যান্ড খুব দূরে ছিল না, তাই অটো ধরার আশায় কিছুটা হেঁটে এগিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু হঠাৎই মাথা ঘুরতে শুরু করল। নিজেকে সামলে নেওয়ার আগেই ধাক্কা খেলেন বিদ্যুতের স্তম্ভে। আচমকা ধাক্কার জেরে রাস্তায় পড়ে গেলেন মধুশ্রী। তাঁর হাতের বাজারের থলি ছিটকে গিয়ে পড়ল অন্যদিকে।
ভিড় জমে গেল মুহূর্তেই।
বুঝলাম না কীভাবে পড়ে গেল! হয়তো মাথা ঘুরে গেছে।
চল, হাসপাতালে নিয়ে যাই। মনে হচ্ছে সেন্সলেস।
ভিড়ের ভেতর থেকে এমনই কিছু কথা ভেসে এল। কিন্তু কেউ দাযিত্ব নিয়ে মধুশ্রীকে তার বাড়ি কিংবা হাসপাতালে নিয়ে গেল না।
ভিড় দেখে সাদা রঙের চলমান এক গাড়ি রাস্তার ধারে দাঁড় করালেন গাড়ির যাত্রী। গাড়ি থেকে নেমে এলেন লম্বা চওড়া এক ব্যক্তি। ভিড় ঠেলে এগিয়ে দেখলেন মধুশ্রীর সংজ্ঞাহীন অসহায় অবস্থা। কী হয়েছে জেনে নিলেন ভিড়ের জনতার থেকে এবং আর দেরি না করে, তাঁর গাড়ির চালকের সাহয্যে গাড়িতে তুললেন মধুশ্রীকে।
এখানে কাছাকাছি কোনও হাসপাতাল আছে ভাই? একজনকে জিজ্ঞেস করলেন সেই ব্যক্তি।
হ্যাঁ স্যার, সামনের মোড় থেকে ডানদিকে একটু এগোলেই একটা নার্সিংহোম আছে।
গাড়ি দ্রুত এগিয়ে গেল নার্সিংহোম-এর উদ্দেশে।
হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছেন মধুশ্রী। স্যালাইন চলছে। কিছুক্ষণ পর হুঁশ ফিরল তাঁর। নার্স তাঁকে জানাল সবকিছু। শরীর কিছুটা কমজোর মনে হলেও মধুশ্রীর ইচ্ছে হল উঠে গিয়ে সেই মহানুভবকে ধন্যবাদ জানাতে, যিনি তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু মধুশ্রীকে যেতে না দিয়ে নার্স নিজেই ডেকে আনলেন ওই ব্যক্তিকে।
কেমন আছেন এখন? ডক্টর জানিয়েছেন, ভয়ের কিছু নেই। একটু পরেই ডিসচার্জ করা হবে আপনাকে। ঘরে ঢুকে মধুশ্রীকে আশ্বস্ত করলেন ওই ব্যক্তি।
উপকারী মানুষটির জন্য বিনয়ে মন ভরে গেল মধুশ্রীর।
আপনি আমার জন্য অনেক কিছুই করলেন। আপনাকে কীভাবে যে ধন্যবাদ জানাব, ভেবে পাচ্ছি না!
এসব ভেবে বিচলিত হবেন না। মানবিকতাই সবচেয়ে বড়ো ধর্ম। আমি শুধু ধর্ম পালন করেছি মাত্র। যাইহোক, আপনাকে একটা কথা বলতে চাই। ডক্টর জানিয়েছেন, আপনার ব্লাড সুগার-এর সমস্যা আছে। ঠিকমতো চিকিৎসা করে আয়ত্তে রাখবেন, নয়তো বিপদ হতে পারে।
সম্মতিসূচক মাথা নাড়ালেন মধুশ্রী। তিনি জানতেন, ভুল করেছেন। সকালে সুগারের ওষুধ খেতে ভুলে গেছেন। তার উপর আবার রোদে হেঁটেছেন। ফলে সুগার লেভেল কমে গিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে যান। এই ঘটনায় বেশ অস্বস্তিতে পড়েন মধুশ্রী। ভাবতে থাকেন, তাঁরই ভুলের জন্য একজন অচেনা লোক সব কাজ ফেলে কষ্ট করলেন। কিন্তু যার প্রতি মধুশ্রী এত কৃতজ্ঞ, সেই মানুষটি তাঁর মহানুভবতার তালিকা আরও দীর্ঘ করলেন। নিজের গাড়ি করে মধুশ্রীকে তাঁর বাড়ি পেঁছে দিলেন। কিন্তু মধুশ্রী তাঁকে এক কাপ চা-ও খাওয়াতে পারলেন না। এমনকী তাঁর নাম কিংবা মোবাইল নম্বরটাও নিতে ভুলে গেলেন।
কিছুক্ষণ বাদে মেয়েকে ফোন করতে গিয়ে মধুশ্রী দেখলেন, অনেক মিসড কল। মোবাইলটা পার্স-এর মধ্যেই ছিল।
মধুশ্রী ফোন তোলেননি বলে সোমা খুব চিন্তায় ছিল। হঠাৎ ফোন-এ পেয়ে প্রশ্নের ঝড়। কথা বলতে বলতে সোমা জানাল, মধুশ্রীকে আর কিছুক্ষণ ফোনে না পেলে সে বিকাশকে ফোন করত।
ভাগ্যিস তুই বিকাশকে ফোন করিসনি, এতদূরে থাকে বিকাশ, বেচারা দুশ্চিন্তায় থাকত।
মা, তুমি কী ভাবো, আমরা তোমাকে ফোন-এ না পেলে ঠিক থাকতে পারি? আমি একটু পরেই সুমিতকে বলে গাড়ি নিয়ে তোমার খোঁজে যেতাম।
একজন অচেনা লোক কীভাবে মধুশ্রীকে বিপদের থেকে বাঁচিয়েছেন, পুরো ঘটনার বিবরণ সোমাকে জানালেন মধুশ্রী।
মা-কে সোমা জানাল, থ্যাংক গড, ভদ্রলোক এতবড়ো উপকার করলেন তাই, নয়তো যে কী হতো! মুম্বই থেকে কলকাতা তো খুব কাছে নয়, তোমার কাছে পেঁছোতে আমার বেশ সময়-ই লাগত। মা, তুমি সুস্থ আছো এটাই বড়ো খুশির খবর। কিন্তু এবার থেকে আর ভুল করবে না, ঠিক সময়ে ওষুধ খাবে। নয়তো আমি দাদাকে বলে দেব যে, তুমি নিজের খেয়াল রাখছ না।
মধুশ্রীর ছেলে বিকাশ, বউ-বাচ্চা নিয়ে বিদেশে থাকে। আগে প্রায় প্রতিদিন-ই ফোন করে মায়ের খবরাখবর নিত। কিন্তু এখন হয়তো মাসে একবার ফোন করে। মধুশ্রী নিজেকে সান্ত্বনা দেন যে, সাত সমুদ্র তেরো নদী পার করে থাকে ওরা, কাজের চাপে হয়তো সময় পায় না ফোন করতে, কী আর করা যাবে!
হার্টের অসুখে অকালে স্বামী মারা যাওয়ার পর কলেজে লাইব্রেরিয়ান-এর চাকরি পেয়েছেন মধুশ্রী। ওটাই এখন তাঁর আর্থিক এবং মানসিক অবলম্বন। কিন্তু তবুও মাঝেমধ্যে বেশ অসহায় এবং একাকিত্ব বোধ গ্রাস করে মধুশ্রীকে। স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখে-শান্তিতে সংসার করার সেই দিনগুলি স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে প্রায়শই। অ্যালবাম খুলে পুরোনো ছবিগুলি দেখতে দেখতে দু-চোখ ভারাক্রান্ত হয়, জলে টইটুম্বুর হয়ে ওঠে।
ছেলে বিকাশ আর বউমা মৌমিতা কানাডায় সংসার পেতেছে। ওদের দুই মেয়ে বড়ো হচ্ছে বিদেশি আবহে। মধুশ্রী অবশ্য দুবার গিয়ে ওদের সঙ্গে থেকে এসেছেন। ছেলে এবং বউমা দুজনে চাকরি করে। ওদের জীবনযাত্রা, পোশাক, চালচলনে এখন বিদেশি ছাপ। এসব মধুশ্রীকে খুব ভাবিয়েছে। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর ছেলে-বউ আর নাতনিরা ভারতীয় সংস্কৃতিকে আপন করে নিক কিন্তু তা হল না। অনেক চেষ্টা করেও বিফল হয়েছেন। শুধু তাই নয়, তিনি প্রাচীন পন্থী, ব্যাক ডেটেড ইত্যাদি আখ্যাও দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, এটা ভারত নয়, কানাডা। এখানে যা চলে তা-ই আপন করে নিতে হবে। মধুশ্রী চুপ করে যান। ভালো-খারাপের তফাত বুঝিয়ে আর উপহাস-এর শিকার হতে চাননি।
উইক এন্ড-এ বন্ধুদের নিয়ে ক্লাব-এ পার্টি করতে চলে যায় ছেলে-বউমা। মধুশ্রীর সঙ্গে দুদণ্ড বসে কথা বলার সময় কোথায়! ঠান্ডার দেশের লোক হয়তো এমনই ঠান্ডা থাকে। দরজার বাইরে জমে থাকা বরফ দেখে মধুশ্রী আরও উদাস হয়ে পড়তেন। বাড়ির বাইরে গিয়ে প্রতিবেশীদের সঙ্গে বসে দুচারটে কথা বলারও উপায় নেই ওখানে। সবাই এক ছাদের তলায় থেকেও যেন পরস্পরের মধ্যে যোজন দূরত্ব। সবকিছু যেন যন্ত্রের মতো চলছে ওখানে। এসব দেখে ভিনদেশে আর মন টেকেনি মধুশ্রীর। নিজের দেশ হাতছানি দিতে থাকে তাঁকে। ফিরে আসেন আপন দেশে।
ছেলে বিকাশ অবশ্য অনেকবার-ই মা-কে আবার নিজেদের কাছে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে কিন্তু মধুশ্রীর মন ওঠেনি।
না না, তোমাদের ব্যস্ত জীবন, কাজকর্ম নিয়ে থাকো, আমি তোমাদের সঙ্গে থাকলে অসুবিধা হবে। তাছাড়া, সারাদিন বাড়িতে একা একা সময় কাটানো বিরক্তিকর মনে হবে আমার কাছে। এর থেকে আমার চাকরি নিয়ে ব্যস্ত থাকা ভালো।
এভাবেই সেদিনের কথাগুলি মনে পড়ে যায় মধুশ্রীর। আর মনে পড়ে বন্ধু পামেলার কথাগুলো। পামেলা বলত, দূর থেকেই সবকিছু ভালো লাগে। কিন্তু বিদেশে গিয়ে থাকতে পারলে কি সব সুখ পাওয়া যাবে?
পামেলার একথা শুনে মধুশ্রী বলেছিলেন, ছেলে-বউমারা সেখানে থাকে, ওদের জন্য ঠিক আছে। আমাদের মতো বুড়িদের কানাডায় থাকা মানায় না।
মধুশ্রীর বুড়ি হয়ে যাওয়ার কথা শুনেই পামেলা সঙ্গে সঙ্গে জোরালো প্রতিবাদ করে। তুই নিজেকে বুড়ি ভাবতে পারিস, কিন্তু আমি নিজেকে বুড়ি ভাবি না। বলেই দুজনে হো হো করে হেসেছিল সেদিন। এভাবেই চলতে থাকে ওদের কথোপকথন। দৈনন্দিন ঝামেলা থেকে শুরু করে কলেজে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে ঘুরে বেড়ানোর কথা উঠে আসে আলোচনায়।
পুরোনো কথা ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে পড়েন মধুশ্রী। সম্বিত ফিরে পেয়ে আবার চোখ রাখেন বইয়ের পাতায়। স্বামীকে হারানোর পর এই বই-ই তাঁর অবসর যাপনের সম্বল। তেমন কোথাও যাওয়ার নেই। তাই লাইব্রেরি থেকে বই তুলে এনে পড়ার অভ্যাস তৈরি করেছেন মধুশ্রী। বলতে গেলে, তাঁর বেঁচে থাকার দুনিয়াটা অনেক ছোটো হয়ে গেছে। সন্তানদের যোগ্য করে তুলতে গিয়ে কখন বার্ধক্য নেমেছে শরীরে, টের পাননি, বেলা শেষের দিনগুলিতে সেই সন্তানরাই পাশে নেই। তাই ধীরে ধীরে গ্রাস করছে একাকিত্ব। অবশ্য এই একাকিত্ব মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায়ও নেই। কারণ, এর জন্য তো ছেলেকে দোষারোপ করা যায় না, এ তো যুগের হাওয়া।
বিদেশে গিয়ে চাকরির বাসনা শুধু বিকাশের ছিল এমন নয়, মা মধুশ্রীও মনে মনে তাই চাইতেন। কারণ, ছেলের সাফল্যে তিনি গর্বিত ছিলেন। দুই সন্তানের ভবিষ্যত্ গড়ার জন্য অনেক ত্যাগ শিকারও করেছেন তিনি। বাবার অবর্তমানেও সন্তানরা কোনও রকম চাহিদা পূরণের অভাব অনুভব করেনি। ছেলে বিকাশ আর মেয়ে সোমা যখন কলেজে পড়ত, তখন তো মধুশ্রী নিজের জন্য আলাদা কোনও সময় বের করতে পারতেন না। সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকতেন ছেলেমেয়েকে নিয়ে। তখন মনে হতো, যেন ওদের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের বাইরে আর কোনও নারীসত্তা নেই তাঁর। কিন্তু আজ মাতৃত্বের জন্য সবকিছু মেনে নিলেও, একজন ব্যক্তিমানুষ হিসাবে মধুশ্রীর মনের কোণে হয়তো দুঃখকষ্টের মেঘ জমে আছে।
ফোনটা হঠাৎ বেজে উঠল। রিসিভ করতেই পামেলার গলা শোনা গেল ও-প্রান্ত থেকে। তাদের বিবাহবার্ষিকীর পার্টিতে মধুশ্রীকে আসার কথা আবারও মনে করিয়ে দিল পামেলা। চিন্তায় পড়লেন মধুশ্রী। আজকাল কোনও হইহুল্লোড়ই যেন ভালো লাগে না তাঁর। কিন্তু প্রিয় বন্ধু বলে কথা, ইচ্ছে না থাকলেও, না গিয়ে উপায় নেই। কারণ, পামেলার মনে কষ্ট দিতে চান না তিনি।
আলমারিতে শাড়ি খুঁজতে খুঁজতে হালকা পলাশরঙা একটা শাড়ি চোখে পড়ল মধুশ্রীর। সধবাদিনের অনেক কথা-ই মনে পড়ে গেল তাঁর। শাড়িটা বের করে পরে ফেললেন। দাঁড়ালেন আয়নার সামনে। হঠাৎ যেন জোয়ার এল শরীর-মনে। বিদ্যুৎ খেলে গেল আপাদমস্তক। মুক্তোর হার-টা পরে নিলেন গলায়। কপালে একটা টিপও পরলেন। হঠাৎ চোখ পড়ল মাথার কালো চুলের ফাঁকফোকরে উঁকি মারতে থাকা সাদা চুলগুলোর দিকে। রঙিন হয়ে ওঠা মনটা হঠাৎই যেন মুষড়ে পড়ল। কিন্তু ওভাবেই তিনি বেরিয়ে পড়লেন পামেলা আর তার বর কর্নেল সাহেবের বিবাহবার্ষিকীর পার্টিতে।
ফুলের তোড়া হাতে নিয়ে ট্যাক্সি থেকে নামলেন মধুশ্রী। পা বাড়ালেন আলো দিয়ে সাজানো অর্কিড বাংলোর দিকে। গেট দিয়ে ঢোকার পর মধুশ্রীর চোখ আটকাল হলুদ অর্কিড ফুলগুলির দিকে। থরে থরে ফুটে থাকা ফুলগুলি সত্যিই এক মোহময়ী আবহ তৈরি করেছে। মধুশ্রীর মনটা বেশ ভালোলাগার আবেশে ভরে গেল।
কর্নেলসাহেব বন্ধুদের সঙ্গে হইহুল্লোড়ে ব্যস্ত ছিলেন। অতিথিদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিলেন দম্পতি। তাদের নিয়ে কর্নেলসাহেব আসর বেশ জমিয়ে তুলেছিলেন। এমন সময় সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলেন মধুশ্রী। যাদের বিবাহবার্ষিকী, সেই পামেলা আর কর্নেলসাহেব মধুশ্রীকে স্বাগত জানানোর আগেই, অন্য একজন এগিয়ে এসে বলে উঠলেন, হ্যালো, কেমন আছেন আপনি? আবার দেখা হয়ে ভালো লাগছে।
প্রথমটা চিনতে না পারলেও, পরমুহূর্তেই বক্তাকে ঠিক চিনতে পারলেন মধুশ্রী। এ তো সেই মানুষটি, যিনি তাঁকে অসুস্থ অবস্থায় রাস্তা থেকে গাড়িতে তুলে নিয়ে গিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলেন।
আরে আপনি? আবার এভাবে হঠাৎ দেখা হয়ে যাবে, ভাবতেও পারিনি!
আমি সুরজিৎ। কর্নেল আমার বন্ধু।
আমি মধুশ্রী। পামেলার বন্ধু।
আসুন, কোথাও বসি। বলেই একটু এগিয়ে গিয়ে দুটো চেয়ার টেনে মধুশ্রীর দিকে একটা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে নিজে অন্যটাতে বসলেন সুরজিৎ।
বসার পর প্রথমে মুখ খুললেন মধুশ্রী। বিনয়ভরা কণ্ঠে বললেন, ওই দিন আপনি এত বড়ো উপকার করলেন, আর আমি আপনাকে এককাপ চা-ও খাওয়াতে পারিনি। আমার খুব আপশোশ হয়েছে পরে।
আপশোশের কথা ছাড়ুন। যখন দেখা হয়ে গেল, চা-পানের সুযোগ তো হবেই আবার। বলেই হাসতে লাগলেন সুরজিৎ।
আবহাওয়া হঠাৎই বদলে গেছে। হালকা হাওয়ায় বেশ একটা আরামের আমেজ অনুভত হচ্ছিল। পাশের মঞ্চে সুমধুর গজল পরিবেশন করে খুশির আমেজকে আরও খানিকটা বাড়িয়ে তুলেছিলেন জনৈক শিল্পী। মধুশ্রী এবং সুরজিতের আড্ডাও চলেছিল অনেকক্ষণ। এরই মধ্যে কখন যে দুজনে বন্ধুর মতো হয়ে উঠেছিলেন, তা তাঁরা নিজেরা বুঝে না উঠলেও সাক্ষী ছিল ওই রাতের আবহ।
এরপর অনেকবারই রেস্তোরাঁয় মুখোমুখি বসে খাবার খেয়েছেন মধুশ্রী এবং সুরজিৎ। সুখ-দুঃখের কথাও বলেছেন অনেক।
সুরজিতের সুন্দর একটি বাগান এবং নার্সারি আছে। অবিবাহিত সুরজিৎ বাগান নিয়ে ব্যস্ত থাকেন সারাক্ষণ। আর ওখানে গিয়ে অনেকবারই আতিথ্য নিয়েছেন মধুশ্রী। সুরজিৎ তাঁকে অনেক ফুলের গাছ উপহার হিসাবেও দিয়েছেন। উপহার পাওয়া সেইসব গাছ এখন ফুলে ভরিয়ে রেখেছে মধুশ্রীর বাড়ির ঘর-বারান্দা।
মধুশ্রী এবং সুরজিৎ দুজনেই প্রায় একা। সুরজিৎ বিয়ে না করে একা আর মধুশ্রী সংসারজীবনে থেকেও একা। আর এই একাকিত্ব দূর করার জন্য দুজনে কখনও রেস্তোরাঁয়, কখনও বাগানে, কখনও আবার লং ড্রাইভ-এ গিয়ে এক অন্য জীবনের সাধ পেয়েছেন।
এভাবেই একদিন মুখোমুখি বসে কথা হতে হতে মধুশ্রী সুরজিত্কে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি বিয়ে করেননি কেন?
ব্যক্তিত্ববান সুপুরুষ সুরজিতের প্রেমে পড়েনি কোনও মেয়ে এমনটা ভাবতেও অবাক লাগে মধুশ্রীর। তাই তিনি কৌতূহল মেটাতে চাইলেন। উত্তরে সুরজিৎ জানালেন, কিছু দাযিত্ব এমন ছিল যা পালন করতে গিয়ে নিজের কথা আর ভাবতে পারিনি। অকালে বাবাকে হারাবার পর সংসারের সব দাযিত্ব এসে পড়ে আমার উপর। আমিই বাড়ির বড়ো ছেলে, তাই ভাইবোনের লেখাপড়া, ভরণপোষণ, বিয়ে দেওয়া ইত্যাদি সবই সামলাতে হয়েছে আমাকে। কিন্তু ভাইবোনেরা যখন নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল, তখন তারা মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসতে চাইল। আমি পারলাম না। আমি চাকরি থেকে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে বৃদ্ধা মায়ের সেবাযত্ন শুরু করলাম। একসময় আমার বিয়ের খুব স্বাভাবিক ভাবে কিছু সম্বন্ধ এসেছিল। কিন্তু নানা কারণে বিয়ে অবধি গড়ায়নি। তবে আনন্দে থাকার চেষ্টা করি। ব্যস, একজন ভালো বন্ধুর ঘাটতি ছিল, সেও তো পেয়ে গেলাম। এখন আর আমার চিন্তা কীসের? বলেই হো হো করে হাসতে শুরু করলেন সুরজিৎ।
মুগ্ধ হয়ে সবকিছু শুনছিলেন মধুশ্রী। সুরজিতের কথা শেষ হওয়ার পর মধুশ্রীর মুখ দেখে মনে হল, সুরজিতের প্রতি তাঁর সম্মান যেন আরও বেড়ে গেল।
শুনলাম সুরজিতের সঙ্গে আজকাল নাকি খুব ঘুরছিস বলেই মধুশ্রীর দিকে আড় চোখে তাকালেন পামেলা।
একথা শুনে মধুশ্রীর গাল লাল হয়ে উঠল। পামেলা আবার বলতে শুরু করলেন, আমার খুব ভালো লাগল অন্তত নিজের কথা একটু ভাবতে শুরু করেছিস তুই।
চিলেকোঠার একপাশে দুজনে বসে বিকেলের চা-পানে ব্যস্ত ছিলেন। পামেলাকে বেশ খোশমেজাজে থাকতে দেখা গেল। কারণ, তিনি মধুশ্রীর এই অন্য জীবনের জন্য সত্যিই খুশি।
সত্যি বলছি, কাউকে মনের কথা খুলে বলে যে এত আনন্দ পাওয়া যায়, তা নতুন করে উপলব্ধি করলাম। একমাত্র তোকে মনের কথা বলতাম এতদিন, এবার আরও একজনকে পেলাম। জানালেন মধুশ্রী।
পামেলা আর মধুশ্রীর আড্ডার মধ্যেই মধুশ্রীর ছেলে বিকাশের ফোন এল। বিকাশ জানাল, কিছুদিনের জন্য সপরিবারে সে ভারতে এসে থাকবে। গত তিন বছর অনেক চেষ্টা করেও অফিসের কাজের চাপে আসতে পারেনি, এবার সুযোগ পেয়েছে আসার। সঙ্গে বউ এবং বাচ্চাদেরও নিয়ে আসবে।
অনেকদিন বাদে ছেলে, বউ আর নাতনিদের দেখতে পাবেন জেনে মনটা আনন্দে ভরে গেল মধুশ্রীর। তখন থেকেই তিনি ওদের আসার দিন গুনতে শুরু করলেন।
ছেলে এবং তার পরিবার বিদেশ থেকে নিজের বাড়িতে ছুটি কাটাতে আসার ঠিক দুদিন আগে মধুশ্রীর জন্মদিন। এর আগে নিজের জন্মদিন কখনও পালন করেননি মধুশ্রী। কিন্তু এবার সুরজিৎ নাছোড়া। রেস্তোরাঁয় টেবিল বুকিং হয়ে গেছে।
সন্ধেবেলা মধুশ্রীকে দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন সুরজিৎ। নীলরঙা শাড়ি আর হালকা মেক-আপ-এ মধুশ্রী যেন মোহমযী নারী রূপে আবির্ভূতা। সুরজিৎ তাঁর দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে আছেন দেখে লজ্জায় আরও লাল হয়ে উঠেছিল মধুশ্রীর ফর্সা গাল।
মধুশ্রীর পছন্দের হলুদরঙা অর্কিড ফুল কিনে এনেছিলেন সুরজিৎ। টাটকা, সুন্দর সেই একগোছা ফুল হাতে পেয়ে মধুশ্রী যেন নববধূর মতো লজ্জা পেয়ে হাসতে লাগলেন।
খুব সুন্দর ফুল, হেসে ধন্যবাদের ভাব প্রকাশ করলেন মধুশ্রী।
একদম আপনার মতো বলেই অর্থবহ হাসলেন সুরজিৎ।
আজ যেন পাশাপাশি বসে দুটি শিশুহৃদয় একে অপরকে দেখছে। অন্তরে কি পরস্পরের প্রতি প্রেম জাগরিত, নাকি ওরা নিষ্পাপ সম্পর্কের দুটি মানুষ, দুই বন্ধু?
বাড়ির সামনে মধুশ্রীকে নামিয়ে দেওয়ার আগে, তাঁর হাতে সুন্দর একটি উপহার তুলে দিলেন সুরজিৎ। বাড়িতে ঢুকে উপহারের মোড়ক খুললেন মধুশ্রী। দেখলেন সুন্দর একটি মুক্তোর আংটি। আর, সঙ্গে একটি চিঠি। মধুশ্রী ঝটিতি পড়ে ফেললেন সুরজিতের চিঠি। পড়ার পর আনমনা হয়ে পড়তে দেখা গেল তাঁকে।
অনেক কম বয়সে বিধবা হয়েছেন মধুশ্রী। কিন্তু এর আগে কখনও কোনও পুরুষ মানুষের সঙ্গে তাঁর সখ্যতা তৈরি হয়নি। চিঠিতে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন সুরজিৎ। মধুশ্রী নিশ্চুপ! সুরজিত্কে তিনি পছন্দ করেন, কিন্তু বিয়ে সে তো অনেক বড়ো বিষয়। মধুশ্রী এভাবে বিষয়টি নিয়ে ভাবেননি কখনও কিন্তু আজ ভাবতে হচ্ছে। কারণ, দাম্পত্য সম্পর্কে সূক্ষ্ম স্বার্থ থাকে, নিখাদ বন্ধুত্বে থাকে না।
সে যাই হোক, এভাবে একা একা দিন কাটানোও তো শরীর আর মনের জন্য ভালো নয়। তাহলে কী করা উচিত? বিয়ের প্রস্তাব কি মেনে নেওয়া উচিত? পরিবারের লোকজন কী বলবে? সমাজ কী ভাবে নেবে বিষয়টিকে? এসব প্রশ্ন নিজেই নিজেকে করেন মধুশ্রী। এভাবেই কেটে যায় অনেকটা সময়। নিজের প্রশ্নের উত্তর নিজেই খুঁজে পান না। আলমারি-তে চিঠি তুলে রাখেন সযত্নে। সিদ্ধান্তে পেঁছোতে না পারার জন্য ফোনও করে উঠতে পারেননি সুরজিত্কে।
বিকাশ তার বউ-বাচ্চাদের নিয়ে এসে গিয়েছে। মেয়ে সোমাও তার ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে হাজির। বাড়ি এখন ভরাভরতি রূপ নিয়েছে। স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে নাতি-নাতনিদের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছেন মধুশ্রী। প্রতিদিন কিছুটা বিনোদনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এসবের মধ্যে সিনেমা দেখা, রেস্তোরাঁয় খাওয়া ইত্যাদি রয়েছে।
একদিন সুরজিতের ফোন এল। এতদিন মধুশ্রীর উত্তর না পেয়ে সুরজিৎ ভেবেছিলেন, বোধ হয় রাগ করেছে মধুশ্রী।
সুরজিতের ফোন পেয়ে খুব লজ্জায় পড়ে যান মধুশ্রী। ছেলেমেয়ে বউমা আর নাতি-নাতনিদের পেয়ে সুরজিত্কে ফোন না করতে পেরে নিজেকে খুব স্বার্থপর মনে হল মধুশ্রীর।
পরের দিন মধুশ্রী তাঁর বাড়িতে আমন্ত্রণ জানালেন সুরজিত্কে। সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার ইচ্ছেপ্রকাশও করলেন মধুশ্রী। তিনি ভাবলেন, এখন ছেলে-মেয়েরাই তাঁর অভিভাবক। তাই তাদের মতামত নেওয়াটাও জরুরি। যতই হোক, এই বয়সে বিয়ে বলে কথা!
ডিনার-এ কাকে নিমন্ত্রণ করেছ মা? কৌতূহল মেটাতে চায় মেয়ে সোমা।
কেউ একজন হবে। আমার কোনও বিশেষ বন্ধু-ই ভেবে নে। সন্ধেবেলা নিজেই আলাপ করে নিবি। মেয়েকে হাসিমুখে জানালেন মধুশ্রী।
আলাপ, পরিচয় এবং কথাবার্তার পর সুরজিত্কে সবার খুব পছন্দ হয়ে গেল। মধুশ্রীর ছেলেমেয়ে মন জয় করে নিয়েছিলেন সুরজিৎ। তাই সবাই একসঙ্গে খুব হইহই করে ডিনার সারলেন।
সুরজিৎ চলে যাওয়ার পর, ছেলেমেয়েকে তাঁর ইচ্ছের কথা জানাবার উপযুক্ত সময় মনে করলেন মধুশ্রী। কিন্তু সবকিছু শোনার পর ছেলে বিকাশ আর মেয়ে সোমার কপালে ভাঁজ দেখা গেল।
দাদাকে চুপচাপ থাকতে দেখে নীরবতা ভাঙল সোমা, এই বয়সে কেউ বিয়ে করে মা! আমরা তো ভাবলাম তোমরা খুব ভালো বন্ধু। তাই বলে বিয়ে?
আমরা তো বন্ধু-ই আছি। বন্ধুর মতোই এতদিন সময় কাটিয়েছি। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে দুজনের দুজনকে প্রতিটা মুহূর্তে প্রযোজন। তাই, বন্ধুত্ব থেকে আরও অনেকটা এগিয়ে সম্পর্ককে বৈধতার মোড়ক দিতে চাই। জানালেন মধুশ্রী কোনওরকম জড়তা না রেখে।
মায়ের কথা শুনে এরপর মুখ খুলল বিকাশ, কিন্তু মা তুমি শুধু তোমার কথাটাই ভাবছ, আমাদের কথা ভাবছ না। লোকে কী বলবে ভেবে দেখেছ?
সুযোগ পেয়ে বউমাও দু-চার কথা শুনিয়ে দিল মধুশ্রীকে। ছেলে, বউমা, মেয়ে যেন এক সুরে কথা বলছে তখন।
অবাক হলেন মধুশ্রী। ছেলেমেয়ে দুজনেই শিক্ষিত। ছেলে-বউমা বিদেশে থাকে, তারা তো মায়ের থেকেও আধুনিক মনষ্ক হবে এটাই প্রত্যাশিত ছিল। তা নয়, লোকলজ্জার কথা তারা ভাবছে! খানিকটা ব্যথিত হয়ে সভা ভঙ্গ করে ঘরে ঢুকলেন মধুশ্রী।
একমাস থাকার কথা ছিল ছেলেমেয়েদের। কিন্তু তারা থাকল না। মনোমালিন্য এতটাই চরমে উঠল যে, ফ্লাইটের টিকিট পাওয়া মাত্রই রওনা দিল তারা।
আবার একাকিত্ব গ্রাস করল মধুশ্রীকে। অবশ্য এবারের একাকিত্ব আরও তীব্র রূপ নিল, মানসিক অবসাদের কারণে। এক সময় মনকে শক্ত করে মধুশ্রী সবকিছু জানালেন সুরজিত্কে। সব শুনে সুরজিৎ নিজেকে প্রথমে লজ্জিত এবং অসহায় মনে করলেও, পরক্ষণেই আবার স্বভাববশত ইতিবাচক কথা শোনালেন মধুশ্রীকে।
সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে, ধৈর্য ধরো। আমিও সুসময়ের অপেক্ষায় থাকব।
ছেলেমেযেরা যাওয়ার পর এক সপ্তাহ কেটে গেছে, কোনও ফোন নেই। মধুশ্রীর ফোনও রিসিভ করেনি কেউ। মায়ের মন তো, তাই দুশ্চিন্তায় বিনিদ্র রাত কাটাচ্ছেন মধুশ্রী।
হঠাৎ ফোন বেজে উঠল। ছুটে গিয়ে ফোনটা তুললেন মধুশ্রী।
ফোনের ও-প্রান্তে মেয়ে সোমার কণ্ঠস্বর, হ্যালো মা, সরি, তোমাকে ফোন করা হয়নি। দাদাও ফোন করতে পারেনি। বউদি জানিয়েছে আমাকে, দাদা খুব অসুস্থ। হাসপাতালে ভর্তি আছে। লিভারের কোনও বড়ো সমস্যা হয়েছে। তুমি পারলে আমার এখানে মুম্বই চলে এসো। আমি তোমাকে নিয়ে কানাডা রওনা দেব।
কথাগুলো শুনতে শুনতে ভয়ে মধুশ্রী হতবাক হয়ে যান। কী হয়েছে? কত বড়ো অসুখ? এসব নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে করতে বসে পড়েন মধুশ্রী।
মা নীরব কেন বুঝতে না পেরে সোমা ও-প্রান্ত থেকে হ্যালো, হ্যালো করতে থাকে। সম্বিত ফিরে পেয়ে উদ্গ্রীব হয়ে জানান মধুশ্রী, আমি শুনছি। তুই চিন্তা করিস না, আমি আজই পৌঁছে যাচ্ছি তোর ওখানে। তুই কালকেই কানাডা যাওয়ার ব্যবস্থা কর।
মেয়ের ফোনটা রাখার পর কিছুক্ষণ ভাবলেন মধুশ্রী। তারপর ফোন করে সবকিছু জানালেন সুরজিত্কে।
সবকিছু শুনে সুরজিৎ বললেন, আমি এক্ষুণি ফ্লাইটের দুটো টিকিট কেটে নিচ্ছি। রাতেই রওনা দেব। তুমি চিন্তা কোরো না। বন্ধুত্বটা তো রাখতে দাও। ছেলেমেযেরাও জানুক, আমরা বন্ধু ছিলাম, বন্ধু-ই আছি।
শত কষ্টের মধ্যেও যেন সব অসহায়ত্ব কেটে গেল মধুশ্রীর। চোখের কোণ তখন জলে টইটুম্বুর।