রাখিবন্ধনের ঠিক একদিন আগে মনোজের হাতে কিছু টাকা এল। তাই, কিছুটা আবেগবশতই সে তার মা-বাবার জন্য কিনল কিছু আকর্ষণীয় উপহার। বাদ গেল না তার মণিদিদিও। ওর জন্য কিনল একটি সুন্দর হাতঘড়ি। মণিদিদি শ্বশুরবাড়ি থেকে এসেছে রাখি পরাতে।
সব টাকা আমার ঘড়ির জন্য খরচ করে দিয়েছিস নাকি মা-বাবার জন্য কিছু কিনেছিস? ভাইকে প্রশ্ন মণিমালার।
মুখ টিপে হাসল মনোজ। আর বলল, আজকের দিনটা অপেক্ষা কর দিদি, কাল জেনে যাবি মা-বাবাকে কী উপহার দেব, বলেই নিজের ঘরে ঢুকে গেল মনোজ।
আসলে মনোজ তার অনেক দিনের ইচ্ছেপূরণ করতে চলেছে। সে এখন সফটওয্যার ইঞ্জিনিয়র। মোটা মাইনের চাকরি। প্রথম মাসের বেতন হাতে আসতেই সে তার দীর্ঘদিনের লালিত শখ-আহ্লাদ পূরণ করতে চায়। মা, বাবা, দিদি, সবাইকে খুশি করতে চায়। আধুনিক সাজে সাজাতে চায় নিজের বাড়িটাকে। বন্ধুদের সঙ্গে ফার্নিচার-এর শোরুম-এ গিয়ে সে কিছু জিনিসও পছন্দ করে এসেছে।
রাখিবন্ধনের দিন খুব সকালে উঠে স্নান সেরে নিয়েছে মনোজ। তার দেওয়া হাতঘড়িটা পরে মণিদিদি খুব খুশী। আদর করে রাখিও বাঁধল ভাইয়ের হাতে। এবার মা-বাবাকে উপহার দিয়ে চমকে দেওয়ার পালা। কিন্তু বাবা কোথায়?
মনোজের প্রশ্ন শুনে মা হাসলেন। মনোজ অবাক হল। তা দেখে মণিদিদি বলল, বাবা তো রাখি পরতে চলে গেছেন।
কিন্তু কোথায়?
মনোজের কৌতহল মেটার আগেই মনোজের বাবা অর্থাৎ সরোজবাবু এসে হাজির। তাঁর হাতে রাখি বাঁধা রয়েছে দেখে দ্বিগুন কৌতহলে মনোজের প্রশ্ন, বাবা, কে রাখি পরাল তোমায়?
সরোজবাবু জানালেন, দিদির সঙ্গে তো আর যোগাযোগ নেই, তাই, কৃষ্ণ মন্দিরের সেবাকর্মী এক দিদির হাতে রাখি পরে এলাম। গরিব মানুষ, এই ছুতোয় কিছু টাকাও সাহায্য করে এলাম।
নিজে একটা সাধারণ চাকরি করলেও, সরোজবাবু চিরকালই পরোপকারী। শুধু তাই নয়, কিছুটা আবেগপ্রবণও। বাবাকে এমনটাই এতদিন দেখে এসেছে মনোজ এবং মণিমালা। কিন্তু বাবার হাতে দুটো রাখি কেন, সে প্রশ্নের উত্তর পায়নি ভাইবোন।
যাইহোক, বাবার পরোপকারের বিষয়টি সামনে আসতেই আবার কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ল মনোজ। সে নিজের ঘর থেকে মা-বাবার জন্য রাখা উপহারটা এনে তুলে দিল বাবার হাতে।
উপহারটা হাতে নিয়ে সরোজবাবু প্যাকেট খুলে দেখলেন একটা দামি স্মার্ট ফোন।
তোর তো স্মার্ট ফোন আছে, আবার কিনে টাকা নষ্ট করলি কেন?
না বাবা, এটা আমার জন্য নয়। এটা মা এবং তোমার জন্য। যাদের সঙ্গে যোগাযোগ কমে গেছে, তাদের সঙ্গে আবার ভিডিযো কল করে কথা বলবে। ফেসবুকও করতে পারবে। অবসর সময়টা ভালো ভাবেই কেটে যাবে তোমাদের।
মনোজের কথা শুনে সরোজবাবু আপত্তি তুলতে গিয়ে পারলেন না, কারণ মনোজের মা গীতা বললেন, খোকা যখন শখ করে কিনে এনেছে, তখন আর আপত্তি কোরো না।
মণিমালা বলল, বাবা তুমি চিন্তা কোরো না, আমি সব শিখিয়ে দেব।
দিদি, মোবাইলটা নিয়ে চার্জ-এ বসিয়ে দে এবার। মনোজের অনুরোধ মণিদিদিকে।
বিকেলবেলা মুখরোচক কিছু স্ন্যাক্স তৈরি করে গরম গরম পরিবেশন করল মণিমালা। সবাই একসঙ্গে বসে খাবারের স্বাদ নিল। এক ফাঁকে কথায় কথায় মনোজ জানাল, পুরোনো ফার্নিচার বদলে নতুন ফার্নিচার আনার ইচ্ছের কথা। কিন্তু এবার ওর মা আপত্তি তুললেন, পুরোনো হলেও এত বড়ো খাট রয়েছে তো ঘরে, আবার কিনবি কেন? এটাতে কী সুন্দর আমরা সবাই একসঙ্গে শুতে পারি ইচ্ছে হলে। নতুন খাট তো আর এত বড়ো হবে না!
মনোজ বুঝল মায়ের আবেগ-অনুভতির বিষয়টা। কিন্তু সে তার গার্ল-ফ্রেন্ড পৃথা-কে কথা দিয়েছে যে, বিয়ের আগে ঘরগুলিকে গুছিয়ে কিছু জিনিসপত্র চেঞ্জ করে একেবারে আধুনিক রূপ দেবে। এরপর দিদি মণিমালা-ই অবশ্য মাকে মনোজের ইচ্ছের কথা বুঝিয়ে রাজি করাল।
আসলে, মনোজ এবং পৃথা-র সম্পর্কের বিষয়ে অনেকটাই জানত দিদি মণিমালা। ওদের ভাইবোনের মধ্যে খুব ভালো সম্পর্ক, একেবারে বন্ধুর মতো। তাই, চাকরি পাওয়ার পর মনোজ যে পৃথাকে বিয়ে করে ঘরে আনতে চায়, এ কথা জানত ওর মণিদিদি। সে তাই মায়ের কানে কানে মনোজের ইচ্ছের কথা জানিয়ে দেওয়ার পর, মা মুচকি হেসে মনোজকে নতুন ফার্নিচার ঘরে আনার অনুমতি দেন। ভাই মনোজের কাছ থেকে ওর হবু শ্বশুরের মোবাইল ফোনের নাম্বারটা নিয়ে মায়ের হাতে তুলে দিয়েছিল মণিমালা।
মেয়ে মণি, শ্বশুরবাড়ি চলে যাওয়ার পর কেটে গেছে আরও এক মাস। এর মধ্যে সরোজবাবু এবং গীতা মনে মনে ছেলের বিয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছেন। সরোজবাবু একদিন ফোন করে আলাপ-পরিচয় সারলেন ছেলের হবু শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে। মনোজের সঙ্গে পৃথার বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। পৃথার বাবা-মা অবিনাশ এবং সুনীতা তাদের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানালেন সরোজবাবু এবং গীতাকে।
মনোজের মতো পৃথাও চাকরি করে। তবে সে মনোজের মতো ইঞ্জিনিয়র নয়, একটি বহুজাতিক সংস্থার অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ হেড। শিক্ষিত এবং আধুনিক মনস্ক। তাই মনোজ এবং পৃথা চেয়েছিল, ওরা রেজিস্ট্রি ম্যারেজ-এর পর একটা রিসেপশন পার্টি দেবে। কিন্তু পৃথার দিদিমা চান বিয়ে সামাজিক মতে হইহুল্লোড় করেই হোক। পৃথা যেহেতু তার দিদিমাকে ভীষণ ভালোবাসে, তাই তাঁর আদেশ অমান্য করতে পারল না। অগত্যা মনোজও সামাজিক বিয়েতেই মত দিতে বাধ্য হল।
দুই বাড়ির মধ্যে মনোজ এবং পৃথা-র বিয়ের কথা এগোতে থাকল। প্রস্তুতিও শুরু হল জোর কদমে। নির্দিষ্ট দিনে আংটি বদলও করে নিল মনোজ এবং পৃথা। অবশ্য ওইদিন শুধু দুই বাড়ির লোকেরাই একটা ছোটো মতো অনুষ্ঠান করে একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া সারল। এরপর বিয়ের দিন এগিয়ে আসতে লাগল। মনোজ সমস্ত দায়-দাযিত্ব ভাগ করে দিতে শুরু করল আগাম। দিদি-জামাইবাবুকে জানিয়ে দিল তাদের অতিথি আপ্যায়নের দাযিত্ব নেওয়ার কথা। আর মা-বাবাকে জানাল, ওরা যেন পৃথা-র দিদিমার কথামতো সমস্ত সামাজিক রীতিনীতি মেনে চলেন।
কিন্তু বিয়ের দিন যত এগিয়ে আসতে লাগল, সরোজবাবু এবং গীতাকে খুব চিন্তান্বিত মনে হল। বিশেষ করে সরোজবাবুকে খুব মনমরা হয়ে বসে থাকতে দেখা গেল। এই দৃশ্য মনোজের চোখ এড়াল না।
বাবা, তোমাদের কী হয়েছে? খুব দুশ্চিন্তায় রয়েছে মনে হচ্ছে! এনি প্রবলেম?
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর সরোজবাবু ছেলেকে বললেন, না তেমন কিছু নয়, আসলে বয়স হয়েছে তো, তাই ভাবছি যদি পৃথা-র দিদিমার ইচ্ছেমতো সমস্ত রীতিনীতি ঠিক মতো মেনে চলতে না পারি! না, মানে তিনি খুশি না হলে তো বউমাও দুঃখ পাবে, তাই ভাবছি…
তোমরা এত ভেবো না তো। বাবা-মা হিসাবে যা রীতিনীতি মানার তাই মানবে, বাড়াবাড়ির তো কোনও প্রযোজন নেই।
না, মানে পৃথার দিদিমা একটু প্রাচীন ধ্যান ধারণার মানুষ তো, যদি তাঁর মন ভরাতে না পারি।
এবার মনোজ ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, মা, বাবাকে তো এমন করে সাধরণ একটা বিষয় নিয়ে ভাবতে দেখিনি। বাবা তো এত সংস্কার মানে না। এখন কী যে হল! যাকগে, তুমি বাবাকে একটু খুশিতে থাকার ব্যবস্থা করো তো। আচ্ছা, ঠিক আছে, আমি কালই দিদিকে চলে আসতে বলছি। জামাইবাবু না হয় ব্যস্ত মানুষ, পরে আসবে। দিদি এলে তোমাদের মাতিয়ে রাখবে।
মণিমালা এখনও মা হয়নি। তাই ভাই অনুরোধ করতেই চলে এল মা-বাবাকে খুশিতে রাখার জন্য। দিদি আসার পর বাবা-মাকে অনেকটা চিন্তামুক্ত দেখে, মনোজও বেশ ফুরফুরে মেজাজেই ছিল। কিন্তু এক সন্ধ্যায় সূচনা হল এক রহস্যজনক অধ্যায়ের।
দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। মণিমালা তখন বাড়িতে থাকলেও, মনোজ ছিল না। ছেলেমেয়ের সামনে দিনেরবেলা মা-বাবাকে কখনও দরজা বন্ধ করে থাকতে দেখেনি মণিমালা। তার কাছে বিষয়টি আরও বিস্ময়ের এবং ভয়ের মনে হল, যখন সে ডাকাডাকি করেও দরজা খোলাতে পারল না। অগত্যা মণিমালা ভাই মনোজকে ফোন করে তাড়াতাড়ি আসতে বলল সব জানিয়ে।
অফিস ছুটি থাকার কারণে পাড়ার মোড়ে বসেই আড্ডা দিচ্ছিল মনোজ। দিদির ফোন পেয়ে সে দ্রুত ফিরে আসে বাড়িতে।
ছেলে এসে দরজায় জোরে জোরে কড়া নাড়তেই দরজা খুলে গেল। মা খুললেন দরজা। তাঁকে বেশ গম্ভীর দেখতে লাগছিল।
কী হয়েছে তোমাদের? শরীর খারাপ? প্রায় চেঁচিয়ে উঠল মনোজ।
না, তেমন কিছু হয়নি। একটা বিষয় নিয়ে আমরা একান্তে কিছু আলোচনা করছিলাম। ভেতরে আয়। উনি তোদের ভাইবোন-কে কিছু বলতে চান আজ।
ভয় এবং বিস্ময়ের প্রাথমিক ধাক্কা কাটানোর পর ভাইবোন দুজনে ঘরে ঢুকল মায়ের সঙ্গে।
কী হয়েছে বাবা? প্রশ্ন ছুড়ে দিল মনোজ।
ওদের ভাইবোনকে ইশারায় বসতে বললেন সরোজবাবু। তারপর কয়েক সেকেন্ড বাদে ঘরের নিস্তব্ধতা কাটিয়ে মুখ খুললেন তিনি। প্রশ্নের সুরে বললেন, আচ্ছা, তোরা বলতো, বিয়ের মতো শুভ কাজে বাইরের একটা উটকো লোকের রীতিনীতি পালনের অধিকার আছে? মানে, যে-কেউ কি বাবার ভমিকা নিতে পারে?
এমন হেঁয়ালিপূর্ণ কথা শুনে ভাইবোন প্রায় সমস্বরে বলে ওঠে, মানে!
হ্যাঁ, মনের সঙ্গে যুদ্ধ করে জিতে গেছি, তাই আজ বলতে দ্বিধা নেই। আমি আসলে তোদের বাবা নই, সম্পর্কে মামা! তাও আবার নিজের রক্তের সম্পর্কের মামা নই, প্রতিবেশী পাতানো মামা। এই পর্যন্ত বলে সরোজবাবু থামলেন এবং মনোজ ও মণিমালার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করতে লাগলেন। গীতা তখন মাথা নীচু করে খাটের উপর বসে রয়েছেন।
কিছুটা থমকে থাকার পর, মায়ের দিকে তাকিয়ে মনোজ জিজ্ঞেস করল, মা, বাবা ভুল বকছে কেন? শরীর ঠিক আছে তো?
মনোজের প্রশ্নের উত্তরে সরোজবাবু আবারও শান্ত গলায় জানালেন, আমি সম্পূর্ণ সুস্থ আছি মনোজ। আজ তোদের কঠিন সত্যের মুখোমুখি হতেই হবে। নয়তো আমি হয়তো সত্যিই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলব।
অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর মণিমালার মুখ থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে গেল, কী সত্যি…!
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন সরোজবাবু। তারপর ডুব দিলেন স্মৃতির গভীরে। বলতে শুরু করলেন, তোদের মা এবং আমি জলপাইগুড়ির একটি গ্রামে পাশাপাশি বাড়িতে থাকতাম। বলতে গেলে একই পরিবারের মতো। ছোটোবেলা থেকেই আমরা ভাইবোনের মতো ছিলাম। তোদের মা আমাকে ফোঁটা দিত, রাখি পরাত। আমরা একই স্কুলে, একই ক্লাস-এ পড়তাম। বড়ো হয়ে দুজনে হায়ার এডুকেশনের জন্য কলকাতায়, মানে এখানে এলাম। আমি যে মেসবাড়িতে থাকতাম, তার থেকে খানিক দূরে লেডিজ হস্টেল-এ থাকত তোদের মা। দেখা হতো নিয়মিত। ভাইবোনের বেশ আড্ডাও হতো।
একদিন আমাদের সঙ্গে আড্ডায় যোগ দিল জামশেদপুরের ছেলে সুনির্মল। আমি আর সুনির্মল একই মেস-এ থাকতাম। কিন্তু সুনির্মল চাকরি করত একটি প্রাইভেট সংস্থায়। আমিই সুনির্মলের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলাম তোদের মায়ের। ব্যস, ওই পর্যন্তই। তারপর কবে, কীভাবে ওরা দুজন দুজনকে ভালোবাসতে শুরু করেছিল, সম্পর্ক গভীর হয়েছিল, তা আমি জানতাম না।
হঠাৎ একদিন তোদের মা কাঁদতে কাঁদতে এসে দেখা করল আমার সঙ্গে। এত হাসিখুশি বোনটাকে ওভাবে কাঁদতে দেখে আমি অবাক হযেছিলাম। কিছুতেই ও বলতে পারছিল না ওর দুঃখ-কষ্ট কিংবা সমস্যার কথাটা। তারপর সব জানলাম অনেক অনুরোধের পর। কিন্তু সুনির্মল যে-মেস ছাড়ার আগে গীতার সর্বনাশ করে গেছে, তা জেনে মর্মাহত হলাম। কারণ, সুনির্মলের ব্যবহারে কোনও দিন অবিশ্বাসের চিহ্নও খুঁজে পাইনি। চাকরিসূত্রে অন্যত্র বদলি হয়ে যাচ্ছে বলে মেস ছেড়েছিল সে। তখন কে জানত যে, আসলে ও পালিয়েছে!
অনেক খোঁজাখুঁজির পরও পাওয়া গেল না সুনির্মলকে। উলটে, পুলিশের মাধ্যমে অন্য এক মর্মান্তিক ঘটনার খবর পেয়েছিলাম। সুনির্মলের ওই অপকর্ম করে পালিয়ে বেড়ানোর খবর পেয়ে বালিগঞ্জে বাপের বাড়িতে এসে আত্মহত্যা করেছিল তার বিবাহিত স্ত্রী। আর তার বৃদ্ধা অসহায় মায়ের কাছে রেখে গিয়েছিল একরত্তি মেয়েকে। মণি তুই তখন কথা বলতেও শিখিসনি।
সব জেনে গীতা চমকে দেওয়ার মতো একটা পদক্ষেপ নিয়েছিল। পুলিশের সাহায্য আর আইনি অনুমতি নিয়ে বালিগঞ্জের বাড়িতে গিয়ে মণিকে নিয়ে এসে নিজের মেয়ে পরিচয় দিয়েছিল। অথচ নিজেই তখন অসহায়। পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। গীতা-র ওই অদ্ভুত মানসিক শক্তি, মহানুভবতা আর সাহস দেখে আমি হতবাক হয়েছিলাম। কিন্তু ঘোর কাটতেই আমার মনে হযেছিল, একা একটা মেয়ের পক্ষে এত বড়ো লড়াই চালিয়ে যাওয়া অত্যন্ত কঠিন। তাই হাত বাড়িয়ে দিলাম সাহায্যের।
আর জলপাইগুড়িতে নিজেদের বাড়িতে ফেরা হল না আমাদের। সমাজের রক্তচক্ষু এড়াতে গিয়ে আমরা একসঙ্গে থাকতে শুরু করলাম স্বামী-স্ত্রীর পরিচয়ে কিন্তু সে তো শুধু সমাজের চোখে, আসলে তো আমরা দুটি ভাই-বোন। পবিত্র সে সম্পর্ক। আজও সে পবিত্রতা বজায় রেখে চলেছি দুজনে এবং দাযিত্ব পালনেও কোনও ত্রুটি রাখিনি। তোরা দুজনেই সুনির্মলের সন্তান হলেও, তোদের মা আলাদা। কিন্তু গীতা তোদের দুজনকেই সমান স্নেহে মানুষ করেছে। আর আমি শুধু পাশে থেকে সাহস জুগিয়ে গেছি মাত্র। কিন্তু এতদিন এই স্বামী-স্ত্রীর অভিনয় করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছি। আর লুকিয়ে তোদের মায়ের হাত থেকে রাখি পরতে পারব না। এবার তোদের সামনেই গীতার হাত থেকে ফোঁটা নিতে চাই, রাখি পরতে চাই। তোরা সে অনুমতি দিবি তো?
এতক্ষণ সরোজবাবুর কণ্ঠস্বর ছাড়া আর কোনও শব্দ ছিল না ঘরে। কিন্তু তার কথা শেষ হতেই কান্নার বাঁধ ভাঙল মণিমালার। গীতাকে আঁকড়ে ধরে শিশুর মতো কাঁদছে সে। গীতার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। অন্যদিকে, সরোজবাবুর পা ধরে মাটিতে বসে পড়েছে মনোজ। সরোজবাবুর স্বার্থত্যাগ ও মহানুভবতার কাহিনি শুনে মনোজের তখন বাকরুদ্ধ অবস্থা।
একসময় ঘরে দেখা গেল এক স্বর্গীয় সুখময় দৃশ্য। সরোজবাবু, গীতা, মণিমালা, মনোজ সবাই একে অন্যকে জাপটে ধরে রয়েছে। সবার চোখেই জল। দুঃখ, যন্ত্রণা আর পারস্পরিক শ্রদ্ধার সেই অনুভতি যে কেমন ছিল, তা ওরা চারজন ছাড়া অনুভব করা অন্যদের কাছে দূরূহ বিষয়।
যাইহোক, মনোজের মর্মান্তিক অতীত এবং গীতা ও সরোজবাবুর এই সংবেদনশীল কাহিনি শুনে পৃথা, ওর মা-বাবা, এমনকী দিদিমাও বিস্ময় প্রকাশ করেন ও মুগ্ধ হন। তারপর, মনোজের অনুরোধ মতো রীতিনীতি ছাড়াই বিয়ের অনুমতি দেন পৃথার দিদিমা। আর এই সিদ্ধান্তে সবচেয়ে বেশি খুশি হন সরোজবাবু। কারণ, তাঁকে আর অসহায় ভাবে বাবা সাজতে হবে না।