সোম দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকাল। দশটা বেজে গেছে। তার দশতলার ফ্ল্যাট-টা থেকে নীচের গাড়ি-ঘোড়ার আওয়াজ প্রায় কিছুই শুনতে পাওয়া যায় না। তাই দশটাতেই মনে হচ্ছে রাত নিঝুম হয়ে পড়েছে। স্বাতী রোজই ডিনার করে নীচে একটু হাঁটতে যায়। আজ সোমের মনে হল স্বাতী একটু বেশি দেরি করছে উপরে আসতে।
আট বছরের ধ্রুব বসবার ঘরে টিভিতে কার্টুন দেখছে মন দিয়ে, সোম ভাবল পড়াশোনার সময় এতটা মন দিয়ে ধ্রুবকে কোনওদিন পড়তে দেখে না। সে নিজেও ল্যাপটপে সার্ফিং করতে করতে বোর হয়ে উঠেছিল। ল্যাপটপ বন্ধ করে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। উপর থেকে স্বাতীকে খোঁজার চেষ্টা করল কিন্তু কিছুই নজরে এল না। দরজার একটা চাবি নিয়ে ড্রযিংরুমের দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে দরজা টেনে দিল। সোজা পা বাড়াল লিফট-এর দিকে।
তাদের হাউজিং কমপ্লেক্সের চারপাশে এখনও সব আলোগুলো জ্বলছে দেখল সোম। নীচে আবাসনের অনেকেই হাঁটতে বেরিয়েছে কিন্তু স্বাতী কোথাও নেই। ঘুরতে ঘুরতে সোম আবাসনের শপিং কমপ্লেক্সের ভিতরও একবার ঢুঁ মারল। সেখানেও স্বাতী নজরে পড়ল না। এত রাতে গেল কোথায়? চিন্তার ভাঁজ পড়ল কপালে।
হঠাৎই যেদিকটায় আলো একটু কম সেদিকে চোখ পড়তেই, সোম দেখল স্বাতী কথা বলতে বলতে হাঁটছে, সঙ্গে একজন পুরুষমানুষ। দেখেই সোমের বেশ রাগ হল। ইচ্ছে হল স্বাতীর সামনে গিয়ে কষে গালে একটা থাপ্পড় মারে। কিন্তু আশেপাশে এত মানুষজন দেখে নিজেকে সংযত করল সোম। সে নিজেও একটু দূরত্ব রেখে ওদেরকে অনুসরণ করল। তারপর একটু খালি জায়গা দেখে হাঁক দিল, স্বাতী!
চমকে পিছনে তাকাল স্বাতী। মুখে নানা ভাবের আনাগোনা লক্ষ্য করল সোম। স্বাতীর সঙ্গের পুরুষটিকে বহু আগে থেকেই চেনে সে। সুতরাং মুখে হাসি টেনে সোম জিজ্ঞেস করল, আরে প্রশান্ত কেমন আছো?
প্রশান্তর সঙ্গে করমর্দন করা শেষ হলে, হাসি মুখেই প্রশান্ত জবাব দিল, আমি ভালোই আছি। তোমার কী খবর বলো?
সোম নিজেকে পুরোপুরি কন্ট্রোল করে নিয়েছিল। নানা একথা সেকথা বলতে বলতে তিনজনে একসঙ্গে হাঁটতে শুরু করল। স্বাতী পুরোপুরি চুপ করে গিয়েছিল। সোম আর প্রশান্ত আবাসনের নানা সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে আলোচনা করতে করতে হাঁটছিল। হঠাৎ প্রশান্ত বাড়ির সবাই হয়তো চিন্তা করছে বলে, পা চালিয়ে নিজের বিল্ডিং-এর দিকে চলে গেল।
প্রশান্ত চলে যেতেই সোম, স্বাতীর দিকে ফিরে তিক্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল, এসব কী চলছে স্বাতী?
তুমি যা ভাবার ভেবে নাও। আমার কিছু যায় আসে না, সোমের মুখের উপরে একটু জোরেই কথাগুলো বলে স্বাতী পা চালিয়ে নিজের বিল্ডিং-এ ঢুকে গেল। সোম বিস্ফারিত চোখে কিছুক্ষণ স্বাতীর চলে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে একই দিশায় পা বাড়াল।
(২)
ফ্ল্যাটে ঢুকে, স্বাতী আগে টিভি বন্ধ করে ধ্রুবকে ওর শোবার ঘরে শুইয়ে দিয়ে এল। পরের দিন ধ্রুব-র স্কুল আছে। ধীরে ঘরের আলো সব নিভিয়ে স্বাতী নিজের বেডরুমে এসে ঢুকল। সে জানত, এখনই তাকে সোমের প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে।
স্বাতীকে দেখেই দাবানলের মতো জ্বলে উঠল সোম। কী হল স্বাতী, তুমি তো আমার প্রশ্নের উত্তর দিলে না? এত রাতে প্রশান্তর সঙ্গে ঘুরে বেড়াবার অর্থ কী?
এমনিই। একই আবাসনেতে থাকি, নীচে দেখা হয়ে গেল তাই একসঙ্গে হাঁটছিলাম।
এটা ভাবলে না যে, কেউ যদি তোমাদের দেখে তারা কী ভাববে? বলল সোম।
না ভাবিনি। একসঙ্গে হাঁটলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হবে?
সকালে সোমের অফিস ছিল। নিজের ব্যাবসা ভালো চলছিল না। ধারদেনা বাড়ছিল। তার উপর স্বাতীর এই ব্যবহার। রাগে সোমের মাথা ঝিমঝিম করছিল, কিছুতেই ঘুম আসছিল না। এপাশ ওপাশ ছটফট করতে করতে কখন ঘুম এসেছে সোম মনে করতে পারল না।
রোজের মতো স্বাতী বাইরের জামাকাপড় ছেড়ে ফ্রেশ হল। তারপর আয়নার সামনে বসে নাইট ক্রিম লাগাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। প্রশান্তর কথা মনে হতেই ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটে উঠল স্বাতীর। বিছানায় এসে শুয়ে পড়ল। পাশে শুয়ে থাকা সোমের দিকে চোখ পড়তেই চোখ ফিরিয়ে অন্য পাশ ফিরে শুল স্বাতী। রাগের মাথায় বলা সোমের কথাগুলো স্বাতীর মনে আদৌ কোনও প্রভাব ফেলেছে বলেই মনে হল না। সোমকে একেবারেই পাত্তা না দিয়ে স্বাতী প্রশান্তর কথা ভাবতে ভাবতেই আয়েশে চোখ বুঁজল। মুহূর্তে ঘুম এসে গেল।
প্রশান্ত এবং স্বাতী দুজনেই এই আবাসনে এসেছে বছর দুয়েক হল। জিমে আসতে যেতে দুজনের বন্ধুত্ব হয়, যা আজ অনেক বেশি গভীর। প্রশান্তর বউ নূপুর আর তার দুই ছেলে-মেয়ে অয়ন ও নিকিতার সঙ্গেও স্বাতীর যথেষ্টই ভালো সম্পর্ক। বাড়িতে আসা-যাওয়াও হয়েছে বহুবার। কিন্তু কী ভাবে যেন ওদের দুজনের সম্পর্কটা সকলের দৃষ্টি বাঁচিয়ে সম্পূর্ণতা পাওয়ার দিকে এগোচ্ছিল। সমস্ত সামাজিক বিধিনিষেধের ঊর্ধ্বে তারা এই সম্পর্কের আবদ্ধ হয়ে পড়ছিল। একে অপরকে দেখা, কথা বলা, একসঙ্গে কোনও কিছু নিয়ে হাসিতে গড়িয়ে পড়া, কিছুটা সময় একসঙ্গে কাটানো এই অল্পতেই দুজনে খুশি হয়ে উঠত। কাউকে তোয়াক্কা করা ছেড়ে দিয়েছিল দুজনেই।
(৩)
ধ্রুব তখন খুব ছোটো। ধ্রুব-র সব দাযিত্ব স্বাতী একাই সামলাত। সোম প্রথম থেকেই বেপরোয়া ধরনের মানুষ। সোম প্রচুর অর্থ উপার্জন করে দেখেই স্বাতীর মা-বাবা, সোমের সঙ্গে তার বিয়ে দেন। কিন্তু বিয়ের পর সোমের স্বাতীর ব্যাপারে উদাসীনতা তাকে বেশ পীড়া দিত। স্বাতী সুন্দরী, স্মার্ট, ফিটনেস ফ্রিক এবং প্রাণবন্ত। আর সেখানে সোম ছিল ঢিলেঢালা প্রকৃতির। ব্যাবসা ভালো করলেও টাকা ওড়ানো একটা নেশা ছিল সোমের। প্রতি রাতে বন্ধুবান্ধব নিয়ে নেশা না করে বাড়ি ঢুকত না সে। তার উপর ছিল দাযিত্বহীন, মুডি আর রাগি একটা মানুষ।
সোমের মা-বাবাও ওই আবাসনেই অন্য একটা বিল্ডিং-এ থাকতেন। তাদের দাযিত্বও স্বাতী একাই বহন করত। শ্বশুর-শাশুড়ির কোনও দরকার পড়লেই বউমা-কে ফোন করে দিতেন। স্বাতী তত্ক্ষণাৎ হাজির হয়ে যেত। সোমও বউয়ের উপর সব দাযিত্ব চাপিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে বন্ধুদের সঙ্গে ব্যস্ত থাকত।
স্বামী-র সঙ্গে অন্তরঙ্গতা কোনওদিন স্বাতীকে সুখ দিতে পারেনি। কারণ সেখানে ভালোবাসা বা রোম্যান্সের বড়ো অভাব অনুভব করত স্বাতী। শুধু খিদে মেটাবার একটা ইচ্ছা যেন তাড়িয়ে বেড়াত সোমকে, আর ইচ্ছেপূরণ করতে হতো স্বাতীকে। অথচ দাম্পত্য জীবনের মধুর স্বপ্ন চোখে নিয়ে স্বাতী, সোমের সঙ্গে সুখে সংসার করতে চেয়েছিল। সেই স্বপ্নপূরণ হয়নি ঠিকই কিন্তু একটি সন্তান এসেছে তার জীবনে।
প্রশান্তর সঙ্গে আলাপের পরেই জীবনটাকে অন্য চোখে দেখতে আরম্ভ করে স্বাতী। কী করে জানি স্বাতীর সব প্রযোজন নিমেষে বুঝে যেত প্রশান্ত। সাহায্য করতে ঝাঁপিয়ে পড়ত কোনওরকম প্রত্যাশা না করেই। সোমকে প্রায়শই কলকাতার বাইরে যেতে হতো। তখন কত সময় প্রশান্ত অফিস ছুটি করেও স্বাতীকে সঙ্গ দিয়েছে, যতক্ষণ না ধ্রুব স্কুল থেকে ফিরেছে। দুজন একে অপরের মনের কথা মুখে না বলেও ঠিক বুঝে যেত। কোনও নিয়মে আবদ্ধ না হয়ে দুটো মন সমস্ত সীমা লঙ্ঘন করে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিল।
স্বাতীর দাম্পত্য জীবনে যে-সুখটুকুর অভাব ছিল, প্রশান্তর সঙ্গে আলাপের পর স্বাতীর আর কোনও অপূর্ণতা ছিল না। যন্ত্রের মতো শরীরী মিলনের সুখ ছাড়াও জীবনে আরও অনেক কিছু আছে। সমর্পণ মানে শুধু শরীরের প্রযোজনে কাছে আসা নয়, দেহে-মনে এক হয়ে যাওয়া।
স্বাতীর মনে কোনও অপরাধবোধ নেই। জীবনের আসল সুখ প্রশান্তই তাকে দিয়েছে। সোমকে কতবার দেখেছে স্বাতী একাধিক জনের সঙ্গে ফ্লার্ট করতে। স্বাতী যখনই বাধা দিতে চেয়েছে, তখনই সোম স্বাতীকে চুপ করিয়ে দিয়েছে, মানসিক সমস্যা বলে। দুবার তো সোমকে তার দূর সম্পর্কের এক বোনের সঙ্গে অশালীন অবস্থায় স্বাতী দেখেও ফেলেছিল কিন্তু সোম নিজেকে শুধরোবার কোনওরকম চেষ্টাই করেনি। মেয়েদের সঙ্গে এই ধরনের অশালীন ব্যবহারই নাকি সোমের মতে পুরুষত্বের প্রমাণ। এটাতেই সোম আনন্দ পায়। আজ প্রশান্তর সঙ্গে স্বাতীকে দেখেও হয়তো এই জন্যই বেশি কিছু বলার সাহস অর্জন করতে পারেনি সোম।
প্রশান্ত নিজের বাড়ি ঢুকে দেখল, নূপুর আর তার দুই ছেলে-মেয়ে সকলেই শুয়ে পড়েছে। অয়ন আর নিকিতার সকালে কলেজ আছে। ছেলে-মেয়ের জন্য নূপুরকেও ঠিক সময় শুয়ে পড়তে হয়।
প্রশান্ত চেঞ্জ করে বেডরুমে ঢুকতেই নূপুর জিজ্ঞেস করল, এত লেট?
হ্যাঁ, হাঁটতে বেশ ভালো লাগছিল।
কার সঙ্গে হাঁটছিলে? নূপুর জিজ্ঞেস করে।
স্বাতীর সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল। তারপর সোমও আমাদের জয়েন করল।
নূপুর আর কিছু বলল না। স্বাতীর সঙ্গে প্রশান্তর মেলামেশার সব খবরই সে রাখে। কী করবে সে? কী করে এই কথা প্রশান্তকে জিজ্ঞেস করবে? বাড়িতে বাচ্চারা বড়ো হয়ে গেছে, খুব ভেবেচিন্তে কথা বলতে হয় এখন। রেগে গেলে প্রশান্ত চ্যাঁচামেচি শুরু করে। নূপুর ভালোই বুঝতে পারে স্বাতী কতটুকুই বা জানে প্রশান্তর সম্পর্কে। ও বাইরে একরকম আর বাড়িতে আর এক রকম, যেমন সব পুরুষমানুষ হয়। কুড়ি বছরের বিবাহিত জীবনে নূপুর প্রশান্তকে হাড়ে মজ্জায় চেনে। অন্য মহিলাদের প্রভাবিত করার ক্ষমতা তার মতো কারও আছে বলে, নূপুর বিশ্বাস করে না।
নূপুরের নিজের ছোটো বোনের সঙ্গেও প্রশান্তর অন্তরঙ্গতা গড়ে উঠেছিল একটা সময়। কিছুই করতে পারেনি নূপুর। বোনের অন্যত্র বিয়ে হওয়ার পর নূপুর কিছুটা স্বস্তি পেয়েছিল। কত মেয়ে যে প্রশান্তর জীবনে এসেছে, তার কোনও গুনতি নেই। নূপুর গরিব ঘরের মেয়ে, সন্তানদের সুরক্ষিত ভবিষ্যৎ দেওয়ার জন্য কোনওদিন স্বামীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রশ্ন তুলতে সাহস করেনি।
কিন্তু স্বাতীর সঙ্গে সম্পর্কটা একটু বেশিই খোলামেলা হয়ে দাঁড়াচ্ছে ধীরে ধীরে। নূপুর জানত আবাসনের সকলেই এই অ্যাফেয়ারের বিষয়ে জানে এবং আলোচনা করে। এটাই ক্রমশ চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছিল নূপুরের কাছে। মোড়ের দোকানে দেখা করা, একসঙ্গে সিনেমা যাওয়া, বাইরে বেড়াতে যাওয়া সব খবরই তার কানে আসত।
প্রশান্ত শুয়ে নাক ডাকতে শুরু করে দিল। কিন্তু নূপুরের চোখে ঘুম এল না। শরীরে অস্বস্তি অনুভব করে বিছানায় উঠে বসল নূপুর। কী করে বন্ধ করবে প্রশান্তর এই অভ্যাস? কবে শুধরোবে প্রশান্ত? নূপুর আন্দাজ করে ছেলে-মেযোও নিশ্চয়ই এই সম্পর্কের কথা জেনে গেছে। বাবার সঙ্গে ওরা কেউই তেমন কথা বলতে চায় না। নূপুরের কিছু ভালো লাগে না। এরকম দীর্ঘসময় ধরে প্রশান্তর কোনও অ্যাফেয়ারই টেঁকেনি।
(৪)
সারা রাত নূপুরের চোখে ঘুম এল না। সে ঠিক করল ছেলেমেযেরা কলেজে বেরিয়ে গেলে প্রশান্তর সঙ্গে কথা বলবে। প্রশান্ত একটু দেরি করেই বেরোয়। অফিস কাছেই। ছেলেমেযেরা বেরনোর পর নূপুর প্রস্তাবনা না করেই বলল, প্রশান্ত তোমার আর স্বাতীর সম্পর্কের কথা ছেলেমেযোও জেনে গেছে। ওরা কিছুতেই তোমার সঙ্গে কথা বলতে চায় না। আমাদের আবাসনেও সকলেই তোমাদের অ্যাফেয়ারের ব্যাপারটা নিয়ে ঠাট্টা করে। লজ্জা করে আমার প্রশান্ত, বয়স হয়েছে। এসব এখন আর মানায় না তোমায়। আগেও আমি তোমার এই ধরনের ব্যবহার অনেক বরদাস্ত করেছি, আর সহ্য হচ্ছে না এখন। এছাড়া টাকাও প্রচুর ওড়াচ্ছ, এগুলো ঠিক নয়।
রাগে মুখ লাল হয়ে ওঠে প্রশান্তর। উত্তরে সে বলে, টাকা আমার, আমি যেখানে খুশি খরচ করব। আর বয়স? আমার মনে হয় তোমারই বয়স হয়ে গেছে। আমি তো স্বাতীর সঙ্গ পুরো মাত্রায় এনজয় করছি। আসলে ওর সঙ্গে থাকলে আমার নিজেকে যুবক মনে হয়। বাড়িতে তোমার আর ছেলেমেয়েদের সঙ্গে অশান্তি, এসবের মধ্যেই বেশি ডিপ্রেসড লাগে আর বাকি রইল আবাসন। জেনে নাও আমি এসবের তোয়াক্কা করি না। ঠিক আছে? না আরও কিছু বলবে?
কিন্তু প্রশান্ত আমি এসব আর বরদাস্ত করব না, কড়া ভাবে জানিয়ে দেয় নূপুর।
প্রশান্তর মুখ কুটিল হাসিতে ভরে যায়। কী করবে তুমি? বাপের বাড়ি চলে যাবে? ডিভোর্স দেবে? জানি তোমার দৌড় কত? বলে তোয়ালে কাঁধে ফেলে চান করতে চলে যায় প্রশান্ত।
নূপুরের চোখের জল গড়িয়ে পড়ে। সত্যিই তো বলেছে প্রশান্ত। নূপুর কী করবে? কিছুই না। বাপের বাড়ি নেই। কাঁদতে কাঁদতে রান্নাঘরের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে। মনে হয় একবার সোমের সঙ্গে কথা বলা দরকার কিন্তু সোমের নম্বর ওর কাছে নেই। স্বাতীর সঙ্গে কথা বলা ছেড়ে দিয়েছে নূপুর। আজকাল সামনাসামনি দেখা হয়ে গেলেও, না চেনার ভান করে ওকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে যাওয়া আরম্ভ করেছিল সে। এতে স্বাতী বেশ মজা পেত। এটা একপ্রকার চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল স্বাতীর কাছে। সেও বিদ্রুপ ভরা চোখে নূপুরের দিকে তাকিয়ে থাকত।
একদিন আবাসনের এক বান্ধবীর কাছ থেকে নূপুর জানতে পারল, স্বাতী বাপের বাড়ি গেছে দুতিন দিনের জন্য। সুযোগ বুঝে সোমের সঙ্গে কথা বলতে ওদের ফ্ল্যাটে চলে এল নূপুর। সোম নূপুরকে দেখে একটু অবাক হলেও, তাকে ভিতরে আসার জন্য অভ্যর্থনা জানাল।
নূপুর ভিতরে এসেই সোমের মুখোমুখি হল। ভূমিকা না করেই বলল, আপনি নিশ্চয়ই জানেন প্রশান্ত আর স্বাতীর অ্যাফেয়ার-এর কথা। আপনি ওদের আটকাচ্ছেন না কেন?
হ্যাঁ আমি সবই জানি। কিন্তু আপনিও তো প্রশান্তকে আটকাতে পারেন।
চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। কাতর শোনায় নূপুরের কণ্ঠ।
আমিও চেষ্টা করেছিলাম, বলে সোম কাঁধ ঝাঁকাল।
সোমকে নিরুদ্বেগ দেখে নূপুরের রাগ আরও বাড়তে লাগল। তার মনে হল এ কীরকম পুরুষমানুষ! কী নিশ্চিন্তে কথাগুলো বলছে। চেষ্টা করেছিল কিন্তু হেরে গেছে।
তাহলে নিজের স্ত্রী-কে ছেড়ে দেবেন?
হ্যাঁ, আর কী বা করতে পারি?
মানে?
মানে এই যে, আমার গলা উঁচু করার উপায় নেই। কারণ অতীতে আমিও এমন কিছু কাজ করেছি, যার সুযোগ স্বাতী নিচ্ছে এখন। আমার ব্যাবসাও এখন খারাপ যাচ্ছে। স্বাতীকে আটকাতে পারছি না ঠিকই কিন্তু সারাদিন বসে ওকে পাহারা দেওয়া কি আমার পক্ষে সম্ভব? এছাড়াও বাড়ি, ধ্রুব এমনকী আমার মা-বাবার দেখাশোনাও সব স্বাতীই করে। পুরো দাযিত্ব ও পালন করে। কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে থামে সোম। তারপর একটু সময় নিয়ে বলে, ঠিক আছে, কিছু তো একটা করতে হবেই! ও ফিরে আসুক, চেষ্টা করে দেখি।
আশার আলো দেখতে না পেয়ে নুপূর নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে এল। মনটা ভারী হয়ে ছিল। সোমও বসে বসে ভাবতে লাগল স্বাতী কী করে প্রশান্তর সঙ্গে এরকম খোলাখুলি প্রেমের সম্পর্ক বজায় রাখতে পারছে? অনেকে হয়েছে, লাজলজ্জা বলে কি কিছুই নেই স্বাতীর? একবার বাড়ি ফিরুক। আমিও দেখব কী করে ওকে সোজা রাস্তায় আনা যায়।
(৫)
সেদিন রাত্রে স্বাতীকে ফোন করল সোম। কড়া ভাষায় অনেককিছুই বলল কিন্তু স্বাতীকে কোনও ভাবেই ফেরাতে পারবে বলে বলে মনে হল না তার। সোমের কথায় এখন কিছুই আর যায় আসে না স্বাতীর। মন যা চায় সেটাই করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল স্বাতী। ধ্রুবর স্কুল খুলতে স্বাতী ফিরে এল সোমের কাছে। ধ্রুব স্কুল চলে গেলে বাড়ির কাজকর্ম সেরে একটু বসতেই, সোম এসে সামনে বসল। সোমকে মনে হল অন্যদিনের তুলনায় একটু বেশীই গম্ভীর।
স্বাতী, তোমার আর প্রশান্তর মধ্যে যা চলছে সেটা বন্ধ করো নয়তো…, সোমের কথার মাঝখানে তাকে থামিয়ে দিয়ে স্বাতী বলল, নয়তো কী?
খুব খারাপ হবে।
কী খারাপ হবে?
তুমি যা করে বেড়াচ্ছ সেটা কিছুতেই বরদাস্ত করব না।
কেন? আমার থেকে তোমার সহ্যশক্তি কম? আমি যদি তোমার সবরকমের আচরণ বরদাস্ত করে থাকতে পারি, তুমি পারবে না কেন?
স্বাতী… হিসহিসিয়ে ওঠে সোমের স্বর। ভুলে যেও না তুমি আমার বিবাহিতা স্ত্রী।
তাতে কী হয়েছে? স্বাতী ভয় না পেয়ে জিজ্ঞেস করল।
আমি যা করব, তুমিও তাই করবে? এ হতে পারে না, সোমের গলায় একটা মরিয়া সুর।
আমার যেটা ভালো লাগে আমি সেটাই করছি। নিজের জন্য বাঁচছি, এটাতে অন্যায়টা কী? যে-খুশি আমি তোমার কাছে চেয়েছিলাম, তুমি সেটা দাওনি। এখন আমি সেটা খুঁজে পেয়েছি অন্যখানে। আমি এখন আনন্দে আছি, এটা অন্যায়? এসব তো তুমি অনেক বছর ধরে করে এসেছ।
স্বাতী এখনও সময় আছে শুধরে যাও। আমার যদি রাগ হয়ে যায়, তাহলে আমি কোর্ট পর্যন্তয়ও যেতে পারি। তোমার আর প্রশান্তের বিরুদ্ধে কড়া ব্যাবস্থা নেব।
ঠিক আছে চলো কোর্টে। সারাজীবন আধমরা হয়ে বেঁচে থাকার থেকে তো অনেক ভালো।
স্বাতী, অনেক হয়েছে। প্রশান্তের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করো, নয়তো আদালতের দরজায় যাওয়ার জন্য তৈরি থেকো। আমি প্রশান্তকেও ছাড়ব না।
কিন্তু কোর্ট তো পরকীয়া সম্পর্কের উপর থেকে সমস্ত বিধিনিষেধ তুলে নিয়েছে। এটাই নতুন আইন।
তাই বলে তুমি এই অবৈধ সম্পর্ক বজায় রাখবে, ক্লান্ত শোনায় সোমের গলা।
তুমি আমার মালিক নও আর আমিও তোমার গোলাম নই। আমাকে আইনের ভয় দেখিও না। বসে চিন্তা করো তোমার ভুলটা কোথায়? আমি কত কিছু সহ্য করেছি। আমার প্রশান্তের সঙ্গে সময় কাটাতে ভালো লাগে এটুকুই আমি জানি। তোমার মতো আমারও সুখে থাকার অধিকার আছে। আর আমি তো কোনও দাযিত্ব নিতে অস্বীকার করিনি।
ঘড়ির দিকে তাকাল স্বাতী, বলল, ধ্রুবর স্কুল থেকে ফেরার আগে আমাকে বাড়ির সব কাজ সেরে রাখতে হবে। এছাড়া ওর প্রোজেক্টের জন্য কিছু জিনিসপত্র আমাকেই এখন বেরিয়ে কিনে আনতে হবে, বলে স্বাতী উঠে বাথরুমে চলে গেল।
বাথরুম থেকে স্বাতীর গুনগুন করে গাওয়া গানের কলি ভেসে আসতে লাগল। মাথায় হাত দিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে রইল সোম। এরপর কী করবে, কিছুই ভেবে পেল না সে। দেয়াল ঘড়িটা টিকটিক আওয়াজ করে শুধু সময়ে এগিয়ে চলার কথা জানান দিল।