করোনার এই মনখারাপ করা সময়ে যখন শুধুই হতাশা গ্রাস করছে আমাদের, মৃত আত্মীয় পরিজনের কথা ভেবে কিংবা অর্থনৈতিক বিপর্যয় সামলাতে নাজেহাল আমরা, তখন আসুন একটা মন ভালো করা গল্প বলা যাক।কিছু নারী আছেন আমাদের সমাজে, যারা আচিরেই হয়ে ওঠেন অন্য বহু নারীর অনুপ্রেরণা— মালবিকা আইয়ার তেমনই একটি নাম। তিনি এক কথায় অপ্রতিরোধ্য। বোম ব্লাস্ট সার্ভাইভার, অন্তর্জাতিক স্তরের মোটিভেশনাল স্পিকার, মডেল ও একাধারে আরও এনেক কিছু৷
মালবিকার গল্প জানতে হলে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে ২০০২ সালে। সেই অপয়া দুপুরে যা কিনা চিরতরে বদলে দিয়েছিল মালবিকার জীবন।
তেরো বছরের মেয়েটি তখন থেকেই ছিল স্টাইল ডিভা। তাদের বিকানেরের বাড়িতে সেদিন চলছিল পার্টি। মা-বাবা ব্যস্ত ছিলেন অতিথি অভ্যর্থনায়, আর মালবিকা নানা রকম পোশাক ট্রাই করে দেখছিলেন তাঁর নিজের বেডরুমে। তাঁর জিন্স মেরামত করছিলেন গ্লু দিয়ে। একটা ভারী কিছুর প্রয়োজন হয়েছিল গ্লু লাগানো জায়গাটা চাপা দিতে। গ্যারাজ থেকে তুলেও এনেছিলেন একটা বড়োসড়ো পাথরের খণ্ড। ডিম্বাকৃতি ওই খণ্ডটি হাতে করে চাপ দেওয়া মাত্র বিস্ফোরণ ঘটে। বস্তুত ওটা ছিল একটা গ্রেনেড। মালবিকার বাড়ির কাছেই ছিল একটা আ্যমিউনিশন ডিপো, যেখানে বেশ কিছু মাস আগে এক ভয়াবহ বিস্ফোরণের পর, এরকম বহু গ্রেনেডের খণ্ড ছড়িয়ে পড়েছিল এলাকায়। এই দুর্ঘটনায় মালবিকা তাঁর দুটি হাত হারান, সেই সঙ্গে সারা শরীরে অজস্র ফ্র্যাকচার, নার্ভ প্যারালিসিস, হাইপোএসথেসিয়া ।
জীবন তাই বলে থেমে যায়নি মালবিকার। বরং অক্ষমতা কাটিয়ে তিনি আত্মবিশ্বাসে ভর করে আরও অনেকগুলো সাফল্যের দরজা খুলে ফেলেছেন। জীবনের বাকি ১৭টা বছর শুধুই সাফল্যের উড়ান। পরীক্ষায় স্টেট লেভেল-এ উচ্চ স্থানাধিকারী থেকে ওয়ার্ল্ড ফোরাম-এ গ্লোবাল শেপার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া! বিষয়টি খুব সহজ ছিল না।
এখন তিনি বহু নারীর অনুপ্রেরণার উৎস। একাধারে পিএইচডি স্কলার, ফ্যাশন ডিভা, মোটিভেশনাল স্পিকার— মালবিকার আজকের পরিচয় এমন নানা ক্ষেত্রে ব্যাপ্ত।
অথচ একটা সময় এমনও পেরিয়েছেন তিনি, যখন জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ছিল আবার নতুন করে হাঁটতে পারা। শুধু আর-পাঁচটা মেয়ের মতো সুস্থ স্বাভাবিক একটা জীবন চেয়েছিলেন সেদিন। একটাই প্লাস পয়েন্ট ছিল তাঁর, তিনি একবারের জন্যও মনের জোর হারিয়ে ফেলেননি। তাঁর মতে এটাই তাঁর জেতার সূচনা করেছিল।
ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরের ৬টা মাস হাসপাতালে খুবই যণ্ত্রণাদায়ক এবং কষ্টকর এক অধ্যায় কেটেছিল মালবিকার। বুঝেই উঠতে পারছিলেন না, সব কী করে আবার আগের মতো স্বাভাবিক হবে। সাময়িক ভাবে ডিপ্রেশন-এরও শিকার হয়েছিলেন তিনি। পরিবারের সাপোর্ট তাঁর ক্ষেত্রে একটা বিরাট ভূমিকা নিয়েছিল ওই পর্যায়ে। বেশ খানিকটা সময় লেগেছে, প্রাথমিক হীনন্মন্যতা কাটিয়ে উঠতে। তারপর তিনি আগের মতোই চালিয়ে গেছেন এক্সট্রা ক্যারিকুলার অ্যাক্টিভিটি, ফ্যাশন শো-এ অংশগ্রহণ, নাচ। জীবনকে একইরকম সুন্দর করে দেখা, একই ভাবে উপভোগ করা এবং নিজেকে বারবার বোঝানো যে, এমন একটা ঘটনা ঘটে গেছে বলেই সব শেষ হয়ে যায়নি। এটাই তাঁকে বাঁচতে সাহায্য করেছিল।
ধীরে কিন্তু আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে তিনি শিক্ষাক্ষেত্রে এগিয়েছেন। যা যা করতে চেয়েছেন জীবনে, সেই ইচ্ছেপূ্রণের দিকে অগ্রসর হয়েছেন। স্কুল মিস হয়েছিল অনেকগুলো মাস। তাই দ্বিগুন খেটে ঘাটতি পূরণ করে, স্টেট লেভেল-এ স্থানাধিকারী হওয়ার মতো রেজাল্ট করলেন। স্কুলে নোটস নেওয়ার সময় প্রয়োজন হয়েছে রাইটারের কিন্তু সেই প্রতিবন্ধকতা তাঁকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। ডিফারেন্টলি এবলড হওয়া সত্বেও তিনি সাফল্যের সঙ্গে অর্থনীতিতে স্নাতক হন। ক্রমে পিএইচডি।
তাঁর জীবনের আরও একটি লাইফ চে়ঞ্জিং ঘটনা হল TEDx TALK-এ তাঁর দেওয়া মোটিভেশনাল স্পিচ। বহু মানুষ তাঁর কথায় খুঁজে পান নতুন করে বাঁচার অনুপ্রেরণা। এই সূত্রেই তাঁকে ট্রাভেল করতে হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা, ইন্দোনোশিয়া, নরওয়ে প্রভৃতি জায়গায়। ইউনাইটেড নেশনস –এর হেডকোয়ার্টারে দাঁড়িয়ে মোটিভেশনাল স্পিচ দেওয়ার গৌরবও অর্জন করেছিলেন তিনি।
তাঁর কথা জানতে পেরে একসময় স্বয়ং রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালাম, মালবিকার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। মালবিকা সত্যি সত্যিই পৌঁছে গিয়েছিলেন কালাম সন্দর্শনে। তাঁর প্রস্থেটিক হাত সম্পর্কে, তাঁর পড়াশোনা ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নানা কথা জানতে চান কালাম। একটি প্রতিবন্ধী ছেলেকে নিয়ে তাঁর লেখা কবিতা সই করে উপহার দেন মেয়েটিকে। সেই স্মৃতি সারা জীবনেও ভুলতে পারেননি মালবিকা।
যারা এই দুর্দিনে মনোবল হারিয়ে ফেলছেন, তাদের কাছে মালবিকা হোক এক দৃষ্টান্ত। নিজের উপর বিশাস আর লড়াকু মানসিকতার উপর ভর করে অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখিয়েছেন এই কন্যা। গৃহশোভা এই সাহসী নারীকে জানায় কুর্নিশ।